ঘর থেকে ঘরে
পাদক
মা...। ও মা...তৃণা কী আপনার ঘরে আছে?
-নাতো বৌমা...। ও দিকে নেই..?
-না...এদিকে কোন ঘরেতে তো দেখছি না..।
-দেখ তবে আশেপাশের কোন বাড়িতে গেছে। সময় হলে ঠিক আসবে..।
-কিন্তু সকাল থেকে ওকে দেখতে পাচ্ছি না..।
-ওর ছেলে মেয়েরা নেই..?
-না। তাদেরকেও তো কোনো ঘরে দেখছি না মা..।
-গেছে কোথাও.. ঠিক চলে আসবে..।
একদিন দুদিন পরেও তৃণার বাড়িতে না ফেরার ঘটনা বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছে খুব উদ্বেগের না হলেও সেন বাড়ির বড় বউয়ের কাছে ছিল বেদনার।কারণ সেন বাড়ির বড় বউ মন্দিরে পুজো দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তৃণাকে কুড়িয়ে পায়। মাতৃহারা জীর্ণশীর্ণ ময়লা দেহের তৃণার করুন ভাঙা ডাক সেদিন বউয়ের হৃদয় ছুঁয়ে ছিল। তাই সস্নেহে কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। বেশ কিছু দিনের নিয়মিত দুধ মাছের মতো ভালো ভালো খাবার আর বউয়ের আদর যত্নে তৃণার চেহারার পরিবর্তন আসে। স্বভাব চরিত্রেও একটা শান্ত ধীর স্থিরতা দেখা যায়। অল্প সময়ে তৃণা সেন বাড়ির প্রতি সদস্যের কাছে অতি আদরের হয়ে ওঠে। প্রতি সদস্যের অবসরে সেই হয় সাথের সাথি। এমন সাথীকে বাড়িতে আনার জন্য বাড়ির সদস্যরা বড় বউয়ের কাছে একরকম ঋণী হয়ে পড়ে।
উজান স্রোতের মত তৃণা শরীরে এসেছিল যৌবন। যেদিন তৃণা যমজ সন্তানের জন্ম দিল সেদিন বাড়ির সবাই বুঝেছিল পাসের বাড়ির গুবলা কেন এ বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে ছিল।
তৃণা আর ওর বাচ্চাদের খুনসুটি চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়িটা সদা চঞ্চল থাকত। হঠাৎ করে তৃনাও তার বাচ্চাদের নিখোঁজ হওয়ায় বাড়িটা নিঃশ্চুপ নিঝুম হয়ে যায়। বিশেষ করে বড় বৌমার মনে বিষণ্ণতার চাপা বেদনা ভর করে। বাড়ির আসেপাসের কয়েক জনের কাছে তৃণার খোঁজ খবর নিয়ে তার কোন সন্ধান না পেয়ে বড় বউ ভেবেই নিয়েছে সে আর ফিরে আসবে না।
বউমা...ও বড় বউমা...বাড়িতে আচ না কি গো...
দুপুরে খাওয়ার পর হেঁসেল কাজ সারতে গিয়ে পান খাওয়ার আর সময় হয়ে ওঠেনি বড় বউয়ের। পানের বাটা নিয়ে বসেছে। এমন সময় পাসের বাড়ির ঝেনি পিসির ডাক শুনতেই বড় বউ তাড়াতাড়ি ঘরে বাইরে এসে-আসুন... আসুন পিসি...ঘরে আসুন।
দুটো পানের খিলি সেজে একটা ঝেনি পিসিকে দিয়ে নিজে একটা মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে বড় বউ বলে-তা আজ খুব মনে করে যে এলে পিসি..? আজকাল যে আমার ছেলের বাড়ির পথ ভুলে গেছ..।
খাটে পা ঝুলিয়ে বসে ঝেনি পিসি তৃপ্তির সঙ্গে পান চাবাতে চাবাতে-তা কেন বড় বউ। কাল থেকি ভাবছি আসবো, সময় আর পাইনে। এখনি চলি এলাম। যে কথা কবো বলি এলাম...
আগ্রহে পা দুটো গুটিয়ে বাবু হয়ে বসে-বল পিসি বল..।
-তোমাদের বাড়ির যে তৃণা ছেলো না!
উৎসাহে-হ্যাঁ.. হ্যাঁ..পিসি..কদিন থেকে নিখোঁজ। আর পাচ্ছি না।
-তাকে যে দ্যাখখলাম! ও পাড়ার সুরেন মিস্ত্রীর বাড়িতে। বাচ্চা দুটো নিয়ে বারান্দায় শুয়ে আচে।
-সুরেন মিস্ত্রী কে পিসি?
প্রসন্নতা নিয়ে-চেন না বউ! এবার আমাদের গ্রামে যে ছেলেডা মাধ্যমিক পরীক্ষায় এসটার নিয়ি পাস করিচে তার বাবা গো। খুব গরিব। অতি কষ্ট করে ছেলেডাকে নেখাপড়া শিখিয়েচে। ছেলেডা যে বড় সুবোধ শান্ত।আমি যেতিই আমার ভালোমন্দ জিগিস করি পায়ে প্রণাম করলো বউ! আমি যে মন উজার করি আশির্বাদ করলাম। এমন ছেলি পাওয়া যে ভাগ্গির ব্যাপার বড় বউ..ভাগ্গির ব্যাপার..।
ঝেনি পিসির এসব কথায় বড় বউয়ের মন কেমন যেন দুমড়েমুচড়ে যায়। তাই কিছু ক্ষণ চুপ থেকে বলে-তৃণাকে জিজ্ঞেস করনি পিসি সে বাড়ির কাওকে না জানিয়ে চলে এলো কেন?
পানের পিক জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে খাটের ধারে তেমনি ভাবে বসে-করেচি তো বউ...।
-কী বললো পিসি?
-সে মুখ ভ্যেংচি বললো-"ছেলেমেয়ের কথা ভেবে চলে এসেছি। ওখানে থাকলে আমার ছেলেমেয়ের মানুষ করতে পারবো না।"
ও বাড়িতে তো খাওয়া থাকার জায়গার কোন অভাব নেই বলতে বললো-"তা নেই। কিন্তু এখন ও বাড়িতে ছেলেমেয়েরা মা বাবার অবাধ্য। মুখে মুখে তর্ক করে। চিৎকার করে কথা বলে। শুরুজনের সম্মান শ্রদ্ধা করে না। সারাক্ষণ ফোনে এমনভাবে মুখ গুঁজে থাকে যেন সবাই খড়ের গাদায় সূচ খুঁজছে । একে অপরের সাথে এমন করে যেন বাড়ির কেউ কাউকে চেনে না। বই পড়ে না। তাই তো বড়মার ছেলে এবার মাধ্যমিক ফেল করেছে। মেয়েটাও তো দেখি সব সময় কানে ফোন।আর বিকাল হলেই সেজেগুজে বেরিয়ে যায়। এমন উচ্ছৃঙ্খল বিচ্ছৃঙ্খ ছেলে মেয়ের সঙ্গে থাকলে আমার ছেলে মেয়ে ওদের মত আচরণ করবে। আমার অবাধ্য হবে। নিজের পায়ে কোনদিন দাঁড়াতে পারবে না। তাই ওদের নিয়ে এখানে চলে এসেছি।"
ভাঙা গলায় বড় বউ বলে-ও কি এই বড়মাকে ভুলে গেছে? আমার কথা মনে পড়ে না ওর?
-পড়ে বলেই তো যেই বলেছি তোমার বড়মা ছেলে মেয়েকে বোডিং ইস্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে একা একা মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে..
আনন্দে খাট থেকে এক প্রকার ঝাঁপ দিয়ে বড় বউ দরজার দিয়ে আঙুল দেখিয়ে বলে-ও পিসি..ওই দেখ কে আসছে..?
অতিউৎসাহী হয়ে পিসি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তৃণা তার বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে ম্যায়াউ.. ম্যায়াউ.. করে ডাকতে ডাকতে লেজে নাড়িয় বড় বউয়ের ঘরের দিকে আসছে..।
=================
Dis-24 parganas (n)
Pin-743286
Email -padok3474@gmail.com
West Bengal

Comments
Post a Comment