একটা অ্যাবসার্ড রীতির গল্প
গন্তব্যহীন গন্তব্য
মাখনলাল প্রধান
১
সন্ধ্যা নামছে, রাত্রির খোঁজ রাখি না । অথচ এই শহরে ভাল করে দেখবেন সন্ধ্যা যেন ঠিকমতো নামে না, আর ভোরও বিভোর হয়ে আছে না হওয়ার ধান্দায় । আলো-আঁধারের মাঝামাঝি সাবওয়েতে একটা ধূসর ওড়না আকাশে টাঙিয়ে রেখেছে, বোধহয় কারও অসাবধানতাবশত আঁচড়ে কালি মিশে গেছে কাগজে।
আমি হাঁটতে হাঁটতে গির্জার ঘড়িটার দিকে ভুল করে তাকাই। সেই ঘড়ি নির্দ্বিধায় সময় দেখাচ্ছে—এগারোটা বাজে। অথচ আমার ঘড়িতে যেন অন্য এক খণ্ডকাল। সকালে যখন বের হয়েছিলাম, আমার ঘড়িটা পিছিয়েই ছিল । এখন দেখি সেটা অনেকটা সামনে এগিয়ে। সাড়ে এগারোটা বাজে দেখাচ্ছে।
আমার বুকের মধ্যে ফুটবল খেলছে । এটা সামনে যাওয়া না পেছনে যাওয়া—কোনটা আসল সময় ? আমি জানি না। তবুও এক অজানা তাড়া আমাকে খাড়া করে মনে করিয়ে দেয়, আমাকে যে গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে।
কেন পৌঁছাব, সে কথা আমিই জানি না । গাড়ি ধরব ? নাকি কারও সঙ্গে দেখা করব ? একি শুধু শুধু যাওয়া, যাওয়ার মধ্যেই গন্তব্য ?
২
রাস্তাঘাট অদ্ভুতভাবে ফাঁকা । মানুষজন নেই, অথচ সেই শূন্য ময়দানে যেন ভিড়ের কোলাহল শোনা যায় । আমি হাঁটছি , হাঁটতে হাঁটতে দেখছি প্রতিটি মোড় একইরকম । রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় একই ধরনের, একই অন্ধকারে আলো ফেলে রাখা ল্যাম্পপোস্ট, একই ছায়ার ছায়া ।
প্রথমে তো মনে হল আমি একেবারে সোজার সোজা চলেছি। কিন্তু পরক্ষণে টের পেলাম—যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেই দিকটাই আবার সামনে এসে দাঁত ক্যালাচ্ছে । যেন শহরটা আমাকে নিয়ে খেলছে ।
এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে শ্বাস নিতে নিতে ভাবলাম যে —হয়তো আমিই বুঝি একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার পায়ের ছাপগুলোও যেন বারবার পায়ের নীচে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
৩
ঠিক তখনই দেখলাম একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কার্নিশে । তার শরীরে সদ্য আয়রন করা ইউনিফর্ম, মুখে পাকা চাঁপাকলার মতো প্রশান্তি । চোখ দুটো মিসাইলের মতো আমার দিকে ।
আমি দৌড়ে গিয়ে বললাম — রাস্তাটা কোন দিকে ? আমাকে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে।
পুলিশ আমার কথার উত্তরই দিল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে উঠল। সেই হাসি একেবারে এমনই অদ্ভুত যে আমার মনে হল, হাসির ভেতর একটা গোটা মেট্রো ট্রেনের গহ্বর লুকিয়ে আছে।
আমি আবার অনুনয় বিনয় যোগ করে জিজ্ঞেস করলাম —শোনেন কাকু , সময় বড়ই অল্প । কোনদিকে গেলে রাস্তাটা পাব ?
সে দুতিনটা চোখ কপালে তুলে বলল— রাস্তা মানে পথ ?
তারপর গোঁফ জোড়া মুচড়ে , নাকে হাতের তালু ঘষে শরীরটা ঝাঁকিয়ে যেন ভেতরের কোনো অদৃশ্য শক্তি কানেকশন জুড়ে নিলেন ।
৪
এবার বেশ কায়দা করে হাসলেন । হাসির ভেতরে ভেতরে চালান করা শব্দগুলো আমার কানে বেশ বাজতে থাকে। মনে হচ্ছে এ শহরজুড়ে এই হাসির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে।
আমি বলি —আপনি কিন্তু শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন । সাহায্য করা আপনার দায়িত্ব ।
-আমার দায়িত্ব , আমার দায়িত্ব বলে আমার পকেট থেকে রুমালটা তুলে নিয়ে গলায় বেঁধে বলল - আমি স্রেফ দাঁড়িয়ে আছি । সেটাও সহ্য হচ্ছে না । সত্যি আপনি এত মজা করতে পারেন , বলে হি হি করে হেসে দিল ।
রুমালটা অমনি ঘামে ভিজে রঙ বদলে গেল ।
তারপর একটা পান পকেটের কৌটা তুলে মুখে ঢুকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন-
আপনি বলুন তো আপনি নিশ্চিত যে , আপনি যাবেনই ? রাস্তা মানে ব্যাপারটা একেবারে এমনই সস্তা যে আরেকটা রাস্তা, আরেকটা রাস্তা , আরেকটা রাস্তা । আমি ভেবে দেখেছি আপনি যাবেন কী করে ? হারিয়ে যাবেন । তাছাড়া ও রাস্তা একটা হলেই তো হয় নাকি ?
আমি অবাক হয়ে বললাম —কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।
সে বলল - আপনি কোথায় যাচ্ছেন, সে তো আপনি জানেন না বললেন । তাহলে পৌঁছাবেন কিসে ? পৌঁছাবেন কোথায় ? এটা ভাববার বিষয় । আপনি না সত্যি- বলেই
সে হাসিতে আবার ফিরে গেল ।
৫
আমি হতাশ হয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকি। চারদিকে হঠাৎ বাতাস ঘন হয়ে আমাকে ঘিরে ধরে । আমার মনে হয় শহরটা আস্তে আস্তে গিলে নিচ্ছে আমাকে। প্রতিটি মোড়ে একই রকম দোকান, একই রকম বাড়ি, একই রকম জানালা থেকে একই আলো।
একসময় দেখি, অনেকগুলো একইরকম মানুষ একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে আছে । তাদের কারও মুখ নেই , চোখ নেই , নাক নেই কান নেই - নেই শুধু নেই । শুধু মাথার জায়গায়টা ফাঁকা । অথচ তারা প্রত্যেকে ঘড়ি হাতে ধরে আছে , পকেটে রুমাল আছে।
আমি কাছে যেতেই সবাই একসঙ্গে একসুরে বলে উঠল —সময়ের সঙ্গে মেলাতে পারলে গন্তব্য পাওয়া যায়।
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম —কিন্তু সময়কে তো পাওয়া যাচ্ছে না ।
তারা একযোগে হেসে উঠল। সেই হাসি পুলিশের হাসির মতোই। সারাশহর এট সঙ্গে হাসিতে ফেটে পড়ল ।
৬
আমি আবার দৌড়াতে শুরু করি । মনে হয় যদি দৌড়াই, তাহলে অন্তত নিজেকে এগিয়ে রাখা সম্ভব । কিন্তু যত দৌড়াই , দেখি ,আমি একই জায়গায় ফিরে আসছি ।
রাস্তার শেষ নেই। প্রতিটি পথই যেন একে অপরের ছদ্মবেশ ।
মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি । কিন্তু আকাশ কোথায় ? এ তো একটা ফাঁকা ছাদ, যেটা নীচের শহরটাকে বন্দি করে রেখেছে।
৭
অবশেষে আবার সেই পুলিশটাকে সামনে পাই । সে যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল । এখন তার হাতে ঘড়ি নেই , পকেটে রুমাল নেই ।
সে বলল —আপনি তাহলে যাচ্ছেন ?
আমি মাথা নীচু করে বললাম —জানি না।
পুলিশ বলল — জানার দরকারও নেই। গন্তব্য মানে আসলে অজানাকে ধাওয়া করা। যতক্ষণ আপনি জানবেন না, ততক্ষণ আপনার যাত্রা চলবে । আপনি ভীষণ উৎসাহ বোধ করবেন এমনকি চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না । সারা জগত আপনাকে স্বাগতম জানাবে । একদিন যখন মনে করবেন আপনি পৌঁছে গেছেন , তখনই সব শেষ ।
আমি শিশুর মতো মুখ হাঁড়ি করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
৮
পুলিশটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল । রাস্তাটা একেবারে নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে। তখন বুঝতে পারি—আমি একা নই। আমার ভেতরে যে পুলিশ এতক্ষণ হাসছিল, সেও তো আমি-ই।
কী আশ্চর্য এই জোড়-বিজোড় খেলায় পৃথিবীর সব পথঘাট কেমন করে যেন হারিয়ে গেছে ।
আমার ভেতরে যেটা টিকটিক করে বাজছিল সেটা আর কথা কইছে না এখন । মানে হল আমার আর ভেতরে কোনো সময় নেই । কিন্তু আমার বাইরে যাত্রা চলছেই।
৯
শহরের প্রতিটি রাস্তা আমার দিকে ফিরে ফিরে আসতে থাকে। প্রতিটি দেয়াল ফিসফিস করে কথা বলে । প্রতিটি জানালার ভেতর থেকে কেউ কেউ তাকিয়ে থাকে।
আমি কেবল হাঁটতে থাকি, কেবল দৌড়াতে থাকি, আবার আমি কেবল থেমে যাই।
গন্তব্য নিয়ে ধ্যান ধারণা মুছে যায়। সে সব নিয়ে কোনো মন্তব্য নয় । আমার হাতে থাকা টিকিট কাগজের মতো ভিজে গিয়ে গলে যাচ্ছে । তখন মনে হয়—হয়তো টিকিট কখনও ছিলই না।
১০
শেষ পর্যন্ত বুঝি—গন্তব্য বলে কিছু নেই।
কেবল এক অদৃশ্য ট্রাফিক আছে, যে কেবল জ্যাম করে, যে বারবার আমার হাতঘড়ি নিয়ে নেয়, আবার আমাকেই ফিরিয়ে দেয় সেই একই জায়গায়—যেখানে গোধূলি আর সন্ধ্যা এক হয়ে যায়, আর যাত্রা কেবল নিজেকেই খুঁজে ফেরে ।
==============
Makhanlal pradhan
Sukantapally, boral
Kol-700154
Comments
Post a Comment