নি:সঙ্গতা
মাখনলাল প্রধান
শীতার্ত এই শহরটিতে প্রায়ই শোনা যায়, প্রতিটি বন্ধুর মুখ থেকে নাকি ভোরের আগে ঝরে পড়ে একেকটা অকল্পনীয় অদৃশ্য ভাষা, যেগুলো কেবল ধোঁয়ার ভিতরেই চলাফেরা করে। বন্ধুরা গোল হয়ে দাঁড়ায়, হাতে থাকে ফাল্গুনীর তৈরি চায়ের ভাঁড়, সারা রক্ষিতের মোড় আলোয় হাঁটে আর ভাঁড় থেকে উঠে আসা চায়ের গন্ধে ভেসে ওঠে শৈশবের হারানো দুপুরগুলো। যারা সেই চা খায়, তারা নাকি কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের জন্মদিন ভুলে যায়।
বন্ধুরা হাসতে হাসতে পটেক হাতড়ে বিড়ি বের করে। ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে ওঠে অলৌকিক জালের মতো ছবি—কেউ দেখে বাঁকুড়ার টেরাকোটা ঘোড়া পুলওমা হয়ে ছুটে যাচ্ছে, কেউ দেখে আরজিকরের পেছন দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা রক্তের ধারাকে কয়েকজন লাথি মেরে বন্ধ করার চেষ্টা করছে, কেউ আবার বেনিয়াটোলার ছোটো ছাপাখানার অক্ষরগুলোকে ডানা মেলে ভারতনাট্যম করতে দেখে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বাজ পড়া কোনো গাছকে নিয়ে এখানে কেউ কবিতা লেখে না; কারণ বিশ্বাস করা হয়, সেই কবিতা লিখতে গেলেই তারা মাটিতে নেমে এসে মানুষের কানে কানে গোপন মৃত্যুবার্তা ফিসফিস করে দেবে।
এই শহরের একমাত্র কবি—আমি—যখন অটোতে চড়ে গড়িয়া যাই, যখন ফুটপাত ধরে হাঁটি, দেখি নিজেরই ফুরিয়ে যাওয়া কথাগুলো ছায়ার মতো পাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বন্ধুরা যে একে একে চলে গেছে, তাদের প্রতিচ্ছবিই যেন বারবার আমাকে অনুসরণ করে।
আমার স্ত্রী সারারাত নীরবতায় সেলাই করে ছোটো একটি কাপড়ের ব্যাগ বানিয়েছিল। শুনেছি, সেই ব্যাগে নিঃসঙ্গতা ভরে রাখা যায়, যেমন জল ভরে রাখা যায় দুচোখে। একদিন আমি নিঃশব্দে কয়েক অধ্যায় নিঃসঙ্গতা পুরে নিলাম, আর কাউকে না বলে—সারা শহর ঘুরে বেড়ালাম সেগুলো কাঁধে নিয়ে। তখন প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি দরজা, প্রতিটি চাওয়ালা, প্রতিটি অটো চালক, প্রতিটি আমলা, প্রতিটি প্রশাসক, প্রতিটি মানুষের দৃষ্টি আমার কাছে হয়ে উঠল অস্পষ্ট অথচ পরিচিত, যেন ইতিহাসের কোনো গোপন নথি আমি বহন করে চলেছি ।
এখনও আমি জানি না—আমার সত্যিই কোনো বন্ধু ছিল কিনা, নাকি ধোঁয়ার ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া তাদের প্রতিচ্ছবিই আমার সঙ্গী । শুধু জানি, এই গল্প লেখা, সেই কাপড়ের ব্যাগ যতদিন আমার কাঁধে থাকবে, ততদিন এই তিলোত্তমা শহর তার নিঃসঙ্গতাকে আমাকে দিয়ে বইয়ে নেবে, যেন কোনো অন্তহীন উৎসবের প্রস্তুতি চলছে।
================
Makhanlal pradhan
Sukantapally, boral
Kol-700154
Makhanlal pradhan
Sukantapally, boral
Kol-700154

Comments
Post a Comment