অপূর্ণতার শেষ অধ্যায়
সুপ্রিয় সাহা
সময় ভোর ৫টা। হাওড়া স্টেশনের কোলাহল ভেদ করে মাইকে ঘোষণা ভেসে আসছে—
"২২৩০১ নিউ জলপাইগুড়ি বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ০৬ নাম্বার প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে।"
ধ্রুব হাতে পেপার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় তার চোখে পড়ল—হলুদ জ্যাকেট পরা এক মেয়ে, হাতে ছোট্ট ট্রলি ব্যাগ, এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেনের E1 কোচের দিকে। ধ্রুবর বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি—সে নন্দিনী। সেই নন্দিনী, যার সঙ্গে একসময় অপূর্ণ প্রেমের গল্প লুকিয়ে ছিল, যা কেউ জানত না—না বন্ধু, না পরিবার।
নন্দিনীকে দেখে ধ্রুব হঠাৎ চমকে উঠল। সে তাড়াহুড়ো করে পেপার দিয়ে মুখ আড়াল করল, দ্রুত ট্রেনে উঠে গেল। নন্দিনী কিছুই টের পেল না।
ট্রেনে উঠে নন্দিনী গেটের কাছে দাঁড়াল, উদাস চোখে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো হাওয়ার ঝাপটায় তার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, তবু সে নড়ছে না। চোখদুটো স্টেশনের ভিড়ভাট্টা, আলো-আঁধারির ওপারে কোথায় যেন স্থির হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, সে স্টেশনের ফাঁকে ফাঁকে নিজের অতীত খুঁজে ফিরছে।এই শহরেই তো কাটিয়ে দিল সাতটা বছর। সেই প্রথম কলেজ জীবন, একেবারে নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। বন্ধু হয়ে ওঠা, আবার হারিয়ে যাওয়া, আর সবশেষে—একজনকে ভালোবেসে ফেলা কিন্তু নিজের ভুলে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি করা। শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি চায়ের দোকান, ছাদের টিনের টুপটাপ শব্দ—সবই তাকে মনে করিয়ে দেয় সেই দিনগুলোর কথা।কিন্তু আজ ট্রেন ছাড়ছে, আর নন্দিনীও এই শহর থেকে চলে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, শহরের সঙ্গে যেন সম্পর্ক ছিন্ন করা সহজ নয়। সে গোপনে ফিসফিস করে বলল,
"বিদায়, কিন্তু ভুলে যাচ্ছি না।"ট্রেনটা ধীরে ধীরে গতি তুলল। নন্দিনী শেষবারের মতো মাথা উঁচু করে শহরটাকে তাকাল—যেন তার ভালোবাসা, তার ইতিহাস আর স্মৃতিগুলো সব একসাথে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে।
কিছুটা ভিড় ঠেলে অবশেষে জানালার ধারে তার নির্ধারিত জায়গায় সে বসে পড়ল চুপচাপ। বাইরের দৃশ্যগুলো আলো-অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে আসছিল।
হঠাৎ অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠল একটা গান—মন খারাপের, বিরহের গান। সে আধুনিক গায়ক অর্ণবের "হারিয়ে গিয়েছি" গানটা আস্তে আস্তে গুনগুন করছিল। যেন নিজের অজান্তেই গানটা তার ভেতরের শূন্যতাকে পূর্ণ করছিল।
এমন সময়েই, গানটির মাঝপথে তার কানে ভেসে এল এক চেনা কণ্ঠস্বর—স্পষ্ট, পরিচিত, বহুদিনের পুরনো। মনে হল যেন সেই কণ্ঠ তার বুকের গভীরে ঢুকে নাড়া দিল।
সে থমকে গেল, গলা শুকিয়ে এল।
এক পা… দু'পা করে এগোতে লাগল সে সেই স্বরের দিকে। কিন্তু সে
জানত না, তার জীবনের অপূর্ণ প্রেমের শেষ অধ্যায়ের নায়ক আজ তার সহযাত্রী হয়ে যাবে।
অবশেষে মুখোমুখি হল তারা। ধ্রুব সিট থেকে উঠতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন চোখাচোখি হল দু'জনের। এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেল যেন। নন্দিনীর চোখে বিস্ময়, ধ্রুবর মুখে অবিশ্বাস।
ধ্রুবর হাতে ধরা ছিল জলভর্তি বোতল, কাঁপতে কাঁপতে সেটা প্রায় ফেলে দিচ্ছিল। আর নন্দিনীর ঠোঁটে তখনও অর্ধেক অসমাপ্ত সেই গানের সুর। দু'জনেরই নিঃশ্বাস যেন গলায় আটকে গেল।
ধ্রুব ধীরে বলল,
— "নন্দিনী... তুই?"
নন্দিনী উত্তর দিল না, শুধু মাথা নাড়ল। তার চোখে জমে থাকা জল ট্রেনের আলোয় চকচক করছিল। আশপাশের যাত্রীরা কিছুই টের পেল না, কিন্তু এই দুই মানুষ জানল—সাত বছরের শহুরে ইতিহাস, ভুলতে চাওয়া স্মৃতি আর অসমাপ্ত ভালোবাসা এক ট্রেনের কামরায় আবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে।
ধ্রুব এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর একটু কেঁপে ওঠা গলায় বলল—
"ভাবতেও পারিনি তোকে এখানে দেখব… সত্যি, অনেক বছর পর।"
নন্দিনী নিঃশব্দে হাতের আঙুলে আঙুল ঘষতে লাগল, যেনো কিছু বলতে চাইছে অথচ মুখ খুলতে পারছে না। ট্রেনের হুইসেল ভেসে এল দূর থেকে, সেই শব্দে যেন অতীতের সব চাপা স্মৃতি জেগে উঠল।
নন্দিনী: কেমন আছিস?কোথায় যাচ্ছিস?
ধ্রুব: আছি বেশ। ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম কলকাতায়। এখন দার্জিলিং যাচ্ছি। তুই?
নন্দিনী: ভালোই আছি। এই তো পরীক্ষা শেষ, বাড়িতে এলাম একটু। তো হঠাৎ দার্জিলিং? ঘুরতে?
ধ্রুব: না রে। আমি এখন ওখানেই থাকি। আমার পোস্টিং পড়েছে সেখানে।
নন্দিনী: পোস্টিং মানে? তুই চাকরি পেয়েছিস?
ধ্রুব: হ্যাঁ। সব স্বপ্ন হয়তো পূরণ হয়নি, কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি চাইতাম, সেটা আমি গত বছর অর্জন করেছি।
ধ্রুবর মুখে সেই আত্মবিশ্বাসী হাসি দেখে নন্দিনীর বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। মনে পড়ল বহু রাতের কলহ, তার নিজেরই ছুঁড়ে দেওয়া তির্যক কথা—
"তুই কোনোদিন পারবি না… তোর সাধ্যের বাইরে এসব স্বপ্ন।"
"চাকরি করতে গেলে শুধু স্বপ্ন নয়, যোগ্যতা লাগে।"
তখন যেন ধ্রুবকে তুচ্ছ করার মধ্যেই নিজের ক্ষোভ মেটাত সে।
কিন্তু আজ ট্রেনের কেবিনের আলোয় ধ্রুবকে দেখে তার মনে হচ্ছিল—সব কথার বিষ নিজের ভেতরেই জমে আছে, ধ্রুব তা পেরিয়ে গেছে অনেক দূর।
নন্দিনী চুপ করে বসে রইল, চোখের পাতা ভিজে উঠল। যেন নিজের বলা প্রতিটি কথাই এখন ফিরে এসে তাকে দংশন করছে।
নন্দিনী (চোখ বড়ো করে): দাঁড়া, তার মানে তুই WBCS অফিসার হয়ে গেছিস?
ধ্রুব: হুম। জয়েন্ট বিডিও হিসেবে যোগ দিয়েছি, আর প্রথম পোস্টিং দার্জিলিং।
নন্দিনী: ওহ্! দারুণ ব্যাপার। কংগ্র্যাচুলেশন!
ধ্রুব: ধন্যবাদ। তোকে জানানোর জন্য WhatsApp স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম—"job is done।" ভেবেছিলাম দেখবি। তোকে তো সরাসরি মেসেজ করতে পারিনি—তুই ব্লক করে রেখেছিস আমাকে।
নন্দিনী: আচ্ছা, কাকু-কাকিমার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে কেমন লাগছে?
ধ্রুব: শুধু তাদের নয়। দু'জন প্রিয় মানুষের স্বপ্ন পূরণ করেছি—একজন হলেন দিনশেষের ক্লান্ত চিঠি আর একজন নিরাশার বেনামি চিঠি।
নন্দিনী (হেসে): বেনামি চিঠিটা তো বুঝলাম কে, কিন্তু দিনশেষের ক্লান্ত চিঠিটা কার নাম?
ধ্রুব একটু থেমে চোখ নামিয়ে বলল— "ওটা তুই-ই লিখেছিলি, নাম লিখিসনি, কিন্তু ভাঁজ করা পাতার গন্ধটা আমি চিনেছিলাম।"
ধ্রুব: দীপা। তোর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দিনরাত না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কেঁদেছি। তখন এই মেয়েটা আমার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল। তখন তেমন কথা হতো না, শুধু ফেসবুকে লেখালিখির সূত্রে।
নন্দিনী: বাহ্! ভালোই তো।
নন্দিনীর কথা শেষ হতেই ট্রেনের এক চা বিক্রেতা এগিয়ে এল, রঙিন চা এর কাপে গরম চা নিয়ে। ধ্রুব আর নন্দিনী একে অপরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, "দু'টে কাপ চা দিন" বিক্রেতা মাথা নেড়ে দ্রুত দুই কাপ গরম চা সাজিয়ে দিল।
চায়ের গরম কাপ হাতে নিয়ে দু'জনে বসে দূরের ট্রেনের আওয়াজ শুনতে শুনতে চা খেতে লাগল। ধ্রুব হালকা হেসে চায়ের কাপটা নামাল। একটু চুপ থেকে সে বলল,
ধ্রুব: "তুই জানিস, প্রথম দিকে আমি কিছুই বুঝতে চাইনি। অফিসের ব্যস্ততা, সংসারের টানাপোড়েন— সব মিলিয়ে ওকে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখলাম, আমার অনুপস্থিতিতেও ও পরিবারের জন্য কত কিছু করছে।"
তুই হয়তো ভাবছিস মেয়ে পটানো। কিন্তু আমি নিজেকে দূরে রেখেছিলাম দু'বছর। তবু ওর সরলতা, আমার পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা আমাকে টেনে নিয়েছিল।
নন্দিনী: মামা-মামীরা জানে? পছন্দ করেছে?
ধ্রুব: হ্যাঁ। গত মাসে মামার ফ্ল্যাটে পুজো ছিল, আমি যেতে পারিনি। দীপা দুই দিন ওখানেই ছিল। সবাই খুশি।
নন্দিনী: আমাদের কথা জানে ও?
ধ্রুব: সব জানে। সেই ভয়ংকর রাতের সাক্ষী শুধু ও-ই।
কথাটা বলে ধ্রুব হঠাৎ চুপ করে গেল। তার চোখে ভেসে উঠল সেই রাতের ছবি—হাসপাতালের সাদা দেয়াল, করিডরে ভেসে আসা কান্নার শব্দ, আর হাত শক্ত করে ধরা একজোড়া আঙুল। নন্দিনী চুপচাপ তাকিয়ে রইল, যেন বুঝতে চাইছে ধ্রুবর নীরবতার ভেতর লুকানো কষ্টটা।
নন্দিনী: তো কবে বিয়ে?
ধ্রুব একটু হেসে পাশের পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। পর্দায় ভেসে উঠল দীপার পাঠানো কয়েকটা লম্বা মেসেজ—ক্লাস নোট, রিসার্চের প্ল্যান, আর মাঝেমধ্যে ছোট্ট খুনসুটি। নন্দিনী মৃদু বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
ধ্রুব বলে উঠলো:- ও শুধু সম্পর্ক নয়, নিজের পড়াশোনাটাও দারুণ গুরুত্ব দিয়ে দেখে।এখনই না। ও সাহিত্যে এমএ করছে রবীন্দ্রভারতী থেকে। ওর ইচ্ছে পিএইচডি করার। আমি চাই ও নিজের পায়ে দাঁড়াক।
ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানালার বাইরে তাকাল। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে, যেন আকাশও তার অনুভূতি শোনাচ্ছে।তার মনে পড়ল মেয়েটির ল্যাপটপে রাতভর লেখা রিসার্চ নোট। সে হালকা হেসে বলল, "আমি জানি, অনেকেই বলবে দেরি হচ্ছে, কিন্তু ওর স্বপ্ন গুরুত্বপূর্ণ।"
নন্দিনীর গলা ভারী হয়ে এল। সে কষ্ট লুকিয়ে বলল—
ভালো থাকিস তোরা। মালদায় ঢুকছে ট্রেন। একটু নামবি না?
ধ্রুব জানালার কাচে হাত রাখল, দূরের রেললাইন আর স্টেশনের হট্টগোল দেখে হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,যা, এই মালদা… আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি আছে এখানে। গলির পাশের চায়ের দোকান, সেই ছোট্ট পার্ক, আর বাড়ির উঠানে খেলাধুলা—সব মনে পড়ে যাচ্ছে।এখান থেকেই আমাদের গল্প শুরু। খোলা আকাশের তলায় স্বপ্ন দেখার দিনগুলো… আর এবার ওর সঙ্গে ওর স্বপ্নগুলোকে ছুঁতে চাই।"
ধ্রুব: হুম, আধ ঘণ্টা দাঁড়াবে। তোকে গেট পর্যন্ত না হয় পৌঁছে দিই।
দু'জনে নেমে হেঁটে চলল।স্টেশনের বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে,প্ল্যাটফর্মের ছোট ছোট দোকান, আর শিশুদের খেলার শব্দ—সবই যেন তাদের ফেলে আসা স্মৃতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।ধ্রুব চুপচাপ ফুটপাতের দিকেই তাকাল, ভেজা ইটের দেওয়াল আর পুরনো গলির গন্ধ মনে পড়ল। হালকা হেসে বলল-
"যতবার আসি, এই শহরের বাতাস আমাকে যেন পুরনো দিনের গল্প মনে করিয়ে দেয়।"
নন্দিনী: কবে আবার মালদায় আসবি?
ধ্রুব:খুব কম আসি। এ শহরে এলে অনেক কিছু মনে পড়ে—যা আমাকে ভীষণ কাঁদায়। ছ'মাস আগে এসেছিলাম অফিসের কাজে, বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। বাবা-মা এখন কলকাতায়। ও কলেজ শেষে ওদের সঙ্গে দেখা করে তবে বাড়ি ফেরে। তাই চিন্তা কম।
নন্দিনী: ও আচ্ছা।
নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপচাপ ধ্রুবর দিকে তাকাল, যেন কোন খোঁজখবরের অপেক্ষা হচ্ছে। বাইরে হালকা বৃষ্টি থেমেছে, এবং বাতাসে ভিজে থাকা গাছের গন্ধ মিলছে শহরের ধুলোমাখা রাস্তার সাথে।এমন সময় ধ্রুব বলে বসলো-
ধ্রুব: রাজের খবর? কেমন চলছে তোদের?
নন্দিনী: না জানাই ভালো তোর জন্য।
ধ্রুব হালকা হেসে বলল, -
কেন জানতে পারি??
কিন্তু তার চোখে যেন এক অদ্ভুত চাপ। মনে পড়ল রাজের সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলো—সন্ধ্যার আলোয় হেসে খেলা করে বেড়ানো,স্কুলের মাঠে ছুটে বেড়ানো, ছোটখাটো ঝগড়া আর তার পরের গোপন চিঠিপত্র। এক সময় মনে হয়েছিল, সব কিছুর মাঝেও বন্ধুত্ব অটুট। এখন সেই সব স্মৃতি যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে, আর তার ভেতর এক শূন্যতা রেখে যাচ্ছে।
নন্দিনী: এক বছর হতে চলল, ও বিয়ে করেছে—রীতির সঙ্গে। আমি বুঝতেই পারিনি, আমার সঙ্গে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় কিভাবে ও অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।
কথা গুলো বলার পরেই নন্দিনীর কণ্ঠে নীরবতার আভা স্পষ্ট হলো,চোখে মৃদু আর্দ্রতা। সে চুপচাপ ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইল, যেন শুধু তার দৃষ্টিতেই এই সত্যটাকে গৃহীত করার চেষ্টা হচ্ছে। বৃষ্টির ছটা তাদের গায়ে এসে পড়ছে, এবং বাতাসে ভিজে থাকা শহরের গন্ধ যেন তার কষ্টকে আরও গভীর করে তুলছে।
ধ্রুব: ওহ্! রীতিকে কিছু বলিসনি?
নন্দিনী: না। কারণ আমি নিজেও একসময় অন্য কারো সঙ্গে ভুল করেছিলাম। বুঝলাম জিনিসটা কত খারাপ।
ধ্রুব: সময় মানুষকে অনেক কিছু শেখায়।
নন্দিনী: হ্যাঁ, ছেড়ে দে।
ধ্রুব: তোর coronary artery রোগ কেমন আছে এখান?? শরীর ঠিকাছে এখন??
ধ্রুবর চোখে হালকা উদ্বেগ, কণ্ঠে নিখুঁত শান্তি। সে হাতে থাকা চা এর কাপটা ধীরে ধীরে নাড়াচাড়া করল। বাইরের বৃষ্টি যেন হালকা হয়েছে । নন্দিনীর গলা হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে এল, চোখে লুকানো ভয় আর অবাক হওয়ার অনুভূতি মিশে গেল। সে মনে মনে ভাবল, ধ্রুব কিভাবে এতটা জানলো? অবাক স্বরে বলে উঠলো
নন্দিনী (চমকে): তুই জানলি কীভাবে?
ধ্রুব: যেদিন অপারেশন হয়, আমি মায়ের রিপোর্ট আনতে গিয়েছিলাম ওই হাসপাতালে। শুনলাম তোর ব্লাড লাগবে। আমি নিজের O+ ব্লাড দিয়ে এক ইউনিট এনে দিয়েছিলাম। ডাক্তারদের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। রাজ ছিল না সেদিন? দেখতে পাইনি ওখানে তাঁকে।
ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ থেকে রেল লাইনে তাকাল। হঠাৎ মনে পড়ল সেই হাসপাতালের সাদা দেয়াল, পলকের মধ্যে দম্ভ বাতাস, এবং নার্সদের ব্যস্ত দৌড়ঝাপ। মনে হল, তার উপস্থিতিই যেন এক অনন্ত শান্তির ছোঁয়া হয়ে উঠেছিল নন্দিনীর জন্য।
নন্দিনী: না। সেদিনই ওর বিয়ে হয়েছিল। পরে ফোন করেছিল, বলেছিল আমি যেন আর ফোন না করি—আমি নাকি ওর যোগ্য নই।
ধ্রুব (চুপ করে): …
নন্দিনী:আমি তোকে সব জায়গায় ব্লক করেছিলাম, এটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আজ বুঝতে পারছি।
দু'জনে চা শেষ করল। ধ্রুব হালকা ঝাপটায় কাপটি প্ল্যাটফর্মের পাশে রাখা ছোট টেবিলে ফেলে দিল। বৃষ্টির ফোঁটা মলিন হচ্ছে ধীরে ধীরে , বাতাসে ভিজে থাকা চায়ের ভাপ মিলছে তাদের চারপাশে।
স্টেশনের গেটের কাছে এসে নন্দিনী বলল—
নন্দিনী: ভালো থাকিস তোরা। আগের নম্বর আছে?
নন্দিনীর কণ্ঠে হালকা দমবন্ধের মতো শিহরণ, হাত একটু কাঁপছিল। সে মোবাইলটা ধীরে ধীরে ধ্রুবর দিকে বাড়াল, যেন ভিতরে একটা অনিশ্চয়তার ভয় মিশে আছে—ফলে যেটা পেতে চায়, তাতে হারানোর শঙ্কাও রয়েছে।
ধ্রুব: না। পুরনো কোনো স্মৃতি আমি রাখিনি। সব মায়া ত্যাগ করেছি।
ধ্রুব মোবাইলটা ধীরে তার হাত এর দিকে পুনরায় ফিরিয়ে দিলো। চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা আর হৃৎস্পন্দনের চাপ। তাদের মধ্যে সেই মুহূর্তে থেমে থাকা সময়, ভয়, আর আবেগ একসাথে মিলেমিশে মনে হল যেন একটি চিরস্থায়ী চিহ্ন হয়ে গেছে।
নন্দিনী: আচ্ছা। সাবধানে যাস।
ধ্রুব হালকা হেসে ট্রেনের দিকে এগোল। রেললাইনের পাথরের রোদ, আর দূরে ট্রেনের শব্দ—সবই যেন তাদের বিদায়ের মুহূর্তকে আরও গভীর করে তুলছিল। নন্দিনী মোবাইলটা হাতে শক্ত করে ধরল, কিছুটা দ্বিধা আর কিছুটা উদ্বেগ তার চোখে ফুটে উঠল।
ধ্রুব: তুইও।
নন্দিনী হাত ঢিলেঢালা করে ধ্রুবর দিকে নেড়ে হাসল।ধ্রুবও নন্দিনীর পথ অনুসরণ করলো। আর সে ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে E1 কোচে উঠলো।
নন্দিনী অবাক ভাবে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলো সে যেন চায়ছিলো এই মুহূর্তটা দীর্ঘ সময় ধরে মনে রাখতে।
ট্রেনে বসার সাথে সাথে ধ্রুব জানালার কাঁচে হাত রেখে বাইরে তাকাল—স্টেশন, ভিড়, বৃষ্টি-ভেজা রেললাইন সব মিলেমিশে তার মনে এক অজানা শূন্যতা তৈরি করল।
ট্রেন আবার হুইসেল দিয়ে ছুটে চলল। "ট্রেনের E1 কোচের জানালার দিকে নন্দিনী তাকিয়ে রইল, আর ধ্রুবর মনে শুধু একটাই কথা বাজল—কিছু গল্পের শেষ হয় না, শুধু প্ল্যাটফর্ম বদলায়।"
============
নাম- সুপ্রিয় সাহা
পিতা- সুভাষ চন্দ্র সাহা
ঠিকানা- গৌড় রোড, তালতলা
পোস্ট- মকদুমপুর
থানা- ইংরেজ বাজার
জেলা- মালদহ
পিন- ৭৩২১০৩

Comments
Post a Comment