রাই আর বাবা
অদিতি চ্যাটার্জি
রাই-র জীবনে বেশ কিছু ভালো লাগা আছে তার মধ্যে একটা হলো সন্ধ্যার সময় তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে কফি কাপে চুমুক দেওয়া ।" আজ যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে বেশ ভিড়,নির্ঘাত 'তেলে ভাজা ' প্রেমীরা।" আপন মনেই ভাবে ও, কিন্তু বসার ঘরে সুমন আর আঁখি এতো জোরে 'হল্লা গোল্লা ' করছে তালতলার জমজমাট রাস্তার দিকে আর মন দিতে পারছে না রাই।
পায়ে পায়ে ঘরে এসে দাঁড়ায় রাই, দেখে ক্লাস ফোরের মেয়ে এতোটা ঝগড়া করছে সুমনের সাথে , "বাপ রে, কবে এতোটা কথা শিখলো মেয়ে! কিভাবে কথা বলছে?? কোঁকড়া চুল ঝাঁঝিয়ে,গোলগাল হাত নেড়ে " ...মেয়ে কে দেখে থতমত খেয়ে যায় রাই। এদিকে আঁখি বলছে, "ধুত্ বাপী তুমি কিচ্ছু পারো না, তুতাই-র বাবা, পিসাই, মামু সবাই কত ভালো করে খেলতে পারে , না আমি তোমার সাথে খেলবো না।"
কাতর চোখে মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে সুমন বলে ,"আচ্ছা তুই আমাকে শেখা, দ্যাখ আমি কার জন্য আলিপুরদুয়ার থেকে পনেরো দিন পর পর কলকাতায় আসি বল!" ঐ টুকু মেয়ে কথা প্রায় না শুনেই ঘরে চলে গেল রাই-র চোখের সামনে, সুমন একবার হেসে বাথরুমের দিকে এগোয় , কিন্তু সুমনের তাকিয়ে থাকা আঁখির চলে যাওয়ার দিকে ...এই চোখ ,কাতর চাহনি তো জীবনে বহুবার রাই দেখেছে।আবারও কি দেখতে হবে? কফিটা বিস্বাদ লাগছে,পায়ে পায়ে হেঁটে আবার বারান্দায় ফিরে আসে রাই। তালতলা হাই স্কুলের ফুটপাতে পিঠে ব্যাগ প্যাক নিয়ে দুই জন কিশোরী হাত নেড়ে খুব কথা বলছে, আচ্ছা রাই কি ওদের মতো ছিল ,"না বোধহয় আরো একটু ছোট ক্লাস সিক্স হবে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে পর পর কিছু দৃশ্য ..
দৃশ্য এক-- শনিবার স্কুল থেকে ফিরে ," বাবা মা কোথায়?"
খবরের কাগজটা মুড়ে অরিন্দম বাবু বলেন," আসবে জেঠিনের বাড়িতে গেছে । তুই মুখ হাত ধো।"
"নাঃ আমি মাকে ডাকতে জেঠিনের ফ্ল্যাটে চললাম ।" মুখের ওপর দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দৌড়াতে থাকলো রাই।
দৃশ্য দুই--- " যা পুজোর জামা বাবার সাথে গিয়ে নিউমার্কেট থেকে কিনে নিয়ে আয় এইবার ।"
"মা তুমি না গেলে আমিও যাবো না ।" বাবা কি সামনে বসেছিল!
দৃশ্য তিন--- মাধ্যমিক শুরুর আগের রাত, আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে রাই-র, দেখে বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে ।
হেমন্তের সন্ধ্যার আলো ঝলমলে রাস্তার মধ্যে রাই দেখে , ঐ তো ট্যাক্সিটা রাসবিহারী এভিনিউতে, বাবা আর রাই। কলেজ পড়ুয়া রাই আজ বাবার অভিভাবক, দুই চোখ বন্ধ করে বাবা বসে আছে ট্যাক্সিতে। ঘুমোচ্ছে বাবা! মুখে বিকেলের পড়ন্ত আলো, রাই-র বুকের ভেতরে কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়ছে ।
বিয়াল্লিশ বছরের রাই দুই হাত দিয়ে চোখটা ঢেকে বলে ওঠে," বাবা বাবা আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি, তুমি মানুষটা ছিলে অন্তর্মুখী । তোমাকে যখন ভালো করে চিনতে লাগলাম, ঈশ্বর আমাকে আর সুযোগ দিলেন না । একদিনও নেই যেদিন আমার তোমার জন্য মন খারাপ লাগে না, অজান্তেই তোমার প্রতি আমার করা ব্যবহারে আমি কষ্ট পাই না।" নাঃ রাই কিছু শুনবে না,দেখবে না, এক জীবনে অরিন্দম বাবু-রাই আর নতুন করে ফিরবে না ।
রাই ঠিক করে, আঁখির সাথে এইবার কথা বলতে হবে, ওকে ওর বাবা কে বুঝতে হবে, বাবার ভালোবাসা, কষ্ট কে অনুভব করতে হবে। অস্ফুটে বলে ওঠে রাই ,"মা রে আফশোস নিয়ে সারা জীবন কাটানো সম্ভব নয়, ভুল করিস না মা।"
===================
Aditi Chatterjee
Ranaghat, Nadia
Comments
Post a Comment