শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন
যুগে যুগে শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন কিভাবে হয়ে চলেছে তাই নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রাচীনকালে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল গুরু – শিষ্যকেন্দ্রিক। তখন একজন মানুষের জীবন চারটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। এই চারটি পর্যায়কে একত্রে চতুরাশ্রম বলা হত। এর প্রথম পর্ব ছিল ব্রহ্মচর্য, এই পর্বে মানুষ গুরুগৃহে যাত্রা করতো। সেখানে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতো ও শিক্ষালাভ করতো। জীবনের শুরুর দিকের অনেকগুলো বছরই তারা গুরুগৃহে কাটাতো।
সমস্তরকম শিক্ষালাভ করে তারা নিজগৃহে ফিরে আসতো ও জীবনের পরবর্তী পর্যায়, গার্হস্থ্য পর্যায়ে প্রবেশ করতো। তখন গুরুর বচনকেই বেদবাক্য মনে করা হতো। গুরুদক্ষিণা দেওয়ারও প্রচলন ছিল। তবে গুরুদক্ষিণা দিতে হতো শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হওয়ার পর। আবার মহাভারতে একলব্যের কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি, গুরু নিজে সশরীরে শিক্ষাদান না করলেও, শুধুমাত্র মন থেকে গুরুর আসনে স্থান দেওয়ার জন্যও গুরুদক্ষিণা দিতে হত। সেই গুরুদক্ষিণা নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে গুরুর চরণে নিবেদন করে দেওয়ার মতো কঠিনও হতো।
যাইহোক, আদিযুগে এইরূপ শিক্ষাব্যবস্থা থাকলেও পরবর্তীতে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরবর্তীতে গ্রামে গ্রামে পাঠশালার প্রবর্তন হল। গুরুগৃহে আর কেউ আশ্রয় নেয় না, গ্রামের কোন এক বড় বৃক্ষের নীচে ছায়ায় বসে গুরুমশাই শিক্ষাদান করেন, ছাত্ররা তাঁর চারপাশে বসে শিক্ষালাভ করে। আস্তে আস্তে শহর গড়ে উঠতে লাগল। শহরে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে লাগল। পাঠশালায় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী অবধি পড়াশোনা করা যেতো। তারপর আরও পড়তে চাইলে শহরে এসে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হতো।
তখন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ভারতীয় ও ব্রিটিশ উভয় শিক্ষকরাই পড়াতেন। কিন্তু শিক্ষকদের ছাত্ররা সমানভাবে শ্রদ্ধা করতো। ধীরে ধীরে একজন – দুজন করে মেয়েরাও শিক্ষালাভ করতে আসতে লাগল। তবে কিছু কিছু ব্রিটিশ শিক্ষক ভারতবর্ষকে নিয়ে অসম্মানজনক কথা বললে ছাত্ররা অবশ্যই তার প্রতিবাদ করতো। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুই ছাত্রাবস্থায় তাঁর শিক্ষক ওটেন সাহেবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে যদিও ওটেন সাহেব নেতাজীর বিতর্কিত মৃত্যুতে কবিতা লিখে শোকজ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারত ও বাংলাপ্রেমী।
সেই যুগেও বিভিন্ন কলেজে জাতিভেদ ছিল। যে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত, তার সূচনা হয়েছিল হিন্দু কলেজ হিসেবে ১৮১৭ সালে, শুধুমাত্র হিন্দু ছাত্ররাই এই কলেজে পড়ার সুযোগ পেতো। সেই যুগে কিছু বিখ্যাত ব্রিটিশ যেমন – ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ, ভারতীয় বিখ্যাত ব্যক্তি – রাজা রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এঁদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বহু বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেগুলি আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এছাড়াও আমরা হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর কথা বলতে পারি যিনি তাঁর স্বল্পায়ুতেই ছাত্রদের মনে গভীর ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে ভারতে এমনকিছু শিক্ষক এসেছেন যাঁরা নিজ নিজ কাজের জন্য চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। এই প্রসঙ্গে আমরা মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা বলতে পারি। পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও তিনি শিখিয়েছিলেন দেশকে ভালবাসতে, দেশ স্বাধীন হওয়া না পর্যন্ত হার না মানতে। ডক্টর সর্বোপল্লী রাধাকৃষ্ণন তো ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেও তাঁর শিক্ষাদানের জন্যই স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর জন্মদিনটিকেই তো আমরা ভারতীয়রা শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করি। ভারতের অপর রাষ্ট্রপতি ডক্টর এপিজে আব্দুল কালামও পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে জীবনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
এবার আসি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায়। কয়েকবছর আগেও শিক্ষকরা শিক্ষাদান করতেন, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পেতেন। তখন শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রত্যেকের প্রতি মনোযোগ দিতেন। ছাত্ররাও শিক্ষকদের পিতামাতার পরেই স্থান দিতো। কিন্তু আস্তে আস্তে সময় বদলায়। বহু শিক্ষক বিদ্যালয়ে পড়ানোটা রোজগারের পথ হিসেবে দেখে আর বাইরে গৃহশিক্ষকতা করে উপরি রোজগার করে। এমনকি যে ছাত্র তাঁর কাছ থেকে গৃহশিক্ষকতা নেবে, সে-ই বিদ্যালয়ে বেশি নম্বর পাবে।
ছাত্ররাও আর শিক্ষকদের সম্মান করে না। মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা, তাদের ঘিরে বিক্ষোভ করা আজকাল সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। ছাত্র – শিক্ষকের যে পবিত্র সম্পর্ক তা আর আজকাল খুব বেশি দেখা যায় না। টাকা দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি পাচ্ছে মানুষ, তাই যেনতেন প্রকারেণ পড়িয়ে মাসে মাইনে পেলেই শিক্ষক খুশি। আর ছাত্র মনে করছে, আমি টাকা দিয়ে পড়ছি, নম্বর পাওয়া আমার প্রাপ্য।
তবে এখনও অল্প হলেও কিছু শিক্ষক আছেন যাঁরা ছাত্রদের পড়ানোর জন্য কষ্ট স্বীকার করছেন। কেউ অসুস্থ অবস্থায় হুইলচেয়ারে আসছেন দূরদূরান্ত থেকে, কেউ একাই বিদ্যালয়ের সব শ্রেণীকে সব বিষয় পড়াচ্ছেন শিক্ষকের অভাবে, কেউ আবার অবসর গ্রহণের পরও বিদ্যালয়ে আসছেন বিনামূল্যে শিক্ষকতা করতে শিক্ষকের অভাবে। এঁদের কাছে ছাত্ররাও তাই ঋণী। এই ছাত্ররা এঁনাদের মাথায় করে রাখে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গত কয়েকবছরে শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোটারই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন মানুষ বিদ্যালয়ের থেকে বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষালাভ করছে। মুঠোফোনের মাধ্যমে গোটা দুনিয়াকে মুঠোবন্দি করতে পারছে। আর বিদ্যালয়ে যা শিখেছি তা তো প্রাথমিক, দৈনন্দিন জীবনে যা শিখছি প্রতিনিয়ত, সেটাই আসল শিক্ষা তা সে যার কারুর থেকেই শিখি না কেন। তারজন্য কাউকে আলাদা করে শিক্ষক হতে হয় না। আমরা সবাই কারুর না কারুর শিক্ষক আবার শিক্ষয়িত্রীও। পুঁথিগত শিক্ষায় আমরা জীবনের চারআনা শিখি, বাকী বারোআনা শিখি জীবনে চলার পথে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়ে।
===============
চন্দ্রমা মুখার্জী
চন্দ্রমা মুখার্জী
Comments
Post a Comment