পথের দিশা
সৈকত প্রসাদ রায়
রোহিত ছোটবেলায় পড়াশোনায় কখনো ভালো ছিল না। স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় সে পিছিয়ে থাকত। সেই সময়ে তার জীবনের কঠোর কিন্তু সদয় শিক্ষক ছিলেন সোমনাথবাবু। সোমনাথবাবু কখনো দয়া দেখাতেন না, নিয়ম আর শৃঙ্খলা শেখাতেন। কিন্তু যখন প্রয়োজন হতো, তিনি ছাত্রকে বুকে জড়িয়ে উৎসাহ দিতেন।
রোহিতের ছোট মন বুঝত না কেন মার খেতে হয়। ভুল করলে পিঠে বা হাতের তালুতে বেতের ঘা পড়ত, মুখে কঠোর ভাষা, আর রোহিতের গা কাঁপত। কিন্তু একদিন যদি সে সঠিক উত্তর দিত, সোমনাথবাবু বুকে জড়িয়ে আদর করতেন। রোহিত মনে করত, সেই আদরের মুহূর্তটা সবচেয়ে মূল্যবান। এটি ছিল তার ছোট্ট জীবনের অমূল্য শিক্ষা—ভয় আর ভালোবাসার ভারসাম্য।
বছর কেটে গেল। রোহিত বড় হয়ে ডাক্তার রোহিত বসু হলো। ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়লেই শুধুই সোমনাথবাবুর জন্য মন কেমন করে। সেই সময়গুলো যেন জীবনের মধুর অধ্যায়।
রোহিতের ছেলে সমিত পড়াশোনায় আগ্রহ দেখায় না, মোবাইল আর গেমে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। রোহিত ভাবল, হয়তো তাকে পড়াশোনার স্বাদ দিতে হবে ঠিক সেইভাবে, যেভাবে ছোটবেলায় সোমনাথবাবু তাকে পড়াতেন।
একদিন ছুটির দিন, রোহিত সমিতকে নিয়ে সোমনাথবাবুর বাড়িতে গেল। উদ্দেশ্য সোমনাথ বাবুর কাছে নিজের ছেলেকেও পড়তে দেওয়া। কিন্তু চার মাস আগে সোমনাথবাবু চিরতরে চলে গিয়েছেন এটা রোহিত জানত না। শেষ দিনগুলোতে সোমনাথ বাবু তার কৃতি ছাত্র রোহিতের কথা বলতেন সেটি সঞ্জয় সোমনাথ বাবুর একমাত্র ছেলের মুখে শুনে রোহিতের চোখে জল চলে এল।
রোহিত মাথা নত করে স্মৃতিতে ডুবে গেল। মনে ভেসে উঠল গান—"কেউ কি জানে কোথায় গেলে তাদের ফিরে পাই / সেই আমাদের সহজপাঠের মাস্টারমশাই।" রোহিত ছেলের পাশে দাঁড়াল।
সঞ্জয়—সোমনাথবাবুর ছেলে—রোহিতকে দেখে বললেন, " আমি হয়তো বাবার মতো হতে পারিনি, তবে আমি শিক্ষক। চাইলে সমিতকে পড়াতে পারি।"
রোহিত চোখে জল ধরে সঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরলেন। "ধন্যবাদ, তুমি এখন সমিতের নতুন মাস্টারমশাই।"
সমিত প্রথমে অবাধ্যতা করলেও সঞ্জয়ের ধৈর্য ও মমতায় ধীরে ধীরে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখাল। রোহিত দেখল, ছেলে আবার ধাপে ধাপে ছোটবেলার রোহিতের মতো শেখার আনন্দ খুঁজছে।
সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে রোহিত দেখল—সমিত পড়তে বসেছে আপন ইচ্ছেতে, বই খুলছে, সঠিক উত্তর খুঁজছে। মনে হলো, ছোটবেলার মাস্টারমশাই সোমনাথ বাবু সঞ্জয়ের মধ্যে দিয়েই সমিতকে নতুন জীবন পথের দিশা দেখাচ্ছেন।
=== সমাপ্ত ===
Comments
Post a Comment