বস্তু, চেতনা এবং কবি
সজল চক্রবর্তী
"যেখানে পৌঁছায় না রবি,,
সেখানে পৌঁছে যান কবি।"
এই ছোট্ট কবিতা টি অনেক পুরনো
এবং বহু পরিচিত, তথাপি এর তাৎপর্য এখনো হারায় নি।
তবে, কথা হ'চ্ছে -আমরা তো
রবি-কবিকে একত্রেই পেয়ে যাই আমাদের ঋষি-প্রতিম কবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। আর তখনই জেনে যাই উপরোক্ত ছোট কবিতার প্রণিধানযোগ্যতা ।
... এবার শুনে নেয়া যাক,
ঋষি-প্রতিম কবির মুখ নিঃসৃত বাণী:-
"তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি যাই ...."
অর্থাৎ আমাদের প্রিয়তম কবি অনায়াসে পৌঁছে যান সৃষ্টির অসীমে ,
যা আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
এখানে কবির চেতনা সুদূর প্রসারী!
... প্রকৃত প্রস্তাবে কবি অতিন্দ্রীয় জগতের এক নাগরিক। তাঁর কাছে তাই চেতনা বা চৈতন্যেরই প্রাধান্য।
...এখন আসছি, বস্তু এবং চেতনার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে।
... আমি একজন অতি সাধারন মানুষ, তাই এই ব্যাপারটাকে কবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা ক'রছি।
তবে আমার সামান্য জ্ঞান থেকে একটা সাধারণ কথা সেরে নি'।
আমরা সাধারণত ব'লে থাকি--
সূর্য পূর্বদিকে ওঠে। প্রকৃত অর্থে কি তাই ?
আসলে সূর্য যেদিকে ওঠে ,আমরা
সেই দিকটাকে নামাঙ্কিত ক'রেছি পূর্ব দিক।তারপর ব'লতে শুরু ক'রেছি
সূর্য পূর্বদিকে ওঠে।
অর্থাৎ দিককে নামাঙ্কিত ক'রেছে
আমাদের চেতনা। শুধু দিক-ই নয় সব কিছুই নামাঙ্কিত করে আমাদের চেতনা।
আর আমাদের চেতনার দরুণ-ই,
বস্তু আকৃতি পায়,পায় রঙ, আরও
কত কিছুই না পায় !
অনেকে ব'লতেই পারেন--
বস্তুটি ছিল ব'লেই চেতনার উন্মেষ/উদ্ভব হ'য়েছে !তা কিন্তু নয়!
কোনো পাগল (চেতনাহীন বা মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন)কি বলতে পারবে পান্না কিংবা
চুণীর রঙ ।তা মোটেই পারবেনা! অর্থাৎ চেতনাই এখানে প্রধান, বস্তু মোটেও নয়।
বস্তুর থেকে চেতনার উন্মেষ/উদ্ভব হয়না, বরং চেতনার থেকেই বস্তুর
উদ্ভব হয়।
তাই গ্রাহাম বেল আবিষ্কার (Invention অর্থে) করেন টেলিফোন,
টমাস আলভা এডিসন আবিষ্কার করেন বৈদ্যুতিক বাতি,আর
Television আবিষ্কার ক'রে চমক
লাগিয়ে দেন J.L.Baird.
আবিষ্কারের পূর্বে তো এই
বস্তুগুলোর কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
অর্থাৎ চেতনাই বস্তুকে আমাদের সামনে এনে হাজির ক'রেছে !
... এবার আমরা দেখবো, আমাদের
কবিদের মধ্যে বস্তু ও চেতনা কীভাবে ধরা দিয়েছে। অর্থাৎ বস্তুই চেতনার জন্ম দিয়েছে , নাকি চেতনাই প্রধান হ'য়ে বস্তুকে চিনতে-বুঝতে সাহায্য ক'রেছে ?
...তার মানে, আমরা খুব সহজে জানতে চাইবো যে --বস্তুই প্রধান,না চেতনা প্রধান ?
...কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'আমি'
কবিতায় লিখছেন:
"আমারই চেতনার রঙে পান্না হ'লো সবুজ,
চুণী উঠলো রাঙা হ'য়ে
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো
পূবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম 'সুন্দর'
সুন্দর হ'লো সে ।"
... অর্থাৎ কবির(বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে --আমাদের) চেতনার জন্যই পান্না এবং চূণী' তে রং আরোপিত হ'লো ! গোলাপে আরোপিত হ'লো সৌন্দর্য ! কিংবা
পূব-পশ্চিমে জ্বালালো আলো।
অর্থাৎ চেতনাই প্রধান হ'য়ে উঠলো কি না ?
... এবার দেখা যাক, কবি সুকান্ত কী
লিখেছেন তাঁর 'হে,মহাজীবন কবিতা'য়:--
"ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।"
এখানেও সেই চেতনার প্রভাব,মোটেও বস্তু'টির(অর্থাৎ চাঁদের)নয় !
নতুবা "পূর্ণিমার চাঁদ" কীভাবে ঝলসানো রুটি হ'য়ে যায় ?
... এবার আমি আসি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা 'বনলতা সেন'-এ।এই কবিতার একটি বিখ্যাত পংক্তি যা, তখন কার দিনে কেন, এখনও সবার মুখে-মুখে ফেরে:--
".... চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,..."
অর্থাৎ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য হ'য়ে ওঠে কবি-চেতনার সৌজন্যেই। এবং কোনো দ্বিধাই থাকে না আমাদের এ-কথা স্বীকার ক'রে নিতে।
নতুবা মুখ তো মুখ-ই !
এবার আসছি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি অতি পরিচিত
এবং জনপ্রিয় কবিতা "ফুল ফুটুক
না ফুটুক"-এ,যা (১৯)৭০-এর দশকে
জনগণের মুখে মুখে ফিরতো !
এই কবিতায় কবি লিখছেন:
"ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।"
অর্থাৎ চেতনায় বসন্তের উপস্থিতি
বস্তু কে --এখানে ফুল কে-- প্রাধান্য
বা মান্যতাই দ্যায় না।
মার্ক্সবাদে দীক্ষিত কবিও বস্তু কে প্রাধান্য না-দিয়ে, চেতনা কে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের নজর কেড়ে নেন, আমাদের চৈতন্যের দরজায় কড়া
নাড়েন!
.... এখন দেখা যাক, সৌন্দর্যের
সংজ্ঞা নিরূপণে জার্মান দার্শনিক
Immanuel Kant কী যুক্তি উপস্থাপন ক'রেছেন ?
Kant ব'লছেন :--
"Beauty is equivalent neither to utility nor perfection,but is still
purposive.Beauty* in nature, then, will appear as purposive with respect to our
faculty of judgement*, but it's beauty will have no ......"
এখানে Beauty..... with respect to our faculty of judgement ই
বুঝিয়ে দ্যায়,
সৌন্দর্য নিরূপণে-ও চেতনাই প্রধান।
আইরিশ ঔপন্যাসিক Margaret Wolfe Hungerford -এর একটি
প্রবাদ প্রতিম বাক্য:
Beauty lies in the eyes of the beholder,
আমাদের স্মরণে এনে দ্যায় যে
সৌন্দর্য নির্ধারণে দর্শক অর্থাৎ দর্শকের চোখ,অপ্রত্যক্ষে চেতনাই প্রধান, বস্তু টি--
যা নিরিক্ষণ করা হ'চ্ছ--নয় ।
অবশেষে এটাই প্রতীয়মান হয় যে,
আমাদের ঋষি-কবিও সেই একই কথা বলেছেন:
"গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম 'সুন্দর'
সুন্দর হ'লো সে।"
এবার চিলির কবি পাবলো নেরুদা'র
একটা বিখ্যাত উদ্ধৃতি উল্লেখ ক'রছি:
"You can cut all the flowers but
you can not keep spring from
coming."
অর্থাৎ, সব ফুল কেটে দিলেও
বসন্তকে আটকাতে পারবে না কেউ ।
অর্থাৎ এখানেও সেই চেতনার-ই প্রাধান্য!
এ যেন একটু ঘুরিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের-ই কথা!
অর্থাৎ আমরা নির্দ্বিধায় ব'লতেই পারি, এই পার্থিব জগতে চেতনার-ই
প্রাধান্য --বস্তু'র নয় !
===============
সজল চক্রবর্তী,
৩-কে, নস্কর পাড়া লেন,
পোঃ ঢাকুরিয়া ,
কোলকাতা -৭০০০৩১

Comments
Post a Comment