ভ্রমণ–ডায়েরি : মহাদেবের পথে
দীনেশ চ্যাটার্জী
যে পথ শরীরে ক্লান্তি আনে, সেই পথেই আত্মা খুঁজে পায় মুক্তি।
দিবস ১ — যাত্রার সূচনা
মানুষের জীবনে কতকগুলি আকাঙ্ক্ষা থাকে—যাহার ব্যাখ্যা বুদ্ধির দ্বারা মেলে না, তৎসত্ত্বেও হৃদয় তাহার প্রতি অদম্য আকর্ষণ অনুভব করে। কেদারনাথ যাত্রা আমার কাছে তেমনই এক আকাঙ্ক্ষা ছিল। বহুদিন ইচ্ছা ছিল—কখনো পূর্ণ করি নাই। আজ তাহারই প্রথম অধ্যায় আরম্ভ হইল।
ভোররাতে ঋষিকেশে পৌঁছিলাম। স্টেশন হইতে বাহির হইবার মাত্রই অনুভব করিলাম—বাতাসে এক গভীর প্রশান্তি। শহুরে কোলাহল, ধুলো, অধৈর্যতার পরিবর্তে এখানে নীরবতা, শীতলতা, আর যেন স্নিগ্ধ তপস্যার আবহ।
গঙ্গার তীরে এসে দাঁড়াইলাম। নদী এখানে শুধু জলের স্রোত নহে—সে যেন জীবন্ত ধর্ম; যাহার মধ্যে কালান্তরে সঞ্চিত স্নেহ, পবিত্রতা ও শক্তি। তাঁর জলে ভোরের সূর্যালোক পড়িয়া মৃদু ঝিলিক তুলিতেছিল। মনে হল—মহাশান্ত পৃথিবীর বুকে আমি ক্ষুদ্রমাত্র।
বিকেলে লক্ষ্যণঝুলা দেখিবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াইলাম। সেতুর ওপর দাঁড়াইলে নিচে গঙ্গার প্রবল স্রোত দেখি—হৃদয় থমকায়ে দাঁড়ায়। সেতুটি হালকা দুলিতে থাকে, কিন্তু ভয়ের পরিবর্তে সেখানে ছিল এক অদ্ভুত আহ্বান—যেন প্রকৃতি বলিতেছে, "এসো, আমি তোমাকে অন্য পথে শিক্ষা দিব।"
রাতে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়াইয়া আকাশ দেখিলাম। যত দূর দৃষ্টি যায়—অসংখ্য নক্ষত্র; যেন ঈশ্বর অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালাইয়া রেখেছেন।
দিবস ২ — ঋষিকেশ হইতে গৌরীকুন্ড
আজ প্রাতঃকালে গাড়িতে যাত্রা আরম্ভ করিলাম। পথ যত অগ্রসর হইতেছে, প্রকৃতি তত আপন সৌন্দর্য উন্মোচন করিতেছে। একদিকে উচ্চ গিরিশৃঙ্গ, অন্যদিকে গভীর খাদ; মাঝখানে সঙ্কীর্ণ রাস্তা—যাহা দেখিতে বিপজ্জনক, কিন্তু অদ্ভুতরূপে রোমাঞ্চকর। মন্দাকিনী নদী প্রায় সর্বক্ষণ সঙ্গী। কখনো পথের সমান্তরালে, কখনো অনেক নিচে—কিন্তু সর্বদা গর্জমান, অদম্য, অথচ আশ্চর্যভাবে স্নিগ্ধ।
দুপুরে পথের ধারে এক ছোট খাদ্যালয়ে ভোজন করিলাম—ভোজনের বাহার ছিল না, কিন্তু সরলতা ছিল, আন্তরিকতা ছিল, এবং অন্নে পরিশ্রমের স্বাদ ছিল; তাহাতে বড় তৃপ্তি পেলাম।
সন্ধ্যা নামিবার পূর্বে গৌরীকুন্ডে পৌঁছিলাম। এখানে প্রকৃতি আরেক মাত্রায়। বাতাস শীতল, পরিবেশ নীরব, এবং চারদিকে উঁচু পাহাড়—যেন প্রকৃতি আপন গৃহে আহ্বান করিয়া লইল।
রাত্রি তুলনামূলক নিস্তব্ধ; সে নিস্তব্ধতা ভয়ঙ্কর নহে—বরং মনকে চিন্তায় নিমগ্ন করে।
দিবস ৩ — কেদারের পথে
আজ যাত্রার প্রধান অধ্যায়। ভোরে পথ ধরিলাম। প্রথম দিকের রাস্তায় কষ্ট কম, কিন্তু দ্রুতই পথ খাড়া হইয়া উঠিল। প্রচুর তীর্থযাত্রী; কেউ খচ্চরে, কেউ পালকিতে, অধিকাংশ পদব্রজে। পাহাড়ের বুক চিরিয়া পথ উঠিছে —এই দৃশ্য দেখিয়া শ্রদ্ধা জাগিল। মাঝে মাঝে মেঘ নেমে আসিয়া পথ ঢাকিয়া দেয়—তখন মনে হয়, পৃথিবী নয়, আকাশের মধ্যে চলিয়া যাইতেছি।
এক স্থানে এক বৃদ্ধ সাধুর সাক্ষাৎ পেলাম। তাঁহার মুখে বয়সের চিহ্ন, কিন্তু দৃষ্টিতে অদম্য আলোক। তিনি বলিলেন—"যাত্রা যদি সহজ হয়, তবে তাহা সাধনা নহে। শিব পরীক্ষা নেন—যাহারা ধৈর্যশীল, কেবল তাহারাই প্রাঙ্গণে পৌঁছায়।"
ইহা শুনিয়া মনে নবশক্তির সঞ্চার হল।
পথ ক্রমে কঠিন হইল। তুষার দেখা গেল। শ্বাস ভারী, পা ক্লান্ত, কিন্তু মন বলিতেছে—"আর একটু।"
অবশেষে, এক অদ্ভুত মুহূর্তে—মেঘ সরিয়া গেল, এবং দূরে কেদারনাথ মন্দির দৃশ্যমান হইল। কালো পাথরের সেই দেবালয়, বরফাবৃত শিখর—দৃশ্যটি দেখিয়া বিস্ময়ে মন নিঃশব্দ রইল।
দিবস ৪ — কেদারনাথে দিন
ভোরে মন্দিরের আরতি হচ্ছিলো। সে আরতি ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। ধূপের গন্ধ, ঢাকের শব্দ, ভক্তিসঙ্গীত, এবং শীতল বাতাস—সব মিলিয়া এমন এক অনুভূতি দেয়, যাহা অশ্রু হয়ে চোখে আসে।
মন্দিরে ঢুকিয়া শিবলিঙ্গের সম্মুখে দাঁড়াইয়া মাথা নোয়াইলাম—সময়েই মন হইতে সকল অহংকার, দুঃখ, ভয় বিলীন হইয়া গেল। মনে হল—মানুষ ক্ষুদ্র, কিন্তু বিশ্বাস অসীম।
দিনটি কাটিল চারদিকে বহিয়া বেড়াইয়া। পাহাড়ে এখনও তুষার জমিয়া আছে; বাতাস শীতল, কিন্তু শান্ত। সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ উঠিল—তাহার আলোয় পাহাড় যেন দেবমূর্তি।
দিবস ৫ — প্রত্যাবর্তন
আজ ফিরিবার সময়। পথ একই, দৃশ্য একই—তথাপি আজ তাহারা ভিন্ন মনে হইতেছে। হয়তো শত সহস্র মানুষ এই পথ অতিক্রম করে, কিন্তু প্রত্যেকের যাত্রা আলাদা।
গৌরীকুন্ডে পৌঁছিয়া মনে হল—যাত্রা শেষ নহে—বরং অন্তরে আরেক যাত্রার সূচনা।
শেষপত্র
এই যাত্রা আমাকে শিখাইল—
মানুষের শরীর ক্লান্ত হয়, কিন্তু মন বিশ্বাসে দীপ্ত হলে পথ কখনো দুরূহ হয় না।
কেদারনাথ কেবল মন্দির নয়—
সে ভক্তি, সে তপস্যা, সে মানবহৃদয়ের চিরন্তন অনুসন্ধান।
Dinesh Chatterjee
Prasastha, Andul Makardah road
Near Tarun Sangha club
Howrah 711302

Comments
Post a Comment