স্মৃতির আলোয় শিলিগুড়ি স্টেট লেবার ইন্সটিটিউট
চন্দন দাশগুপ্ত সালটা ছিল ২০০৫। বদলীর অর্ডারটা পেতেই মন ভাল হয়ে গেল। গত তিনবছর আমি জলপাইগুড়ি জেলার শ্রমদপ্তরের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলাম। এবার আমাকে বদলী করা হয়েছে শিলিগুড়ির স্টেট লেবার ইন্সটিটিউটের ডেপুটি ডিরেক্টরের পদে। আমার বাড়িও শিলিগুড়িতে। সুতরাং আরো ভাল করে কাজ করা যাবে।
এই স্টেট লেবার ইন্সটিটিউট ( সংক্ষেপে এস.এল.আই ) ১৯৫৪ সালে কলকাতায় কাঁকুরগাছিতে স্থাপিত হয়। ১৯৯৫ সালে এর একটি শাখা খোলা হয় শিলিগুড়িতে। প্রথমে কলেজ পাড়ার ভাড়া বাড়িতে থাকলেও ১৯৯৮ সালে এটি চলে আসে শিলিগুড়ির উপকন্ঠে দাগাপুর চা বাগানের পাশে, পশ্চিমবঙ্গ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের গাছপালা ঘেরা অনবদ্য প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত নিজস্ব বাড়িতে। এটি মূলতঃ একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে বছরের বিভিন্ন সময়ে শ্রম দপ্তরের আধিকারিক, পরিদর্শক এবং অন্যান্য কর্মীদের বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাছাড়া এখানে অত্যন্ত সুলভে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড লেবার ওয়েলফেয়ারের একটি এক বছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স পড়ানো হয়। এসএলআইয়ের শিলিগুড়ি শাখায় এই কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের জন্য আসনসংখ্যা ২৫ টি, আর স্পনসর্ডদের জন্য আসনসংখ্যা ৫ টি। এছাড়াও সরকারী আধিকারিকদের জন্য আছে ৫ টি আসন।
এসএলআই-তে যোগ দেবার পর কিভাবে যে সাড়ে পাঁচ বছর চলে গিয়েছিল, তা বুঝতেই পারিনি। এখানকার লাইব্রেরিয়ান ছিলেন জয়দেব ঢালি। সত্যি বলতে কি, ইনিই ছিলেন এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মেরুদন্ড। কোথায় কি কাগজপত্র আছে, কখন কি কাজ করতে হবে, কোন্ গেস্ট ফ্যাকাল্টিকে কখন ক্লাস নেবার জন্য ডাকতে হবে, সব ছিল তাঁর নখদর্পণে। আর ছাত্রছাত্রীদের উনি যেমন ভালবাসতেন, তেমনই তাদের কড়া শাসনে রাখতেন। কোনও কারণে ক্লাস অফ থাকলেই তিনি সব ছাত্রছাত্রীদের লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করতে একরকম বাধ্য করতেন। হুটহাট বাইরে যাওয়া, আড্ডা মারা একদম বরদাস্ত করতেন না। ক্লাসে কেউ বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকলেই তার অভিভাবক-কে ফোনে জানিয়ে দিতেন।
অল্প দিনের মধ্যেই আমি কাজকর্ম বুঝে নিলাম। যখনই কোনও ফ্যাকাল্টি না আসায় ক্লাস অফ হয়ে যেত, তখনই আমি নিজে ক্লাস নিতে শুরু করে দিতাম। ফলে ছাত্রছাত্রীদের ফাঁকি মারা অসম্ভব হয়ে উঠল। একদিন শুনলাম ঢালিবাবু ছাত্রছাত্রীদের বলছেন,
------শোনো, তোমরা কলেজে এক বছরে কত নম্বরের পরীক্ষা দিয়েছ ? বড়জোর ছশো ! এখানে দুটো ছমাসের সেমিস্টার মিলিয়ে এক বছরে মোট ষোলশো নম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে। সুতরাং খাচ্চু-দাচ্চু-ঘুরুচ্চু-পড়াশোনা করুচ্চু না--ফেল করুচ্চু- বোঝেজ্ঞা !"
ছেলেমেয়েরা যাতে বাড়িতে গিয়েও পড়াশোনা করে, সেজন্য আমি প্রতিদিন আট দশ পাতার প্রশ্ন উত্তর বাড়ি থেকে লিখে আনতে দিতাম। সেটা যারা পারত না, বোঝা যেত বাড়িতে সে বই নিয়ে বসেই নি ! কিছুদিন পর দেখা গেল এক এক জন কুড়ি পঁচিশ পাতা লিখে আনছে, ওদের মধ্যেই পড়াশোনা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে প্রতিযোগিতা !
আমাকে একটি ছেলে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল,
-----স্যার, আমাদের ওপর এত মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছেন কেন ?
আমি তাকে বলেছিলাম,
-----এখন যদি এই চাপটা নিতে না পারো, তাহলে যখন চাকরী করবে, তখন তোমার বস এমন চাপ দিলে কি চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারবে ?
প্রায় বারো বছর পর সেই ছেলেটি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ হয়েছিল। একদিন আমাকে সে ফোনে জানায়,
------স্যার, এসএলআইতে আপনারা যে মারাত্মক রগড়ানিটা দিয়েছিলেন, সেটা সামলানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে আজ এই চাকরিটা করতেই পারতাম না !
আরেকটি ঘটনা। একটি ছেলে কিছুতেই তার প্রজেক্ট ওয়ার্কে বার-চার্ট আর পাই-চার্ট বার বার বুঝিয়ে দেবার পরেও ঠিকমতো তৈরি করতে পারছিল না। আমার মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল, আমি ওর খাতাপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। দুদিন পর ছেলেটি এসে আবার ওর খাতা দেখাল, দেখলাম এবার সে পেরেছে। যাইহোক কয়েক বছর পর সে একদিন আমাকে ফোনে এক অদ্ভুত ঘটনা জানাল। সে তখন গুডরিকের একটি চা বাগানের ওয়েলফেয়ার অফিসার। একদিন হেড অফিস থেকে বড় সাহেবরা ওদের চা বাগানে এসেছেন। বাগানের ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক নিয়ে আলোচনার সময় যে রিপোর্ট ছেলেটি পেশ করেছিল, তাতে আমার শেখানো পদ্ধতিতেই বার চার্ট আর পাই চার্টের সাহায্যে পুরো ডেভেলপমেন্ট প্রসেসটা ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। সেটি দেখে বড় সাহেবরা এত খুশি হন যে, ছেলেটির বেতন বৃদ্ধির এবং প্রমোশনের আদেশ দেন। ছেলেটি আমাকে বলেছিল,
-----স্যার, আপনি সেদিন আমার খাতাগুলো ছুঁড়ে না ফেললে আমি কোনোদিন বারচার্ট আর পাইচার্ট বানাতে শিখতাম না, আর এত তাড়াতাড়ি আমার প্রমোশনও হতো না।
এই প্রজেক্ট ওয়ার্ক করার সময়েও আমি ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর খাটাতাম। নানা পরামর্শ দিয়ে তাদের প্রজেক্টের মান ভাল করতে উৎসাহিত করতাম। প্রত্যেক বছরেই অন্তত দশটি এমন উচ্চ মানের প্রজেক্ট তৈরি হত যা গবেষণা থিসিসের কাছাকাছি। তাই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ-র ছাত্ররাও সেইসব প্রজেক্ট দেখতে আসত।
এসএলআইতে প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীরা বিরাট করে টিচার্স ডে পালন করত। সেদিন তারা পুরো স্বাধীন, ক্লাসরুম সাজানো হত, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত অফুরন্ত গান-বাজনা-আবৃত্তি- আড্ডা, আর অবশ্যই ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া।
এসএলআইতে পড়াতে আসতেন বহু গণ্যমান্য অধ্যাপক আর প্রশাসনিক কর্তা। এই ছোট্ট স্মৃতিকথায় সকলের কথা বলা অসম্ভব। তবুও ডঃ এস এস চৌধুরী ( সেন্ট্রাল বোর্ড ফর ওয়ার্কার্স এডুকেশনের অবসরপ্রাপ্ত রিজিওনাল ডিরেক্টর ), শ্রী অনন্ত কুমার করণ ( অবসরপ্রাপ্ত জয়েন্ট লেবার কমিশনার, শ্রম দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ), ডঃ শুভাশিস মিত্র ( বাগডোগরার কালীপদ ঘোষ তরাই মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল ), ডঃ অনিল ভূঁইমালি ( উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রধান অধ্যাপক ), ডঃ দেবাশিস বিশ্বাস ( জ্ঞান জ্যোতি কলেজের অধ্যাপক ) প্রমুখের নাম উল্লেখ করতেই হবে। আমি ভাগ্যবান যে, এইসব দিকপাল ছাত্র দরদী পন্ডিত মানুষের সান্নিধ্যে কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ সাড়ে পাঁচ বছর কাটাতে পেরেছিলাম।
চাকরীর নিয়মেই এসএলআই ছেড়ে ২০১১ সালে অন্য অফিসে বদলী হয়েছিলাম। কিন্তু আমার হাতে তৈরি ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশের সাথেই প্রায় দুই দশক পরেও আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়ে গেছে। তারা এখন প্রত্যেকেই যে যার কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের অজস্র নামজাদা সংস্থায় তারা যথেষ্ট যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। জাপান, কানাডা, নিউজিল্যান্ড সহ বিদেশেও আছে বেশ কয়েকজন। একটি আদিবাসী মেয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক আধিকারিক হিসেবে কাজ করছে। একটি ছেলে আছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের উচ্চ পদে। দার্জিলিঙ পাহাড়ের প্রত্যন্ত বাদামতাম চা বাগানের একটি নেপালী মেয়ে এখন স্টেট ব্যাঙ্কের আধিকারিকের দায়িত্ব সামলাচ্ছে। আমার কিছু ব্যাঙ্কিং সমস্যার কথা জানার দশ মিনিটের মধ্যেই সে সুষ্ঠু সমাধান করে দিয়েছিল। ডিপিএল, ডব্লুবিএসিডিসিএল, সিইএসসি, বিএসএনএল, আল্ট্রাটেক সিমেন্ট সহ ভারতের বহু নামকরা সংস্থায় উচ্চপদে কাজ করছে এসএলআইয়ের ছাত্রছাত্রীরা। জুট, টুরিজম আর অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতেও আছে বেশ কয়েকজন। বিভিন্ন কলেজ এবং স্কুলেও শিক্ষকতায় নিযুক্ত আছে আমার জনা দশেক ছাত্রছাত্রী। আর উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রত্যেকটি চা বাগানেই স্টেট লেবার ইন্সটিটিউটের ছাত্রেরা ওয়েলফেয়ার অফিসার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বা ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে।
অবসর গ্রহণের পরেও, শিলিগুড়িতে গেলেই আমি এসএলআই-তে যাই। ক্লাস নিই। ছাত্রছাত্রীদের সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা করি, তাদেরকে মোটিভেট করি। সুদীর্ঘ কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ সাড়ে পাঁচ বছর এখানে কাটাতে পেরেছি বলে আমি গর্বিত।
=================
চন্দন দাশগুপ্ত
অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডিশনাল লেবার কমিশনার,
শ্রম কমিশনারেট,
পশ্চিমবঙ্গ সরকার,
রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা---৭০০ ০৯২
Sir, your topic took me back to 2006 with all sweet memories. ❤️.
ReplyDelete