প্রবন্ধ
শিক্ষার সেকাল-একাল : এক দার্শনিক অনুসন্ধান
কৃশানু ব্যানার্জী
মানবসভ্যতার ইতিহাসে শিক্ষার স্থান যে সর্বাপেক্ষা কেন্দ্রীয় ও নির্ণায়ক—এ বিষয়ে দ্বিধার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষা কেবল জ্ঞানের বাহনমাত্র নয়, বরং মানুষের আত্মস্বরূপের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, যা সমাজ ও সংস্কৃতির গতিপথকে নির্ধারণ করে। কিন্তু শিক্ষা কেমন ছিল অতীতে এবং কেমন হয়েছে বর্তমানকালে—এই অনুসন্ধান শুধু ঐতিহাসিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যালোচনার সীমায় আবদ্ধ নয়; বরং এর ভেতরে নিহিত আছে এক গভীর দার্শনিক তাৎপর্য। "সেকাল" ও "একাল"—এই দুই কালের শিক্ষা পরস্পরকে নিরন্তর প্রশ্ন করে, কখনও বিরোধিতা করে, কখনও বা পরস্পরের ওপর দাঁড়িয়েই নিজের রূপ নির্মাণ করে। অতএব, শিক্ষার সেকাল-একাল তুলনায় আমাদের কেবল তথ্যের বিবরণ নয়, মানবজীবন ও সমাজচিন্তার প্রকৃত ভিত্তি উপলব্ধি করতে হবে।
মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় শিক্ষা যে একটি অনিবার্য ও মৌল প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তথাপি 'শিক্ষা' শব্দটির নিতান্ত ভৌত বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা একে পূর্ণাঙ্গ উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। সংস্কৃত "শিক্ষা" ধাতু মূলত ইঙ্গিত করে শেখা, জানা, আত্মস্থ করা—কিন্তু এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এর বহু গণ্ডি অতিক্রম করেছে। শিক্ষা কেবল জ্ঞানসংগ্রহ নয়, বরং জ্ঞানের দ্বারা অন্তর্লোকের আলোকপ্রাপ্তি; শিক্ষা হলো আত্মার অন্তঃসত্তার পরিশুদ্ধি, মানবচেতনায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন।
ভারতীয় উপনিষদীয় প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ছিল আত্মার জাগরণমুখী এক অন্তর্গত সাধনা। সেখানে বিদ্যা কখনও বস্তুগত প্রাপ্তির অনুষঙ্গ নয়, বরং ছিল মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার দীক্ষা। উপনিষদের বাণী—"सा विद्या या विमुक्तये"—অর্থাৎ সেই বিদ্যাই প্রকৃত, যা মানুষকে অজ্ঞতার গুহা থেকে মুক্তির উজ্জ্বল প্রাঙ্গণে আনয়ন করে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য দার্শনিক ঐতিহ্যে প্লেটো তাঁর বিখ্যাত "অ্যালিগরি অফ দ্য কেভ"-এ শিক্ষা-প্রক্রিয়াকে প্রতীকীভাবে বর্ণনা করেছেন অন্ধকার গুহার শৃঙ্খল থেকে আত্মার মুক্তি এবং সত্যের আলোয় উত্তরণের পথ হিসেবে। এই দুই ঐতিহ্যই আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে শিক্ষা মূলত জ্ঞানের দেহগত অর্জন নয়, বরং আত্মার গভীরে এক আলোকিত দীক্ষা।
কিন্তু বর্তমান যুগে শিক্ষার যে রূপ আমাদের চক্ষুগোচর হয়, তা মূলত বহির্মুখী। একালের সমাজে শিক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ প্রতিযোগিতার দৌড়, চাকরির নিশ্চয়তা, সামাজিক মর্যাদার সিঁড়ি এবং পেশাগত সাফল্যের কূটনীতিতে। এর ফলে শিক্ষার অন্তর্নিহিত দার্শনিক সারবত্তা বিলীন হতে বসেছে; মানুষ আর জ্ঞানের জন্য জ্ঞানকে অনুসন্ধান করে না, বরং তার প্রয়োগমূল্যকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়। এই বিচ্যুতি বোঝার জন্য আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হয় অতীতে—সেই সেকালের শিক্ষায়, যেখানে লক্ষ্য ছিল আত্মার পরিশুদ্ধি, জীবনের পূর্ণাঙ্গ উপলব্ধি।
অতীত ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল গুরু-শিষ্য পরম্পরার অম্লান ভিত্তির উপর। বিদ্যালয় ছিল তখনকার দিনে কেবল প্রাচীরবেষ্টিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নয়, বরং আশ্রমজীবনের অখণ্ড অংশ। প্রকৃতির নীরব সান্নিধ্যে, গুরুর আশ্রমে থেকে, শিষ্যরা কেবল শাস্ত্রপাঠ করত না, বরং জীবনযাপনের নৈতিক ভিত্তি রচনা করত। ভোরের প্রার্থনা, দৈনন্দিন তপস্যা, দেহ-মন সংযম, আচারনিষ্ঠা, গুরুর সেবার মাধ্যমে দায়িত্ববোধের চর্চা—সব মিলিয়ে শিক্ষা ছিল এক সর্বাঙ্গীণ মানবসাধনা।
এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দার্শনিক তাৎপর্য ছিল বিশেষভাবে গভীর। জ্ঞান তখন কোনো বাহ্যিক পণ্য নয়, বরং অন্তর্লোকে সুপ্ত থাকা আলোকস্রোতের উন্মোচন। গুরুর কাছ থেকে শিষ্য কেবল গ্রন্থগত তথ্য আহরণ করত না; বরং শিখত শৃঙ্খলা, ত্যাগ, সততা, আত্মসংযম ও মানবতার মহত্তম মূল্যবোধ। গুরু ছিলেন কেবল শিক্ষক নন, ছিলেন জীবনপথের দিশারী; আর শিষ্য ছিলেন কেবল ছাত্র নন, ছিলেন শিষ্যত্বের মধ্য দিয়ে আত্মোন্নতির সাধক।
সেকালের শিক্ষায় তাই "জীবন" ও "শিক্ষা"—এই দুটি পৃথক সত্তা ছিল না; বরং শিক্ষা ছিল জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষকে মানুষ করার জন্য যে অভ্যন্তরীণ সাধনা অপরিহার্য, তা-ই ছিল সেই ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। আধুনিক কালের মতো সেখানে পাঠ্যক্রম নির্ধারিত ছিল না রাষ্ট্র বা পেশাগত চাহিদার ভিত্তিতে, বরং মানবসত্তার বিকাশের অনিবার্য প্রয়োজনেই গড়ে উঠেছিল সেই ব্যবস্থা।
এই শিক্ষার মূলমন্ত্র ছিল—শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পণ। গুরু ছিলেন জীবন্ত শাস্ত্র, আর শিষ্য ছিল সেই শাস্ত্রের পিপাসু অন্বেষক। জ্ঞান আহরণের পথ ছিল তপস্যা ও ধৈর্যের; তৎকালীন শিক্ষায় সৃজনশীলতা মানে ছিল আত্মার বিকাশ, কেবল দক্ষতার অর্জন নয়। অতএব, সেকালের শিক্ষা মূলত ছিল জীবনঘনিষ্ঠ, আত্মাভিমুখী এবং মানবিকতার গভীরতম উৎস।
সময়ের ধারাবাহিক বিবর্তনে শিক্ষা আজ এক অভিনব রূপে আবির্ভূত হয়েছে—এটি আর ব্যক্তিগত সাধনা বা গুরু-শিষ্য সম্পর্কের অন্তরঙ্গ যোগসূত্র নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামোবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক প্রকল্প। একালের শিক্ষা তাই সীমাবদ্ধ হয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেওয়ালে, যেখানে শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের সম্পর্ক অনিবার্যভাবে পরিণত হয়েছে আমলাতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মাবলীর অধীনস্থ এক আনুষ্ঠানিকতায়। এই ব্যবস্থায় পাঠক্রম নির্ধারণ করে রাষ্ট্রের নীতি, অর্থনৈতিক প্রয়োজন বা কর্পোরেট শক্তির বাজারদর্শী চাহিদা; ফলস্বরূপ শিক্ষা আজ নিছক এক পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ কিংবা প্রতিযোগিতার খেলার সরঞ্জামে রূপান্তরিত।
একালীন শিক্ষার একটি বিশেষ সাফল্য নিঃসন্দেহে এর গণতান্ত্রিক বিস্তার। জ্ঞানের যে আলো এককালে সমাজের উচ্চস্তরে সীমাবদ্ধ ছিল, তা আজ প্রায় প্রতিটি মানুষের নাগালে এসে পৌঁছেছে। নারী, দলিত, অনগ্রসর শ্রেণি কিংবা সাধারণ গৃহস্থ—সবার জন্যই শিক্ষার দ্বার আজ কমবেশি উন্মুক্ত। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক বিস্তারের আড়ালে নিহিত আছে এক গভীর সংকট। এই সংকটের নাম যান্ত্রিকতা।
শিক্ষা আজ ক্রমশ একটি "কারিগরি প্রক্রিয়া" বা "ডেটা ট্রান্সফার"-এর প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে। ছাত্র ও শিক্ষক উভয়েই যেন নিছক তথ্য বিনিময়ের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষার খাতায় সংখ্যার ঘরবন্দী ফলাফলই শিক্ষার পরিমাপক; সৃজনশীলতা, মানবিক সংবেদন, আত্মার বিকাশ—এসব যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি যুগের বিস্ফোরণ শিক্ষাকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিলেও, সেই সঙ্গে শিক্ষাকে করে তুলেছে অতি-যান্ত্রিক, যেখানে মানুষ তৈরি হয় শ্রমবাজারের উপযোগী "রোবোটিক কর্মী" হিসেবে, অথচ আত্মার দীপ্তিমান মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।
ফলত, শিক্ষা যতটা মানুষের চেতনা প্রসারিত করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সীমাবদ্ধ করছে তাকে ভোগবাদী প্রতিযোগিতার চক্রে। আধুনিক শিক্ষা তাই মানবিকতার আদি অভ্যন্তরকে উন্মোচন না করে বরং প্রায়শই তাকে আড়াল করে রাখছে অর্থনীতি ও প্রযুক্তির ঘন কুয়াশার আড়ালে।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেকালের শিক্ষা ও একালের শিক্ষা একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। সেকালের শিক্ষা ছিল আত্মাভিমুখী—অন্তর্লোকে আত্মার দীপ্তি উন্মোচনের প্রয়াস, নৈতিক আদর্শে মানুষের চরিত্র গঠন, ও চেতনার অন্তর্গত বিকাশ। অপরদিকে একালের শিক্ষা হলো বাহিরাভিমুখী—প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, অর্থনৈতিক উন্নতি, পেশাগত প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক মর্যাদার ভোগবাদী সিঁড়ি বেয়ে ওঠা।
প্লেটো বলেছিলেন, শিক্ষা মানে আত্মার গুহা থেকে মুক্তি লাভ, অন্তরের অজ্ঞতা থেকে আলোকপ্রাপ্তি। ভারতীয় উপনিষদীয় ঐতিহ্য ঘোষণা করেছিল—"सा विद्या या विमुक्तये"—বিদ্যা মানেই মুক্তি, মুক্তির পথেই শিক্ষা সর্বার্থক। কিন্তু বর্তমান যুগের শিক্ষা সেই মুক্তির দর্শনকে বিস্মৃত হয়ে ভোগের দর্শনে আবদ্ধ। এখন শিক্ষা মানে চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য, সংখ্যার দৌড়ে অগ্রগণ্যতা, বাজারে টিকে থাকার কৌশল।
ফলে শিক্ষা আজ এক প্রকার অর্থনৈতিক পণ্য—যার চাহিদা-যোগান নির্ধারিত হয় বাজারনীতির ভিত্তিতে। বিশ্ববিদ্যালয় যেন কর্পোরেট শিল্পের শ্রমিক তৈরির কারখানা; ছাত্র যেন নিছক "হিউম্যান রিসোর্স", আর শিক্ষক যেন পাঠ্যক্রমে প্রোগ্রাম করা যন্ত্র। জ্ঞানের আদি উৎস যে আত্মবোধ, তা প্রায় হারিয়ে গিয়েছে প্রতিযোগিতার হাহাকার ও ভোগবাদের বাজারে।
এই তুলনা আমাদের সামনে এক মৌল প্রশ্ন উত্থাপন করে: শিক্ষা কি হবে অন্তরের জাগরণ, নাকি বাহ্যিক সাফল্যের যন্ত্র? সেকাল উত্তর দিয়েছিল—আত্মার মুক্তিই শিক্ষার লক্ষ্য; একাল বলছে—অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও ভোগসর্বস্ব জীবনই শিক্ষার ফলাফল। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বেই আজকের শিক্ষার সংকট নিহিত।
আধুনিক শিক্ষার মুখোমুখি সর্বাপেক্ষা গভীরতর বিপদ হলো মানবিক মূল্যবোধের ক্রমশ অবক্ষয়। বহির্বিশ্বে তথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপুল বিস্তার ঘটছে; জ্ঞান-প্রবাহ যেন অপ্রতিহত স্রোতের মতো মানবসমাজকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে। কিন্তু সেই স্রোতের ভেতরেই অনুপস্থিত হয়ে পড়ছে মানুষের অন্তরাত্মার মহত্তম উপাদান—সহমর্মিতা, সততা, নৈতিক সাহস, আত্মসংযম ও সৌজন্যবোধ। একালের শিক্ষা যে যতই বাহ্যিক পরিমাপে উন্নত হোক না কেন, তার অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য যদি মানুষকে সত্যিকারের মানুষে রূপান্তরিত করা হয়, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আজকের শিক্ষা সেই লক্ষ্য থেকে বহু দূরে সরে গেছে।
বর্তমান শিক্ষায় প্রতিযোগিতা ও ভোগবাদের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা মানুষকে ক্রমশ এক আত্মকেন্দ্রিক ভোগী সত্তায় পরিণত করছে। শিক্ষার সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার মানেই আজ কেবল পেশাগত সাফল্য, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক মর্যাদার নিশ্চয়তা। অথচ মানুষ যদি তার নৈতিক বোধ হারায়, তবে এই সাফল্য এক প্রকার শূন্য সত্তার উপর নির্মিত কৃত্রিম প্রাসাদ ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে নৈতিকতাহীন শিক্ষা সভ্যতার জন্য এক অদৃশ্য বিষ। জার্মান দার্শনিক নীৎশে বলেছিলেন—"জ্ঞান যদি নৈতিকতার হাতছানি হারায়, তবে তা কেবল শক্তির অহংকারে পরিণত হয়।" সেই অবস্থাই আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
অতএব, মৌল প্রশ্ন দাঁড়ায়—শিক্ষা কি কেবল বাহ্যিক উন্নতির যন্ত্র, না কি মানুষের আত্মার পূর্ণতার অন্বেষণ? যদি শিক্ষা কেবল বাহ্যিক উন্নতি সাধনের পথ হয়, তবে তা মানুষকে দক্ষ কর্মী করে তুলতে পারে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করতে পারে না। আবার যদি শিক্ষা আত্মার পরিপূর্ণতার জন্য হয়, তবে তাকে হতে হবে নৈতিকতার বাহক, সহমর্মিতার উৎস, মানবিকতার চিরন্তন সেতু। কিন্তু আজকের শিক্ষা আত্মার এই অন্তর্লোকে কতদূর প্রবেশ করছে? আমরা দেখছি—প্রযুক্তি ও অর্থনীতির ঝলমলে বাহ্যিকতা যত বাড়ছে, আত্মার দীপ্তিমান আলো ততই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
তবু সেকাল ও একালের শিক্ষাকে আমরা নিছক দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড় করালে তাতে সত্যের পরিপূর্ণ রূপ ধরা পড়বে না। সেকালের শিক্ষার মধ্যে যেমন ছিল মানবিকতা, নৈতিকতা ও আত্মোন্নতির সাধনা, তেমনি এর সীমাবদ্ধতাও সুস্পষ্ট—গণশিক্ষার অনুপস্থিতি, সমাজের বিস্তৃত স্তরে জ্ঞানের অপ্রাপ্যতা, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ঘাটতি। অপরদিকে, একালের শিক্ষা এই সীমাবদ্ধতাগুলো অনেকখানি অতিক্রম করেছে। গণতান্ত্রিক প্রসার, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ, মানবাধিকারচেতনা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা—সবই একালের শিক্ষার অবদান। সুতরাং একালের শিক্ষাকে নিছক নেতিবাচক বলে অভিহিত করা অন্যায় হবে।
সমস্যা হলো, সেকালের শিক্ষা ও একালের শিক্ষা উভয়ই তাদের চরম সীমায় গিয়ে একপাক্ষিক হয়ে পড়ে। সেকাল আত্মাভিমুখী হলেও বহির্জগতে তার প্রসার সীমিত ছিল; একাল বহির্মুখী হলেও আত্মার দিকে তার দৃষ্টি প্রায় শূন্য। সুতরাং প্রয়োজন এক সমন্বিত দর্শন—যেখানে সেকালের মানবিকতা ও নৈতিকতার পবিত্রতা মিশে যাবে একালের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে।
এই সমন্বয় ছাড়া শিক্ষা কেবল বিকলাঙ্গ থেকে যাবে—একদিকে নিছক আধ্যাত্মিক রোমান্টিসিজম, অন্যদিকে নিছক প্রযুক্তিগত যান্ত্রিকতা। দুইয়ের সংযোগেই সম্ভব এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা, যা মানুষকে করবে একইসঙ্গে আত্মজাগ্রত ও সমাজোপযোগী। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন—"শিক্ষা তখনই শিক্ষা, যখন তা মানুষের পূর্ণতার পথে অগ্রসর করে।" অর্থাৎ প্রকৃত সমাধান নিহিত আছে সেকাল ও একালের সার্থক মেলবন্ধনে, যেখানে মানবিকতার আলো ও বিজ্ঞানের দীপ্তি একসঙ্গে মানুষকে দিশা দেখাবে।
শিক্ষা কখনোই কেবলমাত্র যুগের নীরব প্রতিফলনমাত্র নয়; বরং যুগ-চেতনার নির্মাণ ও মানবসমাজের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের অন্যতম প্রধান আধার। একে যদি কেবল একটি সামাজিক প্রয়োজন বা রাষ্ট্রনির্ধারিত নীতির অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হয়, তবে শিক্ষার অন্তর্নিহিত মৌল সত্তাকে আমরা অস্বীকার করি। শিক্ষা মূলত এক অন্তর্মুখী সাধনা—অন্তরের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের দিকে, জড়তা থেকে সজীবতার দিকে, আর আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা থেকে মানবিক মহত্ত্বের দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়া।
সেকালের শিক্ষার মূলে ছিল আত্মশুদ্ধি, ধ্যান, তপস্যা, গুরু-শিষ্যপরম্পরার স্নিগ্ধ আত্মীয়তা এবং এক অদৃশ্য কিন্তু গভীর আধ্যাত্মিক বন্ধন। সেখানে বিদ্যা ছিল মুক্তির উপায়, মানুষকে সত্য ও কল্যাণের পথে স্থাপন করার ব্রত। একালের শিক্ষা আমাদের দিয়েছে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তিনির্ভর বিস্তৃত জ্ঞানভাণ্ডার এবং গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শক্ত ভিত। তবু এই দুই মেরুর মাঝখানে যে অনিবার্য ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একপাক্ষিক ও যান্ত্রিক করে তুলছে। একালের শিক্ষায় দক্ষতা আছে, কিন্তু গভীরতা নেই; তথ্য আছে, কিন্তু আত্ম-উন্নতির সেই অন্তর্দীপ্ত সাধনা প্রায় বিলুপ্তপ্রায়।
অতএব, আজকের সর্বাধিক জরুরি কাজ হলো শিক্ষার পুনর্নির্মাণ—যেখানে সেকালের মানবিকতা, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্মুখী সংযম একাকার হবে একালের যুক্তিবাদ, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে। কেবল এই সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে প্রকৃত শিক্ষা—যা মানুষকে একদিকে সভ্যতার বাহ্যিক শিখরে উন্নীত করবে, অন্যদিকে আত্মার অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণতার দিগন্ত উন্মোচিত করবে।
শিক্ষার অন্তিম লক্ষ্য কখনোই শুধুমাত্র কর্মদক্ষ নাগরিক তৈরি করা নয়; বরং পূর্ণ মানুষ তৈরি করা। মানুষ, যে চিন্তায় স্বাধীন, হৃদয়ে সহমর্মী, বোধে নৈতিক, আর আত্মায় উদার। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুলে গেলে শিক্ষা পরিণত হবে নিছক যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, যেখানে জ্ঞান কেবল তথ্যের সঞ্চয়, আর মানুষ পরিণত হবে রোবটের অনুকরণে।
তাই শিক্ষাকে সত্যিকার অর্থে মানবতার মুক্তির দিশারী করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই দার্শনিক ভিত্তিতে—যেখানে শিক্ষা মানে আত্মার উন্মোচন, মানবিক মহত্ত্বের বিকাশ। গুরু-শিষ্যপরম্পরার মানবিক ঐতিহ্যকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিস্তৃত জ্ঞানতন্ত্রের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়াই আজকের সময়ের সর্বোচ্চ কর্তব্য। সেকালের অন্তর্মুখী প্রজ্ঞা আর একালের বহির্মুখী বিস্তার—এই দুইয়ের সেতুবন্ধনেই নিহিত থাকবে প্রকৃত শিক্ষার ভবিষ্যৎ।
=================
কৃশানু ব্যানার্জী
শশীনাড়া, মেমারী, পূর্ব বর্ধমান, ৭১৩১৪৬
Comments
Post a Comment