মূল্যবোধ ও বিদ্যালয়-শিক্ষা
ভুবনেশ্বর মন্ডল
বর্তমান পৃথিবীতে সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনে মূল্যবোধ প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। এর ফল বড় ভয়াবহ। মূল্যবোধ বলতে বোঝায় সততা, সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, বৃহত্তর সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সত্যনিষ্ঠা, সঠিক কাজ, ভালো মন্দের বিচার, অন্যের দুঃখ কষ্ট বোঝা, মানুষকে সম্মান প্রদর্শন, অন্যের মতামত ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, আইন মেনে চলা, শৃঙ্খলা পূর্ণ জীবনযাপন,শ্রমের প্রতিশ্রদ্ধা,সহনশীলতা,সামাজিক ন্যায়,কল্যাণ, দেশপ্রেম, আত্ম সচেতনতা, বিবেকবোধ ইত্যাদি। এসব আসে সামাজিক রীতিনীতি,জীবনাচরণ, ঐতিহ্য ও আদর্শ থেকে। এসব কে লালনপালন করে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মূল্যবোধ সুস্থ ও স্থিতিশীল সমাজ তৈরি করে। মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে মানবসভ্যতা। আজকের বিশ্বায়ন,বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর যান্ত্রিক জীবন,ভোগবাদ ইত্যাদি প্রায় গ্রাস করে ফেলছে আমাদেরকে। তাই সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ও ব্যক্তি জীবনে একটা অস্থিরতা ও অবক্ষয়ের অন্ধকার। জন্ম নিচ্ছে নৈরাজ্য। এজন্যই কবি জীবনানন্দ বলেছিলেন- "অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে।"
মূল্যবোধ হীনতার এই অন্ধকার থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে প্রকৃত শিক্ষা। এই শিক্ষা আমাদের পরিবার এবং সমাজ যেমন দিতে পারে তেমনি দিতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয়ও। একটি শিশুর মূল্যবোধ গঠনে প্রথম ভূমিকা নেয় তার পরিবার। মা বাবার আচার ব্যবহার, জীবনযাত্রা, নৈতিকতা, আদর্শ ইত্যাদি শৈশব থেকেই চেতন অবচেতনে শিশুর মনের উপর প্রভাব ফেলে। মা বাবার মধ্যে থাকা মূল্যবোধ শিশুটিকে প্রভাবিত করে। শৈশবে শিশু মন নরম মাটির তালের মত। এ সময় শিশু-মনে মা-বাবার আদর্শের ছাপ তাই সহজেই মুদ্রিত হয়ে যায় এবং তা সে আজীবন অন্তরে বহন করে। যদি মা-বাবার মধ্যেই মূল্যবোধহীন নেতিবাচক বিষয় থাকে সেগুলি শিশুর মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। তাই শিশুর মূল্যবোধ গঠনে মা-বাবার ভূমিকাই প্রথম। একটি শিশু তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় পারিবারিক পরিবেশেই কাটায়। এ ব্যাপারে যৌথ পরিবারেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। যৌথ পরিবারে একটি শিশু সকলের সঙ্গে মিলেমিশে মানিয়ে চলার সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ পায়। কিন্তু এখন বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে যৌথ পরিবারের কনসেপ্ট প্রায় উঠেই গেছে। বেশিরভাগই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। সেখানে মা-বাবা আর দুই একটি সন্তান। সুতরাং শৈশবে শিশুর উপর তার পরিবারে মা বাবার প্রভাবই বেশি। মা-বাবার নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, জীবনযাপন, আচার-আচরণ ইত্যাদি প্রতিটি শিশুর মন ও মনস্তত্ত্ব ও গড়ে তোলে। মা বাবার মধ্যে যদি মূল্যবোধহীন নেগেটিভ চিন্তাভাবনা বেশি থাকে তাহলে শিশুর মধ্যে মূল্যবোধহীনতা প্রশ্রয় পায়। আর মূল্যবোধ যুক্ত ইতিবাচক মনোভাব থাকলে শিশু মূল্যবোধ সম্পন্ন হয়ে ওঠে। এরপর সামাজিক পরিবেশে শিশু মেলামেশা করতে শুরু করে। সামাজিক পরিবেশে যদি সদর্থক মূল্যবোধ থাকে তাহলে তা শিশুর যথাযথ মানসিক বিকাশ ঘটায় এবং তাকে সামাজিক করে তোলে । এরপর শিশু স্কুল জীবনে প্রবেশ করে। স্কুলের পরিবেশ, নিয়ম-শৃঙ্খলা,পঠন -পাঠন, শিক্ষক শিক্ষিকাদের আচার-আচরণ,অন্যান্য সহপাঠীদের সংস্পর্শ শিশুর মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। একটি শিশু বা বালক-বালিকা স্কুলে প্রতিদিন প্রায় ৫-৬ ঘন্টা কাটায়। এই সময়টা কম নয়। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একটা শিশু বা বালক-বালিকা স্কুলে ১০-১২ বছর পড়াশোনা করে। এই ১০-১২ বছরের স্কুলসান্নিধ্য তার জীবনে একটা বড় প্রভাব ফেলে। প্রথমেই বলতে হয় স্কুলের নিয়ম-শৃংখলার কথা। প্রতিটি স্কুলেরই কিছু নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। সেগুলোকে ছাত্র-ছাত্রীদের মেনে চলতে হয়। এর মধ্য দিয়েই ছাত্রছাত্রীরা শৃঙ্খলা পরায়ণ হয়ে ওঠে। যেমন সময়ানুবর্তিতা,ক্লাসরুমে ধীর স্থির ও শান্তভাবে পাঠ গ্রহণ, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন,তাঁদেরকে মান্যতা দান, তাঁদের যথাযথ উপদেশ গ্রহণ, কোন প্রকার শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করা, স্কুলের সম্পত্তি নষ্ট না করা,পরীক্ষার সময় কোন অসৎ উপায় অবলম্বন না করা,শান্তভাবে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা, খেলাধুলার যথাযথ নিয়ম-কানুন মেনে চলা, স্কুলের খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় সুস্থ মানসিকতা নিয়ে অংশগ্রহণ করা। এইসব নিয়ম কানুন পালনের মধ্য দিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মূল্যবোধ সঞ্চারিত হয়। আবার স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহামানব, মনীষী, কবি,সাহিত্যিক, লেখক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, সমাজসেবী ইত্যাদি মহান ব্যক্তিত্বদের জন্ম দিন মৃত্যুদিন স্মরণ ও মননের মধ্য দিয়েও মূল্যবোধের বিকাশ হয়। স্বাধীনতা দিবস উদযাপন, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন, মাতৃভাষা দিবস উদযাপন, দেশপ্রেমিক শহীদদের স্মরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়েও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা,দায়বদ্ধতা,দেশপ্রেম ইত্যাদি মূল্যবোধ সঞ্চারিত হয় ছাত্র-ছাত্রীদের মনে। আবার প্রতিটি পাঠ্য বিষয়েই কিছু না কিছু মূল্যবোধের শিক্ষা আছে। শিক্ষক মশাই যদি সেগুলি জীবনের সঙ্গে রিলেট করে দেন তাহলে তা আত্মস্থ করে ছাত্র-ছাত্রীরা মূল্যবোধ সম্পন্ন হয়ে ওঠে। ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী করে তুলতে পারলে কুসংস্কার, গোঁড়ামী, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা,অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি দূর হয়। এসবের মধ্য দিয়েও মূল্যবোধের বিকাশ হয়। ছাত্র ছাত্রীরা ভবিষ্যতের নাগরিক হয়ে যখন বৃহত্তর সমাজ জীবনে প্রবেশ করে তখন তাদের মূল্যবোধ গুলি দেশ ও জাতিকে সুফল দেয়। বিদ্যালয় সমাজের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। বিভিন্ন সামাজিক বৈচিত্র্যের মিলন মেলা হল বিদ্যালয়। তাই বিদ্যালয়কে বলা চলে সমন্বয়ের তীর্থক্ষেত্র। ছাত্র-ছাত্রীরা জাতপাত, ধর্ম,অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদির পার্থক্য ভুলে এখানে একটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়। পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, সমানুভূতি, হৃদ্যতা ইত্যাদি বিকাশের একটা পরিবেশ তৈরি করে দেয় বিদ্যালয়। মূল্যবোধ গঠনে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক শিক্ষিকাদের জ্ঞান, বোধ, আচার-আচরণ, জীবন যাপন, নৈতিকতা, সততা, যুক্তিবাদ, বিবেক বোধ, সহনশীলতা, নিয়মানুবর্তিতা, সমায়ানুবর্তিতা, সহানুভূতি, মমত্ববোধ, ক্ষমা, দয়া, মানবিকতা, শৃঙ্খলা পরায়ণতা ইত্যাদি বহুগুণ ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ছাত্রছাত্রীরা একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষিকার মহৎ গুণগুলিকে চেতনে অবচেতনে সবসময় অনুসরণ করে। সেই গুণগুলি তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকেও ফলপ্রসূ করে। এজন্যই শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে রোল মডেল ।
তবে বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতিতে মূল্যবোধ গঠনে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে বলে মনে হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সেভাবে আর অনুসরণ করছে না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সঙ্গে যেন দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকের উপদেশ গ্রহণ, শিক্ষককে মান্যতা দান, শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, বহু ক্ষেত্রেই তলানিতে ঠেকেছে। মাঝে মাঝে খবরে শোনা যায় বা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখাও যাচ্ছে যে ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা অপমানিত হচ্ছেন, এমনকি প্রহৃতও হচ্ছেন। শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, শিক্ষাঙ্গনে অসুস্থ রাজনৈতিক অনুপ্রবেশও শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে। শিক্ষক নিয়োগে সংগঠিত সিস্টেমের দুর্নীতি ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবক অভিভাবিকা ও জনসাধারণের কাছে একটা নেগেটিভ বার্তাও পৌঁছে দিচ্ছে। এর ফলে শিক্ষক কুল একটা সিস্টেমের বলি হয়ে শ্রদ্ধা ও সম্মান হারাচ্ছেন। এ বড় দুঃসময়। মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী আমাদের ভোগবাদে দীক্ষিত যান্ত্রিক জীবনযাত্রা। সমাজে গুরুজনদের মান্যতা দানের বিষয়টা নতুন প্রজন্মকে আর সেভাবে নাড়া দিচ্ছে না। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও স্বেচ্ছাচার প্রবল আকার ধারণ করেছে। অনেকেই এখন স্বরাজ্যে সম্রাট। তবে বিদ্যালয় গুলিতে মূল্যবোধের অবনমনে শিক্ষকদের যে কিছুটা দায়বদ্ধতা নেই তা নয়। শিক্ষকতা এখন ব্রত না হয়ে একটা পেশা। আগেকার শিক্ষক মশাইদের সেই আত্মত্যাগ সেবার মনোভাব এখন একটা অংশের মধ্যে ততটা আর নেই। অনেক সময় কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্র-ছাত্রীদের শাস্তি দানে উদ্যত হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন। তাঁরা খবরে উঠে আসছেন। একটা নেগেটিভ বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে জনমানসে। তবে এ ধরনের ঘটনাগুলি হাতে গোনা। বলা যেতে পারে বিচ্ছিন্ন। মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষকের অপরিণামদর্শীতাকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সমগ্র শিক্ষককূলের উপর। এ বড় দুর্ভাগ্য! অনেক কাল আগে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবি ভারতচন্দ্র তাঁর 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে বলেছিলেন - "নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?" বর্তমানে শিক্ষাদান কার্যে যেসব শিক্ষক শিক্ষিকারা আসছেন তাঁরাও কিন্তু এই অবক্ষয়িত সমাজেরই প্রোডাক্ট। চেতনে অবচেতনে এই অবক্ষয়িত সমাজের প্রভাব কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদের উপর কিছুটা পড়াই এক অনিবার্য নিয়তি। এ কারণেই হয়তো ব্রত পেশা হয়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে মানুষের মনে একটা নেগেটিভ অ্যাটিচুড তৈরি হচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে ছাত্র-ছাত্রীদের মনে। কারণ ওরাও তো এই অবক্ষয়িত তো সমাজেই শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে বিষবৃক্ষ। আর বিষবৃক্ষের কাছে কি অমৃত ফল আশা করা যায়? তবে এটাকে সামগ্রিক চিত্র বলা যায় না। এখনো মূল্যবোধ একেবারে নিঃশেষিত হয়নি। হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটছে। কিন্তু অংশ কখনো সমগ্র নয়। তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা যদি সমাজে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে চাই, সেক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তাই শিক্ষাঙ্গনে মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা একান্তই জরুরি।
___________________________________
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবুবাগান
পোস্ট সাঁইথিয়া
জেলা বীরভূম
পিন নাম্বার ৭৩১২৩৪
Comments
Post a Comment