জীবন্ত দুর্গা বিসর্জনে সবাই নীরব দর্শক কেন?
বটু কৃষ্ণ হালদার
"বিসর্জন" কথার অর্থ হল বিষণ্নতা,একরাশ নীরবতা। এই শব্দটার সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ।দুর্গাপূজার বিসর্জনে একদিকে যেমন নেমে আসে নীরবতা,বিষন্নতার কালো মেঘ। তেমনি অপরদিকে সমাজে নারীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনায় জীবন্ত প্রতিমার বিসর্জন হলেও বর্তমান সমাজের একাংশ পাথর কিংবা মাটির মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যান। দুটি বিসর্জনের ক্ষেত্রে দুটি চিত্র ফুটে ওঠে বাস্তবের আঙিনায়।
"নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান / বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান" এই মহান উক্তির মাঝে আমাদের ভারত বর্ষ বিশ্বের দরবারে নিজেকে মেলে ধরেছে।ভিন্ন ভাষা,সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষেই এর জন্যই সারা বছর ধরে কোন না কোন উৎসব পালিত হয়।এর মধ্যে অন্যতম উৎসব হোল বাঙ্গালীদের অন্যতম প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা।সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশে জাত ধর্ম নির্বিশেষে দুর্গাপূজার চার পাঁচ দিন সবাই উৎসবে মেতে ওঠে এটাই ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
গ্রীষ্মের দাবদাহকে জুড়িয়ে আসে অতিমেদুর মেঘছায়া বর্ষারানী।বর্ষার আগমনে শুষ্ক রুক্ষ ও পরিবেশ ভাষা খুঁজে পায়।নতুন প্রাণের সঞ্চার উজ্জীবিত হয় শাখা প্রশাখায়।শুষ্ক তৃণ নতুন প্রান সঞ্চারে আঁচলখানি মেলে দেয় পরিবেশে।আলো-আঁধারির খেলা মিলিয়ে বর্ষার বিদায়ী সুরে ফিরে আসে বাঙালি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় ঋতু শরৎকাল।নীল সাদা মেঘের ভেলায় বাঙালি মনকে বিমোহিত করে।দখিনা বাতাসে তালে তালে মাথা দোলায় সাদা কাশের ফুল ।উড়ন্ত সাদা বকের দল পথ হারায় দিগন্তের সীমানায়। শিউলি ফুলের সুবাস সাদা কাশবনের মৃদু মাথা নোয়ানো জানান দেয় মা আসছেন পূর্ণ ধরাধামে।দূর হতে ভেসে আসে পূজার গান। মহালয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয়ে যায় দেবীর আগমন।"বাজলো তোমার আলোর বেনু",গান দিয়ে শুরু হয় মহালয়া।বছরের ওই কয়েকটা দিনের জন্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি।
একদিকে যেমন মানুষের হাহাকার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠে অন্যদিকে কোটি টাকা ব্যয় বিলাসবহুল প্যান্ডেল সমাহারে উৎসবে মেতে উঠি, এ ধারণা অনেকেইকরে থাকেন।তবে সেই সঙ্গে আরো জানতে হবে যে কোটি কোটি টাকার পূজার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে রয়েছে আবেগ ও প্রাচীন সংস্কৃতি ঠিক তেমনই এই পূজার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে জীবনের একঘেঁয়েমি,অবসাদ, অবিচ্ছন্নতার অবসান আর নানান কর্মের সংস্থান। প্রতিমা তৈরি করা থেকে শুরু করে প্যান্ডেলের উপকরণ এমনকি বিসর্জন পর্যন্ত একের সঙ্গে রয়েছে ব্যবসার যোগসূত্র।প্রতিটি উপকরণ কেনাকাটি করতে হয়। মাইক জেনারেটর,লাইটিং এর ব্যবস্থাও করতে হয়।পূজার সঙ্গে সঙ্গে বহু দোকানপাট,গাড়ি ঘোড়া,জামা প্যান্ট থেকে শুরু করে বহু জায়গায় ব্যবসা মুখরিত হয়ে ওঠে। পূজার ওই কটা দিন বহু গরীব মানুষ ব্যবসা করে নিজেদের রুজি রুটির সংস্থান করেন।বহু অসহায় পরিবারের সদস্যদ ও ছোট ছোট উলঙ্গ শিশুদের মুখে হাসি ফোটে তা ভুলে গেলে চলবে না।
যে সংস্কৃতি যুগের পর যুগ একই ধারা প্রবাহমান।কলকাতা তথা বাংলার প্রধান ও প্রাণের এই উৎসব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা- ইউনেস্কো বাঙালি হিন্দুদের এই উৎসবকে 'ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি' তথা মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২০২১ সালে আবহমান বিশ্ব সংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারি কমিটির ষোড়শ সম্মেলনে (১৫ই ডিসেম্বর) কলকাতার দুর্গাপূজা তালিকাভুক্তির স্বীকৃতি লাভ করে। যা বাঙ্গালীদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের।
বাঙালির অতি প্রিয় দুর্গোৎসব মানে বছরের ওই কটা দিন জন্মভূমিতে ফিরে আসার প্রবল ইচ্ছা। বাবা মা আত্মীয় পরিজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কয়েকটা দিন সময় কাটানো, চুটিয়ে আড্ডা,প্রাণের কথা বলা আর খাওয়া দাওয়া। নতুন জামা প্যান্ট পরে কচিকাচাদের হইহুল্লোড়,দৌড়ঝাপ,কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে প্যান্ডেলের মন্ডপ।দুর্গাপূজা মানেই একটু বেহিসাবি হয়ে ওঠা।নতুন করে প্রেমে পড়া।কাউকে প্রথম ভালোবাসি বলা। নতুন নতুন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আবার অনেক ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের অশ্রুসিক্ত চিৎকার চাপা পড়ে যায় পূজার উচ্ছ্বাসে। কয়েকটা দিন আমোদ প্রমোদ ইহুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে বেজে ওঠে করুণ সানাইয়ের সুর।বিসর্জনের পালা মানে মন খারাপের শুভারম্ভ। ঘরের মেয়ে উমা তার বাড়িতে ফিরে যাবে যেন আনন্দের মধ্যেই যেন বিষাদের কালো মেঘ গ্রাস করে নেয় উচ্ছ্বাসের মুহূর্তগুলো। ঠিক যেন চরম সুখ পাওয়ার মাঝে বেদনার অবারিত ধারা জড়িয়ে ধরে হৃদয়কে।
একটা ফুলের কুঁড়ি ধীরে ধীরে সময় অনুসারে ফুলে পরিণত হয়। কয়েকদিন গাছে থাকার পর আপনার থেকেই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে যেতে বৃন্ত দিয়ে ঝরে মাটিতে মিশে যায়।ঠিক তেমনই সবার প্রথমে কাঠের ফ্রেমের উপর কাদা মাটির প্রলেপের মধ্যে নানান উপকরণ মিশিয়ে সেই প্রলেপ দিয়ে মূর্তি গঠনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয় এরপর রং করে শাড়ি,গয়না পরিয়ে মায়ের মাটির মূর্তি কে পূর্ণতার রূপ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়। বিভিন্ন আলোর রশ্মাইতে ঝলমল করে ওঠে পূজার প্যান্ডেল। কয়েকদিন পর সেই আলো ঝলমল উৎসবের রেওয়াজ শেষ হয়ে যায়। পূজার ওই কটা দিন হইচই করে কিভাবে শেষ হয়ে যায় তা বুঝতে পারা যায় না।এরপরে বিসর্জনের পালা। বিসর্জনের পালা মানে বিষন্নতার পরিবেশ। অশ্রুসিক্ত হয়ে সিঁদুর মাখিয়ে ঘরের মেয়েকে বরণ করে শেষ বিদায় জানায়। ভাসানের কয়েক দিন পর বিভিন্ন নদী বড় বড় পুকুরে শুধু কাঠের ফ্রেম পড়ে থাকতে দেখা যায়।মাটির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের নানা উপকরণ ও জলের স্রোতে ভেসে যায়।পরিবেশ ফিরে আসে তার চেনার রূপে।আর সেটাই হলো বিসর্জন।মানব সমাজে এই নিয়ম একই ধারায় প্রবাহমান।
বিসর্জন মানেই তো শেষ হয়ে যাওয়া।আমাদের ছোটবেলায়, মানে প্রায় আড়াই দশক আগের কলকাতা সংলগ্ন আধা মফস্সল পাড়ায় যখন প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে পুকুরের জল আঁজলা ভরে জল ছিটিয়ে দিত বড়রা,সেই জলের ফোঁটায় বিষাদ লগ্ন হয়ে থাকত। তখন দশমীর দিনই ভাসান হত।ফেরার পথে মন্দিরের মাঠের খাঁ খাঁ মণ্ডপের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। আলো-ঝলমল ভাল লাগার দিন শেষ হয়ে যাওয়ার মনখারাপ। বিসর্জন মানেই ছিল শেষ হয়ে যাওয়া।
অথবা, বিসর্জনই একমাত্র, যেখানে এই শেষ আর এক শুরুর জন্মমুহূর্ত।যেখানে ভাসানের পরের দিনই কোলাকুলি দেখতে ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে পুকুরে, আঁকশি দিয়ে টেনে আনবে কাঠামো। সেই কাঠামোর ওপর পরের বার ফের মাটি চাপবে, ফের প্রতিমা তৈরি হবে, ফের কুমোরটুলি থেকে ম্যাটাডোরে চাপিয়ে সেই প্রতিমা নিয়ে আসা হবে মণ্ডপে। পুজোই একমাত্র, যেখানে শেষ হওয়ার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা থাকে পরের বারের সূচনা। দশমীর মনখারাপও, তাই, খানিক সুখের মধ্যে ব্যথা। যা হারিয়ে গেল, তা ফিরে পাওয়া যেখানে অনিবার্য বালিশের পাশে নতুন জুতো রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতোই,শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা।
মাটির প্রতিমা বিসর্জনে মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।চোখে নেমে আসে জল সেই জল মুছতে দেখা যায় ভাসানের মুহূর্তে। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রতিমুহূর্তে হাজার হাজার জীবন্ত দূর্গা নির্যাতিত, অত্যাচারিত হয়ে এই পৃথিবী নামক গাছ থেকে অকালে পাতা ঝরার মত ঝরে পড়ে, তা দেখি আমরা নীরব দর্শক কেন?
বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়া এসে জল,স্থল,অন্তরীক্ষে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলেছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পিছনে শুধুমাত্র পুরুষদের নয় নারীর অবদান অনঅস্বীকার্য। নানান ধর্মের দেশে নারীদের সম্মান রক্ষার্থে তাদের দেবী রূপে পূজা করা হয়।দুর্গা,কালী,সরস্বতী, মনসা, বনবিবি ইত্যাদি ইত্যাদি। কুমারী পূজা ও করা হয়।সেই নারী সমাজ আজও কি সঠিক সম্মান পেয়েছে?
আমরা গত বছর দেখে ছিলাম স্বাধীনতার ৭৯ বছর পূর্তি উৎসবের আমেজ।বহু নেতা-মন্ত্রীরা নারীদের নিয়ে নানানভাবে আলোচনা,ভাষণ,চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে।সোনা জয়ী নারীদেরকে দেশের মাটিতে সম্মান জানিয়েছেন।সোনা জয়ী নারীরা সমগ্র বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বলতম নজির সৃষ্টি করলে ও ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের সম্মানের বিষয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পাওয়া যায় না।কারণ প্রাচীন পৌরাণিক যুগ সমাজ হতে সুবিচারের আশায় নারী ন্যায়ের দরজার কড়া নেড়ে আসছে।তাঁর জীবন্ত উদাহরণ সীতা ও দ্রৌপদী। প্রাচীন যুগে নানান কুসংস্কারগুলো যেমন সতীদাহ প্রথা,বাল্য বিবাহ, বিধবাদের একাদশী উপবাস,গঙ্গাতে কন্যা সন্তান ভাসিয়ে দেওয়ার মত বহু অযৌক্তিক প্রথাগুলো বিসর্জনের ন্যায় প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছিল। প্রাচীন ইতিহাসে,অপালা,ঘোষা, লোপামুদ্রা,মৈত্রী,গার্গী কিছু নারীর নাম পাওয়া গেলেও, সমাজ নারীদের নিরাপত্তার বিষয় তেমন ভাবে দাগ কাটতে পারেনি ।রয়েছে খাতা কলমে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস উপলব্ধি করলে বোঝা যায় নারীরাও সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেছিল। নিজেদের জীবনের কথা, সংসার ধর্মের কথা চিন্তা না করে নিজেদের জীবনকে সঁপে দিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে।অথচ বহু নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হলেও ৮০ শতাংশ রয়ে গেছে অন্ধকারে। দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও নারী বিপ্লবীদের জীবন অবাঞ্ছিত,অবহেলায়,বিসর্জন হয়েছে।কপালে নূন্যতম সন্মান টুকু জোটে নি।
বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় নারী আজ ভোগ্য ,আমদানি ,রপ্তানি,বিলাস,বৈভব,সংসারের যাঁতা কলে পিষে মরা, আর সন্তান উৎপাদনের মেশিন হিসেবে পরিহার্য।পণ্য পরিবহনের মত কেনাবেচা চলছে ছোট কন্যা সন্তানদের জীবন। বেশ কয়েক মাস আগে হাওড়ার এক হোমে নারী পাচার কাণ্ডে জড়িত ছিলেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা।এ ঘটনা তো ভারত বর্ষ তথা পশ্চিমবাংলায় নতুন কিছু নয়।"লিঙ্গ নির্ধারণ আইনা তো অপরাধ", তাতে অপরাধীর জেল ও জরিমানা দুই হতে পারে তা সত্ত্বেও কন্যা ভ্রূণ হত্যা বন্ধ করা গেছে কি? আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় সভ্য সমাজের সুষম বিকাশ ঘটেছে।অথচ উত্তরাখণ্ডের এক গ্রামে গত এক বছরে একটা শিশুকন্যা জন্মায়নি।কন্যাভ্রূণ নির্মূলন যজ্ঞে যোগ দিয়েছেন অজাত শিশুর পরিবার,শিক্ষিত ডাক্তারবাবুরা এবং আইনের মুখে ছাই দেওয়া প্রশাসন। জন্মাবার আগেই গর্ভপাতের প্রবণতা বেড়েছে।অথচ জন্মের লগ্নেই ১০০০ শিশুপুত্রের তুলনায় ১০৪ জন মেয়ে কম জন্মায় আমাদের দেশে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ফুলের কলিরা। জন্ম থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কন্যা ও পুত্র সন্তান অনুবাদ কমে চলেছে ১৯৪১ সাল থেকেই। কন্যাভ্রূণ নির্মূলনে চলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। পিছিয়ে নেই কলকাতার শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত অঞ্চল গুলো।
এই যুগে দাঁড়িয়ে সমীক্ষায় বলছে পুরুষ শিশুর তুলনায় কন্যা শিশুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বর্তমান এই আধুনিক সুসভ্য সমাজেও শুধুমাত্র কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে বহু নারীকে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয়,এমনকি অত্যাচার করতে করতে মেরেও ফেলা হয়।আজও আইনের চোখের সামনে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবাধে চলছে পণ প্রথা। সংবাদ মাধ্যমের পাতা খুললেই দেখতে পাওয়া যায়,পণ দিতে না পারার জন্য সদ্য গৃহ বধূকে পুড়িয়ে নয়তো হত্যা করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। নির্দোষ এক ফুলের মত নিষ্পাপ জীবনকে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতে হয় সমাজের কলুষিত প্রথায়। বহু মা ইতিমধ্যে তাদের সন্তানকে হারিয়েছে। জন্মের পর মা হারা বহু সন্তানরা অবহেলা,অনাদর, লাঞ্ছিত অত্যাচারিত হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েপড়ে। যে সমাজের জন্য সে অপরাধী হয়ে ওঠে সেই মুখোশধারী সমাজের মানুষ অপরাধের খাতায় নাম লিখিয়ে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়।আবার দেখুন আমাদের সমাজে ঘটা করে কুমারী পূজা করা হয়।অথচ দিনের স্বচ্ছ আলোয় দুধের শিশু থেকে মাঝ বয়সী এমনকি ষাট ঊর্ধ্ব নারী হয় বেয়াব্রু। এটা কি জীবন্ত দুর্গার অপমান নয়? এটা কি বিসর্জন নয়?সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ মোমবাতি জ্বালিয়ে মৌন মিছিল করে রামলীলাময়দানে,মনুমেন্টের পাদদেশে কিংবা ধর্মতলার মোড়ে। কিন্তু বুঝতে হবে লেলিহান শিখার মাঝে লুকিয়ে থাকে শিকারি হায়নার নীল চোখ। সমস্যা গোড়া থেকে নির্মূল হওয়ার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয়।তবে লজ্জার কথা হল এমন ভ্রষ্টাচার,যা কিছু ঘটছে সবই লোক চক্ষুর সম্মুখে।আদালতের দরজায় গিয়ে খোঁজ করে দেখুন নারী নির্যাতনের ফাইল পাহাড়সম জমে আছে।তার মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর খবর হল ইতিমধ্যে ফ্রিতে রেশন,বিদ্যুৎ,জল দেওয়া দিল্লী রাজ্যে নারী নির্যাতনের সংখ্যা নির্দ্বিধায় বেড়ে চলেছে।আমার,আপনার কথা নয়,সমীক্ষা বলছে দৈনিক গড় সংখ্যা ৬।তার পিছনের সারিতে একই পথে হাঁটছে রাজস্থান,বাদ যায়নি পশ্চিম বাংলা।২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে সরকার বলেছিল মেয়েটির চরিত্রে দোষ ছিল। দর কষাকষি নিয়ে খরিদ্দারের সঙ্গে বচসা হয়েছিল। ২০১৩ সালে বারাসাতের কামদুনিতে ঘটেছিল এক চরম ভয়াবহ ধর্ষণকাণ্ড। এই ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে শুধু বাংলার মানুষ নয় গর্জে উঠেছিল দেশের মানুষ।প্রতিবাদীদের মাওবাদী তকমা জুটে ছিল সরকারের থেকে। হুমকি দেয়া হতো, জেল খাটানোর ভয় দেখানো হত। কামদুনিতে ধর্ষিত বোনটি সম্পর্কে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে উক্তি ছিল:_" শরীর থাকলে যেমন জ্বর জ্বালা হয়/ তেমনি একটু আধটু রেপও হয়"। ২০১৪ সালে সিউড়ি ধর্ষণকাণ্ডে রাজ্য সরকারের বয়ান ছিল:_"বাচ্চা ছেলেরা একটু আধটু দুষ্টুমি করবে না?" ২০১৫ সালে কাকদ্বীপ ধর্ষণকাণ্ডে রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল,রেপ হলে ৪০ হাজার আর হাফ রেপ হলে ১৫ হাজার টাকা পাবেন। একথায় স্পষ্ট প্রমাণ হয় আমার দলের ছেলেরা রেপ করবে তার জন্য আমি জনগণের করপরিসেবা টাকা দিয়ে তা ভরপাই করব।কার্যত বলে রাখা ভালো এখান থেকেই মানুষরূপী হায়নারা ধর্ষণ করার জন্য আরো বেশি বেশি উৎসাহিত হয়েছিল। এরপরেও বাংলার মানুষদের হুঁশ ফেরেনি।আজও বহু মহিলারা ছাত্রীরা ধর্ষকদের আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক দলটির পতাকা কাঁধে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়,মিটিং মিছিলে যায়। এখানেই শেষ নয়, ক্লাইমেক্স আরো বাকি।
এরপরে ২০১৫ সালে পশ্চিমবাংলার রাজ্যজুড়ে ধর্ষণের মেলা শুরু হতে থাকে। কাটোয়া ধর্ষণকাণ্ডে বলা হয়েছিল ছোট্ট একটা সাজানো ঘটনা। একইভাবে রানাঘাট ধর্ষণকাণ্ডে বলা হয়েছিল, সরকারকে বদনাম করার চেষ্টা হচ্ছে। ২০২২ সালে হাঁসখালি তে ধর্ষণকাণ্ডে সরকার সরাসরি বলেছিল লাভ অ্যাফেয়ার্স ছিল,মেয়েটি প্রেগন্যান্ট ছিল। সারা পশ্চিমবাংলায় জুড়ে ধর্ষণের জেরবার হয়ে উঠেছে বাংলার জনগণ। ২০২৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের মাসেই আরজিকর হাসপাতালে ঘটে যায় আরো এক জঘন্য নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড। যেখানে সমগ্র বাংলার মানুষ নয়,সমগ্র বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে সেখানে আর পাঁচটা ধর্ষণ ও খুন হত্যাকাণ্ডের মতো এই ঘটনাটাকেও জল দিয়ে ভাত গিলে খাওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে দিয়েছে ।
এই বাংলা হয়ে উঠেছে ধর্ষিতার রাজ্য,
। কলকাতা তিলোত্তমার বুকে আরজিকর হাসপাতালে ঘটে গেল এক নরসংহার নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এক জুনিয়র ডাক্তার নাম মৌমিতা দেবনাথকে পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা হলো। জনগণের লাইফ লাইন হাসপাতালের জঘন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই তাকে অকালে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হল। অথচ বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আদৌ প্রকৃত দোষীরা বিচার পাবে না।রাত দখল,রাস্তা দখল অনেক কিছু হোল এর পরেও ঘটে গেলো জীবন্ত দুর্গা নির্যাতন।ধর্ষিত হচ্ছে নারী আর অপরাধীররা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে কারণ এই রাজ্যতে নারী ধর্ষিত হলে পুরস্কার স্বরূপ টাকা ধার্য করা হয়।আর অপরাধীদের আড়াল করা হয়।
ধর্ষক মানেই অপরাধী।ধর্ষকরা কখনোই সংস্কারগামী বা মানবতার আদর্শ হতে পারেনা। যে ঘটনা আগামী ভবিষ্যতে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে হাজারো প্রশ্ন রেখে যায়? একথা অস্বীকার করার উপায় নেই কোটি কোটি টাকা খরচা করে মাটির প্রতিমাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস আবেগে মেতে উঠি, ভক্তি শ্রদ্ধা দেখান, বিসর্জনের সময় আবেগপ্রবণ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে দুটি নয়ন অথচ সেই সমাজেই রোজ রোজ জীবন্ত দুর্গা বিসর্জন হয় সে কথা আমরা কেউ খেয়াল করি না।
তবে সমাজ পরিবর্তন শীল,কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকার নারীদের জন্য বহু প্রকল্প চালু করেছে।কিন্তু আমাদের দেশে নারী নিরাপত্তা একেবারে বিশ বাঁও জলে।ভিক্ষা বা অনুদান নয় কর্মসংস্থান হল দেশের সার্বিক উন্নয়ন, ঠিক তেমনি নারী প্রকল্প নয়,সুরক্ষাটা বিশেষ জরুরি।কিন্তু সুরক্ষা দেবে কে?যত ধর্ষণ,নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে পার্টি অফিসে পিঠে বানানো,কলেজের ইউনিয়ন রুমে ধর্ষণ, জুনিয়র ছাত্রীদের দিয়ে শরীর, মাথা মেসেজ করার মত ঘটনাগুলোতে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের অনুগামী রা জড়িত। তাহলে বিচার কে কার করবে? তার উপর নেতা মন্ত্রীরা নিজেরাই চার, পাঁচ জন নিরাপত্তা লক্ষীছাড়া চলতে পারে না তাহলে তারা কিভাবে জনগণের নিরাপত্তা দেবেন? স্বাধীনতা এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও সমগ্র দেশ জুড়ে নারী নির্যাতনের সমীক্ষা চূড়ান্ত পর্যায়ে পার করে গেছে। এর পরেও যদি ভাবেন কোন রাজনৈতিক দল নারীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দেবে তাহলে দিবা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই রাজনৈতিক দল ও আইন ব্যবস্থার ভরসা না করে বাড়ির সন্তানদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখান।
যেমন জীবন,মৃত্যু_আলো, অন্ধকার।শুধু পুরুষ দিয়ে সমাজের সচল প্রক্রিয়া চলে না। তাই নারী মা, জগত জননী জগদম্বা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অমর সৃষ্টি তে আমাদের কে বার্তা দিয়ে গেছেন:_"বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর"। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
==================
বটু কৃষ্ণ হালদার,৩২৭\৩ এম জি রোড,রোজী এপার্টমেন্ট, পোস্ট_ আরসি ঠাকুরানি, হরিদেবপুর কবর ডাঙা, কল_১০৪
Comments
Post a Comment