কেয়ারটেকার
দেবব্রত রায়
শাপমুন্নিতেও যে বর হয়, সেটা রাজা দশরথ হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলেন। কিন্তু অনিমেষের জীবনেও যে এরকম কিছু-একটা ঘটতে পারে, সেটা বোধহয়, ওর সাত-জন্মের ঠিকুজি-কুষ্ঠিতেও লেখা ছিল না! আজ ভোরেরর ট্রেনেই অনিমেষ উলুবেড়িয়ায় এসেছিল। মানে আসতে বাধ্য হয়েছিল। যদিও সে প্রত্যেক-মাসেই এখানে আসে তবে, সেটা প্রথম সপ্তাহে নয়। অনিমেষ আসে মাসের দ্বিতীয়-সপ্তাহ ধরে। কিন্তু এবার তাকে মাসের প্রথমেই, আসতে হয়েছে। অনিমেষের নিঃসন্তান পিসি-পিসেমশাই মারা যাবার আগে তাঁদের বাড়ি-ঘর, ব্যাংক-ব্যালেন্স, সব ওর নামেই করে দিয়ে গেছেন । আর তারপর থেকে অনিমেষ মাসের প্রতি-দ্বিতীয় সপ্তাহে বাঁকুড়া থেকে এসে দিন-সাতেক করে এখানে থেকে যায়। অবশ্য বাড়িটা চব্বিশঘণ্টা দেখভালের জন্য অনিমেষ ওর পিসেমশাইয়ের উড়ে-মালি পঞ্চাননকেই, কেয়ারটেকার হিসেবে রেখে দিয়েছে। হাসিখুশি-মুখের এই মানুষটাকে অনিমেষ খুব ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে। সারাদিন বাড়িময় সে যেমন পানের পিক ছিটিয়ে বেড়ায়, তেমনি তার কথা-বার্তাতেও যেন সবসময় রসের ফোয়ারা ছোটে। পঞ্চাননকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে, সে বলে, "আমি উবের আছিলা বাবু ! মোর বাপা আছিলা উড়িয়া আর মা, বেঙ্গুলি। তালে, মুই উবের হউছি কিনা ! "কিন্ত আপাতত, ওর বউয়ের শরীর খারাপের জন্য পঞ্চানন আজই দেশের বাড়িতে ফিরে যাবে বলে অনিমেষদের জানিয়ে রেখেছিল। খবরটা শোনার পর থেকে অনিমেষ এমনকি, ওর বাবা-মা-ও বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন। আর এসব কারণে, অনিমেষকে এবার মাসের প্রথম-সপ্তাহেই উলুবেড়িয়ায় আসতে হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, ক-দিন এখানে থেকে যে সে একটা কাজের লোক খুঁজবে, তার উপায়ও নেই। কারণ আগামীকালই ওর বুজুম-ফ্রেন্ড নীলয়ের বিয়ে। আর শুধুমাত্র, বিয়েটা ছাড়া, তার সব দায়-দায়িত্বই অনিমেষের !
পঞ্চানন অবশ্য, দেশে চলে যাবে বলে আগেভাগেই, বাড়ি-ঘর দেখাশোনার জন্য ওর পরিচিত একজন লোকের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিল। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাওয়ার পর কয়েকবার ফোন করেও, সে-লোকের আর পাত্তা পাওয়া গেল না! অবশেষে পঞ্চানন তার বোঁচকাবুঁচকি গুছিয়ে নিয়ে একপ্রস্ত কান্নাকাটি করে বেরিয়ে পড়তেই, অনিমেষও আর দেরি করেনি। সমস্ত বাড়িটা লক অ্যান্ড কি করে সে-ও ফেরার ট্রেন ধরবার জন্য রওনা দিয়েছিল। কিন্তু স্টেশনে এসে সমস্যাটা যে একেবারে, দ্বন্দ্ব সমাসের বহুব্রীহি- হয়ে উঠবে, তা কে জানত !
স্টেশনে পৌঁছে অনিমেষ মেদনিপুর-লোকালটা লেট আছে কিনা, জিজ্ঞেস করতেই, টিকিট কাউন্টারের মেয়েটা হটাৎ-ই, অনিমেষকে ওর নখপালিশে রাঙানো পাঁচ-পাঁচটা আঙুলের একটা সপাট-চড় দেখিয়ে বলল, আপনার ওই লাউবীজের মতো দাঁতগুলো মাড়ি থেকে ছাড়িয়ে আনতে আমার এক চড়ের বেশি দু-চড় লাগবে না, বুঝলেন! বউ-বোন জ্ঞান নেই, মেয়েছেলে হলেই হল! ওরাং-ওটাং, নোংরা বনমানুষ কোথাকার ! অনিমেষ তো মেয়েটার কথা শুনে একেবারে হতভম্ব। সেই সাতসকালে বাঁকুড়ার থেকে এতটা পথ ঠেঙিয়ে এসেও বাড়িটার জন্য একজন কেয়ারটেকার না-পেয়ে, এমনিতেই ওর মনটা খিঁচড়ে ছিল ! (যদিও ঠেঙিয়ে আসা কথাটা এক্ষেত্রে ঠিক এপ্রোপ্রিয়েট নয় বলে অনেকেই হয়তো, ফেবুতে প্রতিবাদের সুনামি বইয়ে দেবেন। কিন্তু অনিমেষ তার এই শব্দ-প্রয়োগের বিষয়ে একেবারেই অটল-অনড় ! কারণ অনিমেষ এতটা পথ সুপার-ফার্স্ট ট্রেনের ভাড়া দিয়েই এসেছে বটে তবে, সারাটা পথ তাকে নিজের দুটো ঠ্যাঙের উপর ভরসা করে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই আসতে হয়েছে ! অতএব এক্ষেত্রে ঠেঙিয়ে শব্দটা অনিমেষের মতে শুধু সঠিকই নয়, একেবারে দুহাজার শতাংশ জলহীন দুধের মতোই খাঁটি!) যাইহোক বাড়িটার জন্য একজন কেয়ারটেকার পাওয়া গেলে তবুও, ঠিক ছিল ! কিন্তু সেটাও পাওয়া যায়নি ! আর তারপর এই ধরনের অভদ্রোচিত নোংরা কথাবার্তা ! কাঁহাতক আর সহ্য করা যায় ! অনিমেষ যেন ভেতরে ভেতরে ক্রমশ ভিসুভিয়াস হয়ে উঠছিল। ফলে যা হওয়া দরকার ছিল, তাই হল! টিকিটকাউন্টারের মেয়েটি এরপর থামবার যেন আর সুযোগই পেল না । অনিমেষ তার আগেই একেবারে অ্যাটম-বোমার মতো ফেটে পড়ল! সমস্ত হিতাহিতজ্ঞান ভুলে আপনি-আজ্ঞের থেকে একেবারেই তুই-তোকারিতে নেমে এল সে! দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, ঘুষি পাকিয়ে লাফাতে-লাফাতে অনিমেষ গাঁকগাঁক করে চিৎকার করে উঠল। বলল, অ্যাই অসভ্য-জানোয়ার মেয়েছেলে, কাকে কী বলছিস রে ! আমাকে তুই চিনিস? বেরিয়ে আয়, কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আয় বলছি ! আমার লাউবিচির মতো দাঁত ! আমি ওরাং-ওটাং !
তীব্র গরমের দুপুরেও ওদের মূলত, অনিমেষের চিল-চিৎকারে টিকিট-কাউন্টারের এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেশকিছু লোকজন ততক্ষণে তার পাশে এসে জড়ো হয়েছে ! অনিমেষ এতক্ষণধরে লাফিয়ে-ঝাপিয়ে এখন হ্যা-হ্যা করে একটু দম নিচ্ছিল। একটা লোক ওর পাশে দাঁড়িয়েই ফুট কাটল। বলল, আইব্বাপ, দুদ্দিন চাগরি কত্তে না-কত্তেই টেম্পো দেকচেন মেয়েছ্যানাটার !
গ্লোবালওয়ার্মিংয়ের প্রোভোকেশনে তখন দু-পক্ষই চরম উত্তেজনায় ফুটছে। আর তারই মধ্যে লোকটা ফুট কাটতে, না-কাটতেই, অনিমেষ দড়াম করে একটা পেল্লায় ঘুষি বসিয়ে দিল কাউন্টারের বাইরের দিকে থাকা কাঠের ডেস্কটার উপর! উত্তেজনার এইরকম একটা চরম সিকোয়েন্সে আরও ভয়ংকর এবং সেল্ফি তোলার মতোই কিছু-একটা যে ঘটতে যাচ্ছে, সেটা ভেবে পাবলিক ক্রমেই, বেশ রসোসিক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কাউন্টারের মেয়েটি হটাৎ-ই, যেন রণে ভঙ্গ দিল! ভিতরের সমস্ত হাওয়া বেরিয়ে যাওয়া, তোবড়ানো ফুটবলের মতোই সে কাচুমাচু মুখে খানিকক্ষণ অনিমেষের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর টিকিট কাউন্টারের সামনে জমা হওয়া ভিড়টাকে এবং স্বয়ং অনিমেষকেও একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা বানিয়ে তাঁর ঝাপঝুপো চুলের আড়াল থেকে হেডফোনের দুটো ছোট-ছোট স্পিকার বের করে আনল ! তারপর অনিমেষের দিকে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আমাকে দুটো মিনিট সময় দিন... আসলে, একটা বাজে লোক ফোনে খুব ডিস্টার্ব করছে... প্লিজ, কিছু মনে করবেন না !
অনিমেষে একটু আগেই কিছু বলার জন্য বোধহয়, হা-ব্যাদান হয়েছিল । কিন্তু হটাৎ-ই, এমন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায়, তার মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ তো বেরোলোই-না এমনকী, ভারতবর্ষের ম্যাপের মতো হাঁ হয়ে যাওয়া নিজের মুখটাও সে বন্ধ করতেই যেন ভুলে গেল !
দু-পক্ষই হটাৎ, ঠান্ডা মেরে যাওয়ায় টিকিট কাউন্টারের সামনে জমা হওয়া ভিড়টাও পাতলা হতে বেশি সময় লাগল না ! শুধু একটা বুড়ি কপালে হাত ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে বলল, কী জানে বাবা, কী যুগ এল ! আগে জানতাম, নারদমুনিই ঠাকুর-দেব্তাদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে বেড়ায়, এখন দেখছি তোমাদের ফোনও কিছু কম যায়-না! ঘটনার এমনতর পরিবর্তনে হতভম্ব অনিমেষ আর কথা না-বাড়িয়ে চটপট টিকিট-কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু স্টেশনের সিঁড়িতে পা রাখতে, না-রাখতেই দেখল, ওর চোখের সামনে দিয়ে মেদনিপুর-লোকালটা বেরিয়ে যাচ্ছে ! একরাশ বিরক্তিতে অনিমেষ মনেমনে ট্রেনটার চৌদ্দপুরষ উদ্ধার করে একটা চায়ের দোকানের ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল। অযথা-উত্তেজনা আর ট্রেনটা মিস হয়ে যাওয়ায়, এতক্ষণে ওর মাথাটা বেশ টিজটিজ করতে শুরু করেছে! অনিমেষ ভাবল, এ-সময়ে এক-কাপ চা পেলে ভাল হতো। সে চায়ের অর্ডার দেওয়ার জন্য ঘাড় ঘোরাতেই দেখল, টিকিট-কাউন্টারের সেই মেয়েটা সামনের রাস্তা ধরে তার দিকেই হেঁটে আসছে! তাকে দেখতে পেয়ে অনিমেষ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে পড়ল। যেন মেয়েটাকে সে দেখতেই পায়নি। কিন্তু মেয়েটি একেবারে ওর মুখোমুখি এসেই দাঁড়িয়ে পড়ল! এবার অনিমেষের বুকের ভিতরটা দুরদুর করে উঠল। তাহলে কি, পুলিশ ডেকে ওকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই, মেয়েটা চায়ের দোকানের সামনে এসে হাজির হয়েছে !
একে তো অসহ্য গরম তারপর, এই টেনশনে অনিমেষ যেন ভিতরে-ভিতরে আরোই ঘেমে উঠল। কিন্তু হটাৎ, অনিমেষের মনে হল, যেন একটা পাখি ওর কানের কাছে গান গেয়ে উঠল ! সে চোখ ফেরাতেই দেখল, মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়েই হেসে যেন কিছু বলছে। অনিমেষও এবার আর না-হেসে পারল না। মেয়েটি বলল, শুনুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে ! তারপর অনিমেষকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে মেয়েটি টিকিট-কাউন্টারের পাশের একটা রুমে তাকে বসিয়ে এসিটা চালিয়ে দিল। অনিমেষের এই মুহূর্তে খুব লজ্জা লাগছিল। সে অস্ফুট-গলায় বলল, স্যরি ! কিন্তু মেয়েটি, ওর কথাটা যেন শুনতেই পেল না। বলল চা খাবেন ? অনিমেষ আবারও হেসে, হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ল।
চায়ে চুমুক দিয়ে গল্পে-গল্পে অনিমেষ জানতে পারল, মেয়েটার নাম অনুরাধা। বাড়ি, পুরুলিয়ায়। তাঁর ফার্স্ট-পোস্টিং উলুবেড়িয়াতেই এবং সে আপাতত, একটা বাড়ি খুঁজছে, ভাড়া নেওয়ার জন্য !
কথাটা শোনামাত্র, চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখেই, অনিমেষ যেন প্রায় দু-হাত তুলে লাফিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। বললো, আপনার ক-টা বাড়ি চাই, আই মিন, কতগুলো রুম চাই বলুন! আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি !
অনুরাধা হেসে বলল, আরে, বসুন-বসুন, আগে চা-টা তো খান! তাছাড়া আমার ছুটি না-হওয়া পর্যন্ত তাহলে-তো, আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে !
অনিমেষ হেসে বললো, পানের পিকের বদলে, যদি একজন বিউটিফুল কেয়ারটেকারের হাসিতে বাড়িটা ভরে ওঠে তাহলে, আমি হাজার-বছর ধরে অপেক্ষা করতেও রাজি আছি !
একটা মালগাড়ি যাওয়ার শব্দে অনিমেষের কথাগুলো বোধহয়, অনুরাধা ঠিকমতো শুনতে পেল না। বলল, কিছু বলছেন ?
অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর ওর সুন্দর-ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে আরেকবার হেসে ফেলল।
******
Debabrata Ray. Hajrapara. P.O. Bishnupur. Dt.Bankura. Pincodeno 722122.

Comments
Post a Comment