দিদৃক্ষা
রাজেশ কে. চক্রবর্ত্তী
'কাল একবার দেখা হতে পারে?'
দশমীর দুপুরে খাটে আধশোয়া হয়ে নিজের ফোনটা ঘাঁটছিল দেবমাল্য; হোয়াট্সঅ্যাপের সার্চ বক্সে র্যান্ডম সিক্যুয়েন্সে ক'খানা ডিজিট ইনপুট করতেই বিস্মৃতির অতল থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে যে নামটা স্ক্রিনের সারফেসে ভেসে উঠল, এককালে দেবমাল্যের প্রায়োরিটি লিস্টে সবথেকে ওপরে পিন্ করা থাকতো এই অ্যাকাউন্টটা। 'অহনা দাশগুপ্ত'—গ্রেয়েড-আউট ডিপিটার ডানদিকে, নামটার তলায় নিস্প্রভ হরফে ভেসে থাকা ওর এই লাস্ট মেসেজটা বেশ ক'বছরের পুরনো, কিন্তু দেবমাল্যর স্মৃতির প্যান্ডোরা বাক্সটি উলটে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আরেকবার আপাদমস্তক শিহরিত হয় সে। প্রোফাইলটা খুলে ওপরে-নীচে স্ক্রল্ করে দেখে, ওদের পুরনো চ্যাটগুলো তেমনি আড়ষ্ট হয়ে পড়ে আছে, ওর মেসেজগুলোর পাশে ডাবল টিকগুলো এখনও জাজ্বল্যমান সবুজে ছোপানো, যেন এইমাত্র 'সিন্' করে রেখেছে অহনা! যেন এখুনি আবার হাত বোলালেই অহনা এসে খানিকটা রাগত ভঙ্গিতে চ্যাট করতে লেগে যাবে।
দেবমাল্যের বুক ছাপিয়ে একটা নীরব দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে! ছুটির এই আমেজটা লক্ষ্মীপুজো অব্দি গড়াবে—অফিস খুললেই তো আবার দমফাটা ব্যস্ততা—তখন কি আর কোনদিকে তাকিয়ে চাইবার ফুরসত আছে? পুজোর এই প্রলম্বিত দুপুরগুলোর গায়ে কেমন একটা আলসেমি জড়িয়ে থাকে, না? বাইরে একটা কাকের কর্কশ গলায় পৃথিবীর যাবতীয় বিষাদ চুঁইয়ে পড়ছে যেন। অদূরে, পাড়ার পুজো মন্ডপে, লাউডস্পিকারে মৃদু ভলিউমে কিশোর কুমার বাজছে বেশ; উৎসবের আজ শেষ প্রহর—ঠাকুর ভাসানে যাবেন!
না, অহনার সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হয়নি দেবমাল্যর! মেসেজটা পেয়েই সাত-তাড়াতাড়ি ওকে ফোন মিলিয়েছিল দেবমাল্য, কিন্তু ওর ফোনটা এই খা-খা দুপুরের মতই নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তারপর থেকে। দেবমাল্যের উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয়নি, কি এক বোবা অভিমানে কাঠ হয়ে গিয়েছিল পিতৃ-মাতৃহীন এই অনাথ মেয়েটা। কিন্তু দেবমাল্যেরও কি আর কিছু করার ছিল? মা তখন ইউরিথ্রাল ক্যান্সারে মরমর, ফোর্থ স্টেজ চলছে। ছেলের জন্য তার বান্ধবীর মেয়ে মোহনাকেই পছন্দ মায়ের। অহনা অব্রাহ্মণ বলে দেবমাল্যের আর্জি পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছিলেন তার রিজিড্লি অর্থোডক্স মা। ছেলের পাঁজরের ভেতরে ধুকপুকুনিটুকু যদি মা টের না পেয়ে থাকেন, দেবমাল্য তার কি করতে পারে। সে তো মায়ের পরে অহনাকেই পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ভালোবেসেছিল, ওকে নিয়েই প্রেম আর বিশ্বাসের কুটোকাটা জুড়ে একটা অগোছাল সংসার বাঁধার স্বপ্নে বিভোর ছিল। অহনার ভাড়াবাড়িতে গিয়ে ওর খোঁজও করেছিল দেবমাল্য, এক প্রতিবেশীর মারফত জানতে পারে, মেয়েটা অন্য আরেকটা শহরে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে চুপচাপ, যোগাযোগের কোনও হদিশচিহ্ন না রেখেই।
উৎসবের এই মরশুমটায় বাইরে আশ্বিনের ঝাঁঝালো রোদ, ঝিম-ধরা দুপুরের নিদাঘ, তার ওপরে এই মেঘলা স্মৃতির বৈমনস্য—সব মিলিয়ে ঘরের গুমোট আরও ভারী হয়। এই কুন্ঠা বুঝি দেবমাল্যের হৃদয়ে এক অবর্ণনীয় স্বর্ণিম ব্যথা হয়ে বেজে যাবে চিরটাকাল—স্মৃতির এক অমল স্পর্শ যা হৃদয়ের ভাজে রাগি একটা দাগের মতই লেপ্টে থাকবে আমৃত্যু। আসলে, অপেক্ষার তো আর মৃত্যু নেই, যেমন অন্ত নেই আকাঙ্খার। কিন্তু সত্যিই কি মৃত্যুর আগে আর একটিবার দেখা হতে পারে না? আচ্ছা, সেদিন দেখা হলেই বা তাকে কি বলতো অহনা?
পরক্ষণেই আবার দেবমাল্যর মনে হয়, ওর জীবনে মোহনাই এখন ক্র্যুড্ রিয়্যালিটি, অহনা সুদূর নীহারিকায় মিলিয়ে যাওয়া একটা আবছায়া মাত্র—একটা অসমাপ্ত অধ্যায়ের নীরব আহ্বান, নিঃশব্দ আকাঙ্খা! হয়ত অহনা আর আগের মানুষটি নেই—পুরনো শহর, পুরনো নাম্বার, এমনকি পুরনো প্রণয় জীবনের তেল-নুন-ডালের হিসেবের অঙ্কে খোয়া গেছে বহুকাল।
ওর এরকম আকাশ-পাতাল ভাবনার ফাঁক গলেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে দেবমাল্যের স্ত্রী, কোলে ওর দুবছরের শিশুকন্যা। দেবমাল্য সন্ত্রস্ত হয়ে আলগোছে মোবাইলটা একপাশে নামিয়ে রাখে।
— 'ওমা, কিগো? বেলা যে পড়ে এল! এই শুনছো, আজ আমরা চন্ডীতলার মাঠে যাবো ভাসান দেখতে। আজ আর কোনও তালবাহানা চলবে না, এই বলে রাখলুম! নাও ওঠো, মুখহাত ধুয়ে এইবেলা ফ্রেশ হয়ে নাও।'
দেবমাল্যের মনে হয়, জীবনটা গল্পের মত একমুখী সরল নয় মোটেও, বরং একটা বহুরৈখিক উপন্যাসের মত—আর মানুষ হচ্ছে এই জীবন মহাকাব্যের একেকটি দৈবনির্দিষ্ট ক্যারেক্টার। স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে নতুন পরিচ্ছেদ লেখার ছাড়পত্র মানুষের হাতে নেই।
বাইরে, শারদোৎসবের মধুর ছায়ায় আর স্মৃতির নরম আলোয়, দাদরা তালে মধ্যম-ধীর লয়ে কিশোর কুমার তখনো গেয়ে চলেছেন—
'কি আশায় বাঁধি খেলাঘর
বেদনার বালুচরে........'
____________________________
রাজেশ কে. চক্রবর্ত্তী
রবীন্দ্রনগর, সোনামুড়া, জেলা: সিপাহীজলা,
রাজ্য: ত্রিপুরা, পিন: ৭৯৯১৩১।
Comments
Post a Comment