( সপ্তম পর্ব )
দীপক পাল
আর একদিন আমি একটা ফাইল দিতে বললাম পবনকে। ফাইলটা এনে টেবিলে রেখে চেয়ারটা টেনে এনে বসলো আমার সামনে। ত্রিহান বুঝতে পারে কোন আজগুবি কথা নিশ্চয় ওর পেটে জমিয়ে রেখেছে বলার জন্য। ওর মতো এত নীরব শ্রোতা কোথায় পাবে। ত্রিহান ওর দিকে না তাকিয়ে ফাইল খুলে আপন মনে কাজে মন দিল। পবন কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চেম্বারে বেলের শব্দে চেয়ার থেকে উঠে খুবদ্রুততায় চেম্বারে ঢুকলো। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আবার এসে বসলো চেয়ার টেনে ত্রিহানের সামনে। এবার ত্রিহান জিগ্গেস করলো,- ' পবন কিছু বলবে আমাকে?'
- ' আপনিতো খুব ব্যাস্ত দেখছি, ফাইল থেকে মাথাই তোলেন না।'
- ' ব্যাস্তাতাই তো আমার কাজ। তার ফাঁকে ফাঁকে একটু গল্প করলে কিন্তু মন্দ হয় না কি বলো। তাতে কাজের এক ঘেয়েমিটা একটু কাটে। এই যে তুমি কি যেন একটা আমাকে বলতে চাও সেটা বলে ফেল একটু শুনি।' পবন খুব উৎসাহে শুরু করলো।
- ' জানেন গত শনিবার আমি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছি, কয়েকজন চেনা বয়স্ক লোক আমাকে এসে বলে পবন একটা কাজ করে দিতে পারবে? ঐ বয়স্ক লোকেরা রোজ মর্নিং ওয়াক করে আমি অনিমিয়ত। তা বললো, 'জান পবন ঘোষেদের বাগানের মধ্যে একেবারে পাঁচিলের ধারে কয়েকটা নারকেল গাছে বেশ কিছু ভাল নারকেল ঝুলছে বুঝলে। তুমি খালি আমাদের জন্য কয়েকটা নারকেল পেড়ে দাও। তুমিইএকমাত্র পারবে আমাদের আব্দার মেটাতে। আমরাতো এই বয়সে গাছে উঠতেই পারবো না তাই তোমার শরণাপন্ন হলাম। কি পবন পারবেনা? আরে তুমিও নেবে।'
আমি তখন বললাম ' এমনি এমনি কি গাছে ওঠা যায়। পায়ের শক্ত দড়ি লাগে, খুব ধার দাঁ লাগে, ওপোরে উঠে নিজেকে গাছে বাঁধার কাপড় লাগে এরও পরে নিচে ধরার লোক লাগে যাতে মাটিতে নারকেল পড়ার শব্দ না হয়। সবচেয়ে যেটা অতি প্রোয়জন সেটা হচ্ছে আপনাদের সাহস। ঘোষেরা টের পেয়ে বেরিয়ে এলে একজনও পালাতে পারবেন না। আপনারা পালাতে পারলেও আমিতো পালাতে পারবো না। আমাকে তখন ওরা মেরে হাত পা ভেঙে দেবে। আপনারা বলবেন আমরাই ওকে জোর করায় ও উঠেছে, ওর কোন দোষ নেই, দোষ আমাদের।
এদিকে ওরা আগে থেকেই সবকিছু জোগাড় করে রেখেছিল প্রায় তিনদিন । খালি আমি কবে ভোরে বের হবো। তাই পটাপট আমি যা যা লাগবে বলেছি সেগুলো নিমেষে এনে হাজির করলো। আমি আরো ভাবলাম আমার দেওয়া এত শর্ত শুনে ওরা পিছিয়ে পড়বে কিন্তু তাতো না। অগত্যা আমি প্রস্তুত হয়ে
নেমে পড়লাম কাজে। ভাবলাম এনারা আমাকে এতো ভালোবাসে ঠিক আছে। জামা খুলে ভেতরে একটা চাপা প্যান্ট থাকায় ওপরের প্যান্টাও খুলে ফেলে একজনের হাতে দিয়ে পাঁচিল টপকে গাছে চড়লাম। তাড়াতাড়ি কয়েকটা নারকেল কেটে ফেললাম নিচে। ওনাদেরই দুটো ছেলে এসে চাদর ধরেছিলো নিচে। তারপর জামা প্যান্ট পরে বাড়ী ফিরে এলাম। ওরা সবাই খুব পীড়াপিড়ি করছিল, সেকি তুমি আমাদের জন্য এত কষ্ট করে নারকেল পাড়লে একটা অন্তত নাও, কিন্তু আমি নেইনি।' ত্রিহান খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলে, - ' সত্যিই তো তুমি একটাও নিলেনা কেন, কি ব্যাপার?'
- ' হুঁ হুঁ তার কারণটা এইবার শুনুন। ঘন্টা খানেক পরেই ঘোষেদের বাড়ী থোকে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। বউকে বললাম, আমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ছি কেউ আসলে বলবে আমার খুব জ্বর উঠতে পারছি না বিছানা থেকে।'
- ' কি ব্যাপার বলতো। হঠাৎ করে কারা তোমার কাছে আসবে? কেন আসবে?'
মিনুর কথা শেষ হতে না হতেই বাইরে থেকে কাদের যেন ডাক শোনা গেল ' পবন এই পবন একবার বেরিয়ে আয়। তোর সাথে কথা আছে, তাড়াতাড়ি।'
পবন গরম চাদর নিয়ে আগেই খাটে উঠে পড়েছিল। এইবার গায়ে দিয়ে শুয়ে পরলো। বউকে বললো , ' যাও একটু ম্যানেজ করে বলো।' মিনু দোরে গিয়ে বলে, - ' ওতো কালকে তাড়াতাড়ি খুব জ্বর নিয়ে বাড়ী ফিরে এসেই শুয়ে পড়লো।
কপালে হাত দিয়ে দেখি খুব জ্বর। আসার পথে চারটে ক্রোসিন কিনে এনেছিল ওষুধের দোকান থেকে , তার মধ্যে একটা খেয়ে শুয়ে পড়লো । আমি চা বানিয়ে দিলাম। সেটা খেয়ে টানা ঘুমালো অনেকক্ষণ।'
কথার মাঝে স্বয়ং ঘোষবাবু মিনুকে থামিয়ে দিয়ে রাগত স্বরে বললো,
- ' জ্বরই যদি হয় তাহলে ভোরবেলা আমার বাগান থেকে আনাড়ীর মতো কোপ মেরে নারকেল কাটলো কে? ও ছাড়া এখানে কেউ নারকেল গাছে উঠতে পারে না। আগেই তার প্রমান পেয়েছি আমি।' তিনি তার দুই ছেলেকে বললেন,
- ' যাতো তোরা ভেতরে ঢুকে দেখে আয় ভেতরে কোন নারকেল আছে কিনা। যে কটা দেখতে পাবি নিয়ে আসবি তারপর কত ধানে কত চাল ওকে দেখাব।'
- ' ঠিক আছে দেখুন আঁতিপাতি করে খুঁজে ঘরে বা কোথাও যদি কোনো নারকেল পান কিনা।' ঘোষবাবুর দুই ছেলে ঘরে ঢুকে আমাকে চাদর গায়ে শুয়ে থাকতে দেখে একজন বললো, ' কিরে কাজ হাসিল করে এখন তুই ঘুমোবার ভান করছিস।' আমি চাদর সরিয়ে খুব শরীর খারাপ লাগছে এমন ভান করে বললাম, ' আপনারা আমার বাড়ীতে এই সাত সকালে কি ব্যাপার?'
- ' দাঁড়াও তোমার ঘর থেকে নারকেলগুলো নিতে এসেছি। তুমি শুয়ে থাক।'
- ' কাল বিকালে আর রাতে দুটো ক্রোসিন খেয়ে বেহুঁশের মতো ঘুমিয়ে এই উঠলাম। আর আমি কিনা নারকেল চুরি করেছি। ঠিক আছে খুব ভাল করে দেখেন যদি পান।'
তারপর ত্রিহানদা কোথায় না খুঁজলো। খাটের তলা রান্নাঘরে ঢুকে চালের ড্রাম মুড়ির টিন এছাড়া বাথরুম কলতলা, গিন্নী আলমারী পর্য্যন্ত খুলে দেখিয়েছে। তারপর হতাশ হয়ে ফিরে গেল সবাই। যাবার সময় বলে গেল, ' নারকেল পেলাম না বটে তবে আমরা নিশ্চিত যে এটা তোরই কাজ।'
সব শুনে ত্রিহান বললো, ' চমৎকার তোমার বুদ্ধি ও অভিনয়। দারুন বটে। আচ্ছা পবন এবার একটু কাজ করতে চাই।।' পবন চেয়ার থেকে উঠে বলে,
- ' হ্যাঁ আপনি কাজ করেন আমি ওদিকে যাই।' ত্রিহানের ঠোঁটে হাসি ফুটল। ত্রিহান ফ্ল্যাটে ফিরে দরজার বেল বাজালো। আহির দরজার ওপার থেকে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে আর চেঁচিয়ে বলছে, 'মা দরজা খোল তাড়াতাড়ি।'
দরজা খুলে ইমন জিগ্গেস করলো, ' কি ব্যাপার বাজার কি অনেক দুরে?'
- ' না সেরকম দুরে নয়। বাজারে অফিসের দুজন খুব চেনা লোকের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাদের বাড়ী বাজার ছাপিয়ে আর একটু দুরে। আমি আগে যে ডিপার্টমেন্টে ছিলাম তারা ঐ ডিপার্টমেন্টে ঐ দুজন কাজ করে হেল্পার হিসাবে। খুব ইন্টারেস্টিং ওরা।'
- 'তাই নাকি, কিরকম?' বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে যেতেযেতে ত্রিহান বলে, - ' আজ বিকেল পাচটায় ওদের আসার কথা আছে, ওরা আসলে তুমি বুঝতে পারবে।' দরজা দিয়ে এসে ইমন বললো, ' ওমা তাই নাকি খুব ভাল কথাতো। '
ত্রিহান একটা পাত্র নিয়ে তার মধ্যে মাংস রেখে বাছতে বাছতে বলল, - ' আজ আমি আহির সোনার জন্য মাংস এনেছি। দুপুরে আহিরের সাথে একসাথে বসে মজা করে মাংস খাব আমরা। তাইনা আহির?'
আহির মাদুরে বসে আপন মনে খেলছে, দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে বাবার কোমর ধরে পাত্রের দিকে তাকিয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলতে লাগলো, ' কি মজা মাংস হবে মাংস হবে।' তারপর মাদুরে বসে পুতুল খেলতে খেলতে বলছে, ' জানিস আজ খুব মজা করে মাংস খাবো আমরা।'
ত্রিহান মাংস মেরিনেট করে রেখে হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ভাল করে হাত ধুয়ে এসে বলে, ' আহির সোনা আজকের কাগজটা দাওতো।'
আহির দৌড়ে গিয়ে কোথা থেকে খবরের কাগজটা এনে বলে,'নাও বাবা পড়।'
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিতে হলো। খাওয়াটা একটু বেশী হয়ে গিয়েছিল। রবিবার বলে না মাংস রান্নার জন্য কে জানে। আসলে ইমন রান্নাটা খুব ভাল করে। একটা ঠিকে মাসি আছে সে ঘরদোর পরিস্কার করে ও তরি তরকারিগুলো কেটে কুটে দেয়। মাছ মাংস থাকলে তাও ধুয়ে দিয়ে যায়।
বিকেল সওয়া পাঁচটায় দুই মক্কেল এসে হাজির। কমলের হাতে একটা খেলনার বাক্স মনে হয়। আহির এদিক সেদিক দৌড়া দৌড়ি করছিল ওদের দেখে বাবার গায়ে সেঁটে দাঁড়াল। ইমনও এগিয়ে এসে বললো,
- ' ও আপনারা এসেছেন, ত্রিহানের কাছে কথা শুনেছি আপনারা আসবেন আজ বিকেলে। আপনারা গড়িয়াতেই থাকেন অনেক বছর।' পবন বললো, - ' বৌদি আপনি আমাদের তুমি করে বলবেন। আপনি হচ্ছে ত্রিহানদার স্ত্রী তাই আমাদের আপনি না বলে তুমি বললে আমাদের ভাল লাগবে। ত্রিহানদা আমাদের থেকে বয়সে বড় সন্মানেও বড়।' কমল আহিরের দিকে এগিয়ে গেল, - ' এই নাও এই গাড়ীটা আমরা এনেছি তোমার জন্য। আগে বল তোমার কি নাম?' আহির নাম বলতেই আবার বলে ' বাঃ ভারী সুন্দর নাম, নাও ধরো।'
আহির একটু ইতস্তত করে নেয় বাক্সটা। তারপর ত্রিহানকে বলে,' খুলে দাও।'
ত্রিহান বাক্সটা খুলতেই সেটা থেকে বেরিয়ে এলো একটা দু কামরার রেলগাড়ী। আহির বললো, ' এটা চালিয়ে দাও।' ত্রিহান পবনকে ডাকে, - ' পবন তুমি রেলগাড়ীটাকে চালানো আহিরকে শিখিয়ে দাও।'
- ' এসো আহির, দাও গাড়ীটা আমাকে।' আহির বড়ো করে হাত বাড়িয়ে পবনকে রেলগাড়ীটা দিল। আহিরকে দেখিয়ে পবন গাড়ীর চাবিতে দম দিয়ে ছেড়ে দিতেই গাড়ীটা সামনের দিকে চলতে শুরু করলো। আহির বাবার বাহু ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে গাড়ীটা থামিয়ে আবার পবনকে ফিরিয়ে দিল। পবন
এইভাবে যতবার গাড়ীটা চালাচ্ছে ততবারই আহির হি হি করে হাসতে হাসতে মাঝপথে সেটা থামিয়ে দিচ্ছে। কমল একবার উঠে গিয়ে ঠিক সময়ে ওকে ধরে থাকলো। রেলগাড়ীটা বিনা বাধায় অনেকটা চলে গেল। তারপর বললো, - ' দেখলে আহির গাড়ীটা কতদুর গেল। তুমি ঠিক এই জায়গায় দাঁড়াও এবার
আমি চালাচ্ছি তুমি গাড়ীটা একেবারে থামলে আবার আমাকে দেবে কেমন?'
এইভাবে আহিরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো ওরা দুজন। ত্রিহান সোফায় বসে ওদের মজা দেখছিল। রান্নাঘর থেকে ইমন তিন প্লেট মিষ্টি এনে টেবিলে রেখে কমল আর পবনকে ডেকে বললো, ' আসুন একটু মিষ্টি মুখ করে যান।'
ইমন রান্নাঘরে ঢুকতেই আহিরও পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকলো। ওভেনে তেল গরম হচ্ছে তাই ইমন বাটিতে করে দুটো মিষ্টি নিয়ে মাদুরটাকে ডাবল ভাঁজ করে আহিরকে বসিয়ে বাটিটা আহিরকে দিয়ে বললো, ' এখন আর রান্নাঘরে একদম যাবেনা কেমন, কড়াইতে তেল বসিয়েছি গায়ে ছিটকে যেতে পারে।'
( চলবে )
======================
Dipak Kr. Paul, 9007139853,
DTC Southern Heights
Block-8, Flat-1B, Kokata-700104.

Comments
Post a Comment