অদম্য শিখা
সৌরদীপ অধিকারী
শীতের আমেজ তখন সবেমাত্র জেঁকে বসতে শুরু করেছে। কুয়াশা জড়ানো সকাল, কিন্তু কলেজের করিডোরে তখন অন্যরকম উষ্ণতা। এক নতুন সকাল, এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে অর্ণব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র সে। মেধাবী, কিন্তু বড্ড বেশি জেদি আর অন্তর্মুখী। নিজের জগতে বাস করে, বাইরের পৃথিবীর সাথে মিথস্ক্রিয়া প্রায় শূন্য। তার এই বিচ্ছিন্নতা, তার ভেতরের চাপা অস্থিরতা, সবকিছুই যেন এক বিশাল পাহাড়ের মতো চেপে আছে তার উপর।
"অর্ণব, আবার লেট?"
কর্কশ অথচ স্নেহমাখা সেই কণ্ঠস্বরটা শুনলেই অর্ণব চমকে উঠত। তিনি অধ্যাপক রফিক আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, কিন্তু ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। তাঁর চোখেমুখে লেগে থাকত এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যা অর্ণবের মতো অস্থির মনকেও শান্ত করার ক্ষমতা রাখত।
অর্ণব কিছু না বলে মাথা নিচু করে ক্লাসে ঢুকল। তার এই আচরণে অন্য ছাত্ররা অভ্যস্ত হলেও, অধ্যাপক আহমেদ যেন একটু বিচলিত হলেন। আজকের ক্লাসটা ছিল শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নিয়ে। অর্ণব এই বিষয় নিয়েই গবেষণা করছিল, কিন্তু তার নিজের জীবনেও যেন 'হ্যামলেট'-এর মতোই এক অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল।
"অর্ণব, আজকের আলোচনায় তুমি কিছু বলবে বলে আশা করেছিলাম," অধ্যাপক আহমেদ ক্লাসের মাঝে অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে বললেন। "তোমার গবেষণা কি এগোচ্ছে?"
অর্ণব এবার মুখ তুলল। তার চোখেমুখে এক অদ্ভুত মিশ্রণ – ইতস্তত ভাব, কিছুটা অভিমান, আর অনেকখানি জেদ। "স্যার, আমার মনে হয়, আমরা শুধু সাহিত্যের গভীরে ডুব দিচ্ছি, কিন্তু বাস্তব জীবনের জটিলতা থেকে অনেক দূরে। হ্যামলেটের যন্ত্রণা, তার দ্বিধা, তার প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা – এগুলো সবই কি শুধু চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ?"
অধ্যাপক আহমেদ অর্ণবের কথা শুনে খানিক চুপ করে রইলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, "অর্ণব, সাহিত্য তো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তোমার ভেতরের যে ঝড়, তা কি কেবল তোমার একার? হ্যামলেট কি শুধু ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক চরিত্র? নাকি সে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরের প্রতিচ্ছবি, যার ভেতরেও থাকে সমাজের চাপ, পরিবারের প্রত্যাশা, আর নিজের অস্তিত্বের সংকট?"
এই কথাগুলো অর্ণবের মনে গিয়ে বিঁধল। সে কিছু বলতে পারল না, শুধু মাথা নাড়ল। ক্লাসের পর অধ্যাপক আহমেদ অর্ণবকে তার ঘরে ডেকে নিলেন।
"অর্ণব, তুমি কি কিছু লুকাচ্ছ?" অধ্যাপক আহমেদের প্রশ্নটা ছিল সরাসরি।
অর্ণব এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। তার ভেতরের সব জমাট বাঁধা কষ্ট, সব হতাশা বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এল। "স্যার, আমি আর পারছি না। আমার বাবা-মা চান আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে সাহিত্যের আলোয়। আমি জানি, আমার এই স্বপ্ন পূরণ হলে পরিবার কতটা কষ্ট পাবে, কতটা হতাশ হবে। আমি একদিকে যেমন আমার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, অন্যদিকে পরিবারের মুখে হাসি দেখতে চাই। এই দ্বন্দ্বে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, স্যার।"
অধ্যাপক আহমেদ অর্ণবের কাঁধে হাত রাখলেন। "অর্ণব, এ তো শুধু তোমার একার সমস্যা নয়। আমাদের জীবনে এমন অনেক মোড় আসে, যখন দুটো পথ পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। কোনটা ধরব, কোনটা ছাড়ব – এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভীষণ কঠিন। কিন্তু মনে রেখো, জীবন হলো স্বপ্নের সাঁকো তৈরি করা। তুমি যদি নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দাও, তাহলে সেই সাঁকো আর তৈরি হবে না।"
"কিন্তু স্যার, পরিবারের কী হবে? তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে...?" অর্ণবের গলা ধরে এল।
"তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই তুমি তোমার স্বপ্নকে পূরণ করো। মনে রেখো, তাদের চাওয়াটা আসলে তোমার উন্নতি, তোমার ভালো থাকা। যদি তুমি নিজের পছন্দের পথে হেঁটে সফল হও, তবে তারাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। আর যদি ব্যর্থ হও, তবে তাদের পাশে সবসময় পাবে। কিন্তু স্বপ্ন না দেখলে, তুমি নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকবে।"
এই কথোপকথন অর্ণবের মনে এক নতুন আলো এনে দিল। সে বুঝতে পারল, তার ভেতরের টানাপোড়েন কেবল তার একার নয়, এমনটা অনেকের জীবনেই ঘটে। আর এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হলে, তাকে নিজের ভয়কে জয় করতে হবে।
পরের কয়েকটা মাস অর্ণবের জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এল। সে অধ্যাপক আহমেদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু করল। তার গবেষণামূলক কাজের প্রতি আরও মনোযোগী হলো। শুধু তাই নয়, সে তার পরিবারের সাথেও খোলামেলা আলোচনার চেষ্টা করল। প্রথমদিকে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও, অধ্যাপক আহমেদের দেওয়া সাহস আর নিজের জেদ তাকে এগিয়ে নিয়ে গেল।
একদিন, অর্ণব তার বাবা-মায়ের মুখোমুখি বসল। তার হাতে ছিল তার গবেষণাপত্রের খসড়া, তার সব স্বপ্ন, তার সব আশা। সে বোঝাল কেন সাহিত্য তার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ, কেন এই পথেই সে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তার বাবা-মা প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও, অর্ণবের ভেতরের দৃঢ়তা আর তার কথার মধ্যে থাকা যুক্তির আলোয় তারা ধীরে ধীরে আশ্বস্ত হলেন। তারা বুঝতে পারলেন, তাদের ছেলে শুধু স্বপ্ন দেখছে না, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠান। অর্ণব এবার শুধু একজন ছাত্র নয়, সে একজন বক্তা। তার গবেষণাপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গবেষণাপত্রের শিরোপা পেয়েছে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অর্ণব তার জীবনের এই লড়াইয়ের কথা বলল। তার বাবা-মা, যারা একসময় তার স্বপ্নকে বুঝতে পারছিলেন না, আজ তারা মঞ্চের সামনে বসে গর্বিত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে।
"আজ আমি যা, তা কেবল আমার একার কৃতিত্ব নয়," অর্ণব বলল। "আমার পেছনে ছিলেন আমার বাবা-মা, যারা আমাকে এই পথ চলার সাহস যুগিয়েছেন। আর ছিলেন এমন একজন শিক্ষক, যিনি আমাকে শুধু বইয়ের পাতাই নয়, জীবনের পাঠও শিখিয়েছেন। তিনি হলেন আমাদের প্রিয় অধ্যাপক রফিক আহমেদ।"
অধ্যাপক আহমেদ মঞ্চের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। তার চোখে জল। এই জল আনন্দের, এই জল গর্বের – এক অদম্য শিখার জন্ম হওয়ার জল।
অনুষ্ঠান শেষে, অর্ণব অধ্যাপক আহমেদের কাছে এসে দাঁড়াল। "স্যার, আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না। আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।"
অধ্যাপক আহমেদ অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "অর্ণব, তুমি কোনোদিনও আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না। যখন তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবে, যখন তুমি সমাজের জন্য আলো ছড়াবে, সেটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার। মনে রেখো, তুমি এক অদম্য শিখা। তোমার আলোয় আলোকিত হোক এই বিশ্ব।"
এই ছিল অর্ণবের গল্প। এক সাধারণ ছাত্রের, নিজের ভেতরের জেদ, সংশয় আর স্বপ্নকে জয় করার গল্প। এক শিক্ষক, যিনি শুধু জ্ঞানই দেননি, সহমর্মিতা আর সঠিক পথের দিশাও দেখিয়েছেন। তাদের এই সম্পর্ক, এক নতুন প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল নজির, এক অদম্য প্রেরণার উৎস। এই গল্প প্রমাণ করে, যে কোনো বাধা, যে কোনো সংশয় অতিক্রম করা সম্ভব, যদি পাশে থাকে সঠিক মানুষ আর নিজের ভেতরের অদম্য ইচ্ছেশক্তি। এই প্রেম, এই বিশ্বাস, এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ – এই সবকিছুই মিলে তৈরি করে এক অদম্য শিখা, যা কখনো নেভে না, শুধু উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়।
অর্ণব আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচিত মুখ। তার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে বড় বড় পত্রিকায়, সে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তৃতা দেয়। কিন্তু সে কখনো তার অতীত ভোলেনি। সে জানে, তার এই যাত্রাপথে অধ্যাপক আহমেদের অবদান কতটা। তাই সে নিজেও চেষ্টা করে নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে, তাদের স্বপ্নপূরণে সাহায্য করতে।
একদিন, এক তরুণ ছাত্র অর্ণবের কাছে আসে। তার চোখেমুখেও অর্ণবের প্রথম দিনের মতো সেই দ্বিধা, সেই সংশয়। অর্ণব তাকে দেখে হাসে। সেই হাসিতে থাকে এক পুরনো দিনের স্মৃতি, এক অদম্য শিখার আলো। সে জানে, এই তরুণও একদিন নিজের স্বপ্নকে জয় করবে। কারণ, জীবন মানেই তো নতুন করে শুরু করা, নতুন করে স্বপ্ন দেখা, আর সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখা। আর এই যাত্রাপথে, যদি পাশে পাওয়া যায় একজন সঠিক শিক্ষক, তবে সেই যাত্রাপথ হয়ে ওঠে আরও মসৃণ, আরও আলোকিত।
অদম্য শিখা শুধু অর্ণবের মধ্যেই জ্বলে ওঠেনি, তা ছড়িয়ে পড়েছে আরও অনেক মনে, নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস যুগিয়েছে। এই সম্পর্ক, এই শিক্ষা, এই প্রেরণা – সদা অমলিন, চির উজ্জ্বল চিরন্তন।
===============================
নাম: সৌরদীপ অধিকারী (Souradeep Adhikari)
ঠিকানা: দক্ষিণ কলকাতা ৭০০০৪২, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ
Comments
Post a Comment