বিদায়ের স্রোত
চয়ন মন্ডল
"বিজয়া দশমী—আনন্দের দিন, কারও কাছে যা হয়ে উঠল চিরন্তন বিদায়।"
আজ বিজয়া দশমী। শিউলি ফুলের গন্ধে ভোরটা অন্যরকম। পাড়ার প্যান্ডেলে অদ্ভুত এক কোলাহল—মায়ের বিদায় যে আজ। শঙ্খধ্বনি, ঢাকের বাজনা আর উলুধ্বনিতে গমগম করছে চারদিক। একদিকে মা দুর্গার বিদায়ের বেদনা, অন্যদিকে আনন্দ ও মিলনমেলা। সারা বছরের অপেক্ষা শেষে এই দিনটিতে প্যান্ডেল ভরে উঠেছে মানুষের ভিড়ে।
সকালের পূজার্চনা শেষ হতেই শুরু হয়েছে সিঁদুর খেলা। মহিলারা মায়ের প্রতিমাকে সিঁদুর পরিয়ে একে অপরের কপালে, গালে রাঙিয়ে দিচ্ছেন। ঢাকের তালে আর শাঁখ বাজনার আবেশে ভেসে যাচ্ছে পাড়া। শুরু হয়েছে প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি।
কিন্তু এসবের মধ্যে নেই অনুরাধা। কেউ তার বা মিনির খোঁজ রাখেনি। মুখার্জিদের দোতলা বাড়ির কোণের ঘরে বসে সে চোখের জল ফেলছে। সবার বাড়িতে আলোর রোশনাই, ভোগের গন্ধ, হাসি—শুধু তাদের ঘরটিতে নিস্তব্ধতা।
গতবছর এই দিনেই তো অন্যরকম ছিল সবকিছু। অনুরাধা, সুজয় আর তাদের তিন বছরের মেয়ে মিনি পাড়ার প্যান্ডেলে ঢাকের তালে নেচেছিল, সিঁদুর খেলায় রঙে ভেসেছিল। বিকেলের দিকে প্রতিমা বিসর্জনের মিছিলে শামিল হয়েছিল তারা।
কিন্তু আনন্দের ভিড়েই ঘটে গেলো অঘটন। প্রতিমা গঙ্গায় নামানোর সময় এক দমকা স্রোতে ভেসে গেল সুজয়। মুহূর্তে চিৎকারে ভরে উঠল ঘাট। অনুরাধার চোখের সামনে যেন পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এলো। সিঁদুরে রাঙা মুখ ভিজে গেল অশ্রুধারায়।
মিনি তখনো বুঝতে পারেনি, শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলছিল—
"বাবা কই গেল মা? বাবাকে নিয়ে এসো…"
কোথা থেকে তাকে ফিরিয়ে আনবে অনুরাধা? স্রোতের টানে সুজয় হারিয়ে গেছে, রেখে গেছে তার জীবনে এক অনন্ত শূন্যতা। ঢাক থেমে গিয়েছিল, থেমে গিয়েছিল কোলাহল। কিন্তু অনুরাধার বুকের ভেতর যে কান্নার ঢাক বাজা শুরু হয়েছিল, তা আজও থামেনি। গঙ্গার স্রোতের মতোই তার অশ্রুধারা নিরন্তর।
সেদিন থেকেই অনুরাধার কাছে বিজয়া আর মিলন নয়—এ শুধু চিরন্তন হারানোর উৎসব।
_____________________
নাম - চয়ন মন্ডল
ঠিকানা - নেউলিয়া, পূর্ব বিষ্ণুপুর, চাকদহ, নদীয়া, 741223

Comments
Post a Comment