নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস
আরজু মুন জারিন
দৃশ্য : এক
বল অ
অ তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে
আ তে আমটি আমি খাব পেড়ে।।
বারেক বসে আছে একপাল ভেড়ার সাথে মাঠের মধ্যে। শৈশবের মত বাল্যশিক্ষার ক্লাস চলছে। বর্ণমালা শেখানো হচ্ছে কিন্তু ভেড়ার পালের সঙ্গে কেন?
একি কান্ড। তার স্কুলের অন্য শিক্ষক ছাত্র ছাত্রী কোথায়?
সিংহের দাত ওয়ালা চশমা পরা এক বৃদ্ধ হুজুর পড়াচ্ছে
"বল তোরা ইদুর ছানা ভয়ে মরে
ঈগল পাখী আসছে তেড়ে।
অ তে আতা
বল তুই রাতা
বাড়ি মারে ছাতা
সব পাগল খারাপ মাথা।।
হুজুর মাথা নেড়ে নেড়ে পড়াচ্ছেন।
"ওই তুই পড়িস না যে বারেকের মাথায় দিল এক থাপড় ।
থাপড়ে মাথা ঘুরে গেল তার । এই অবস্থায় ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসল সে বিছানায়।
বুকে থু মারল কয়েকবার। স্বপ্ন দেখছিল তাহলে।
মুখের উপর উড়ে এসে পড়ল বাজারের ব্যাগ তখনই বাস্তবে।
"বাজার করে উদ্ধার কর আমারে"। তার স্ত্রী কোমরে হাত দিয়ে রনরঙ্গিনী ভঙ্গিতে দাড়িয়ে।চাল শেষ।
"আজ ভাত রান্না নাই চাল না আসলে"।
চিমটি কেটে দেখল এবার। না এবারের টা সত্যি। বউ সত্যি দরজায় দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে কটমট চোখে।
উঠে যেতে হল শোয়া থেকে।। ক্ষিধে পেয়েছে তার ভীষন। স্ত্রীর যে মূর্তি দেখল নাস্তার কথা বলতে ও ভয় পাচ্ছে।
"যাব তো।হাতমুখ ধুতে দাও।নাস্তাটা করি আগে" তবু ও মিনমিনিয়ে বলল।
"বাজার করে আন আগে। পরে নাস্তা খাবে"। বউ বলল আদেশের ভঙ্গিতে ।
"পরে গেলে ভাল মাছ,সব্জী পাবেনা। পচা জিনিস নিয়ে ঘরে ঢুকবে। এ শহরের বাজার না"।।
অগত্যা কি আর করা। নাস্তা ব্যাতীত বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
দৃশ্য: দুই
তুমি বিনে আকুল পরান থাকতে চায়না ঘরে রে
সোনা বন্ধু ভুইলনা আমারে
আমি এই মিনতি করি গো
ঘুম ভেঙ্গে গেল কলিমুদ্দির বউ এর চিকন গলার গানে। কান্ড দেখো বেলাজ বেটির।
সকাল বেলা সবাই করে আল্লাহ খোদা র নাম। আর এই বেটি দেখ দেখ।
আবার দেহি শুদ্ধ করি গান পারে। ওই বেদ্দপ বারেক মাস্টার এর আছর।
"সাবিহা বেদ্দপ নামাজ পড়চিশ।.আল্লাহ খোদার নাম নাই। এই বেইন্না বেলায়। কারে বোলাস।
কাইল আই ট্রানজিষ্টার ভাঙ্গুম"।চিৎকার করতে থাকে ও।
"উ বউ চিকন গলার প্রতিবাদ শোনা যায়। বেলা করি তেনে ঘুমায়। আর তো কোন সময় নামাজ শেষ। আগে নিজে ধর্ম করেন তার বাদে আইয়েন" ।উ আবার চিকন সুরে ঝগড়ার টোন দেয় হেতি।
"বেদ্দপ বেদ্দপ গজরাতে থাকে রাগে কলিমুদ্দি।
কুলমান গেলে ক্ষতি নাই আমার সোহাগী বউ আবার সুর দেয় গানে।
"তর কুলমান গেলে ক্ষতি নাই তা তো আই কইতে পারি বেশরম। নাইলে এই বেইন্না বেলায় বেদ্দপ মাস্টার রে ইশারা করস"।
তার মেজাজ খারাপ আর ও কারণ আছে। তার বউ ক্লাস ফাইভ পাস। গ্রামের অনেক এ তার কাছে চিঠি পড়তে আসে। পাশের গ্রামের বারেক মাস্টার তারে বই খাতা দিয়ে গেছে হাই স্কুল এ ভর্তি হওনের জন্য। দুইজনের ফুসুর ফুসুর কইরা কি কয় পড়াশোনা নিয়া নাকি কথা কয়। কলিমুদ্দিন বিশ্বাস করেনা। কান বাড়িয়ে শোনার চেষ্টা করে কি পরে বউ।
বারেক মাস্টার এর গদগদ গলা শোনা যায়
রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। কি কয় আমার নাম কলিমুদ্দি।
আসলে পড়ছিল সাবিহা আসমানিরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও
রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। গজগজ করতে করতে চ্যালা কাঠ দিয়ে সামনে বিড়াল টারে বাড়ি মারল।
অভিমান করে বিড়াল টি ম্যাও করে প্রতিবাদ জানাল।
খুব তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে স্কুল এ যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে সাবিহা।
সাবিহা বু পাশের বাড়ির করিমন তক্ষুনি ফুচকি মারলো। এই বেটি এত বেশরম। কাপড় পরার ধরন দেখো। সকালে সালন খুজতে চইলা আসে। স্পষ্ট দেখল তার জামাই র দিকে চোখ ইশারা করলো।
কি গো খবর কি ? জামাই এর চোখে মুখে হাসি আর ধরেনা বেলাজ বেটিরে দেইখা।
দৃশ্য: তিন
বারেক যে জায়গায় থাকে ছোট মফস্বল শহর।ঠিক শহর ও বলা যায়না।গ্রামের মত।এখানকার এক স্কুলে বাংলার শিক্ষক।
রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে মনটা হালকা হয়ে গেল।সকালের বিদঘুটে স্বপ্নের রেশ চলে গেল মন থেকে।
হঠাৎ খুব শোরগোলের শব্দ শুনতে তাকিয়ে দেখে বিকট চেহারার বলদ তাড়া করে আসছে তার দিকে।
আল্লাহ খোদা র নাম দিয়ে ও ছুটতে শুরু করল। ছোটার আগে দেখল বলদের মালিক আরেক বলদ কলিমুদ্দি ও পিছনে দৌড়ে আসছে।
"এই দাড়া দাড়া কইলাম বলদ গরু।তোরে আইজ জবেহ দিমু"।
পাশের এক ছনের গাদা পেয়ে লাফ মেরে তাতে গিয়ে পড়ল বারেক।এ যাত্রা রক্ষা পেল এতে।গরুটা এখন ওকে ছেড়ে সামনের মানুষদের তাড়া করছে।
"গরু সকালে উঠে গরুর সঙ্গে গোল্লাছুট খেলা শুরু করছস।ঠিকমত বাইধা রাখতে পারসনা গরুটা।গায়ের ছন ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাড়িয়ে বলে ও।
"দেখেন স্যার দেখেন স্যার হাহাকার করে উঠে কলিমুদ্দি। আভাগীর বেটি ইচ্ছা কইরা গরুর খুটা খুইলা দিছে ।
এই আভাগীর বেটি কে বারেকের বুঝতে কষ্ট হয়না।
"সাবিহারে স্কুলে দিসনা কেন? তুই কি চাস ছেলে নেয়ে গুলি মূর্খ হোক"? ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠল সে।
আই কি চাই তুই কি চাও তাই কি আর বুঝিনা।মনে মনে বকতে থাকে বারেকের উদ্দেশ্যে।
এইসময় গরুটাকে আবার দেখা গেল।প্রকৃত মালিকের খোজে আবার তেড়ে আসছে ওদের দিকে।
উপায়ন্তর না দেখে সামনে খাল পেয়ে লাপ দিয়ে পড়ল বারেক তাতে।
বেচারা গরু দিশে না পেয়ে মালিককে দৌড়ানো শুরু করল।
কিছুক্ষন পরে কলিমুদ্দি ও ঝাপ দিয়ে পড়ল খালে।
পাশে কেও একজন যাচ্ছে উদাত্ত গলায় আবৃতি করতে করতে যদি ও তা নিজের আঞ্চলিকতায়।
নদীর ওইপার কয় ছাড়িয়া নিঃশ্বাস
এপারত সর্বসুখ আঁর বিশ্বাস।
দূঃখে ও হাসি পেয়ে গেল বারেকের। গরু কবিতায় তোর নোয়াখালীর টান দেওন লাগব।সে সদ্য বি.এড পাশ করেছে।ওখানে স্যার বলেছে পড়ানোর সময় অবশ্যই আঞ্চলিকতার টান পরিহার করতে হবে।বহু কষ্টে সে তা অনুসরন করে চলেছে।
খালের পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে বকেই যাচ্ছে আবৃতিকারকে।
তার গোসসা টের পেল সম্ভবত বলদ ষাড়টি। এবার বারেক দের পাহারা দেওয়ার বদলে তাড়া করল আবৃতিকারকে।
শিং বাকা করে বলদ ছুটছে সর্বশক্তিতে। তার উদ্দেশ্য আবৃতিকারকে ছন্দের মর্ম বুঝিয়ে ই ছাড়বে। ওপাশে এখন আসলে সর্বসুখ জীবন । লাফ দিয়ে যদি ওপারে যাওয়া যেত এই বলদের হাত থেকে বাঁচা যেত ,জীবনটা ও রক্ষা পেত। বেচারা আবৃতিকারের করুন মুখে তাই মনে হচ্ছে।
অবশেষে সে লাফিয়ে পড়ল খালে ওপারে সর্বসুখ জীবন এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রানপন শক্তিতে সাতরে চলল নদীর ওপারের সুখকে স্পর্শ করতে।
আধাঘন্টার মধ্যে সাতরে তিনজনে আরেক পাড়ে পৌছল।বেচারা বলদটি শিং এর ব্যাবহার করতে না পারায় মনমরা হয় এদিক ওদিক হাটতে হাটতে একজনের খড়ের গাঁদায় মুখ ডুবিয়ে দিল। খড়ের মালিক এই দূর্বৃত্তকে ধরে উত্তম মধ্যম দিয়ে দিল।
বলদটি ও হাম্বা স্বরে এর প্রতিবাদ জানাল।
।। সমাপ্ত।।

Comments
Post a Comment