কয়েকটি কবিতা ।। মেশকাতুন নাহার
কেমন আছো বাংলাদেশ?
কেমন আছো বাংলাদেশ?
ঘামে ভেজা মাঠের ধুলো মাখা মুখে,
আজও কি লুকিয়ে থাকে স্বপ্নের হাসি?
নাকি হিসাবের খাতায় চাপা পড়ে
দীর্ঘশ্বাসের ফাঁসি?
কেমন আছো বাংলাদেশ?
উন্নয়নের আলো জ্বলে কোণে কোণে রাজপথে,
কিন্তু গলির অন্ধকারে দারিদ্রতার অভিশাপ,
আকাশ ছোঁয়া ভবনের ছায়ায়
ক্ষুধা দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
কেমন আছো বাংলাদেশ?
তোমার সন্তানেরা আজ প্রশ্ন করে—
ন্যায় কি কেবল বইয়ের পাতায়?
মানবতা কি পোস্টারের ভাষা?
আর স্বাধীনতা—
সে কি এখনো সাহসের উচ্চারণ?
কেমন আছো বাংলাদেশ?
মা আজও নিরাপত্তা খোঁজে সন্তানের জন্য,
বোন আজও হাঁটে চোখে শঙ্কার ছায়া নিয়ে।
তবু অবাক লাগে—
এই দেশেই আবার
প্রতিবাদ জন্ম নেয়, আশার গান জাগে।
কেমন আছো বাংলাদেশ?
তোমার তরুণেরা স্বপ্ন বুনে
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের তাঁতে।
কেউ দেশ গড়ার কথা ভাবে,
কেউ দেশ ছাড়ার টিকিট।
চুয়ান্ন বছর বয়সে এই বুঝি তোমার সার্টিফিকেট?
কেমন আছো বাংলাদেশ?
তোমার ইতিহাস আজও বলে—
তুমি মাথা নত করো না।
রক্তের দামে কেনা পতাকা
আজও শেখায়
অন্যায়ের সামনে দাঁড়াতে।
শোনো বাংলাদেশ,
আমরা এখনো আছি—
প্রশ্ন নিয়ে, প্রতিবাদ নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে।
আমরা চাই—
তুমি আবার এমন হও,
যেখানে ন্যায় হবে অভ্যাস,
মানবতা হবে শক্তি,
আর শান্তি—সে শুধু স্বপ্ন নয়,
হবেই একদিন বাস্তবতার পুষ্পবিন্যাস।
প্রভাষক সমাজকর্ম
কচুয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ
কচুয়া, চাঁদপুর।।
প্রশ্নবিদ্ধ সত্য
মিথ্যার কারবার করছে ছারখার রাষ্ট্রের অলিগলি,
মিথ্যার রাজা ঘিয়ে ভাজা সত্য পথের ধূলি।
শক্তির ছায়ায় মিথ্যা হাসে,আইনের চোখে ফাঁকি,
সত্য দাঁড়ায় লাইনের শেষে,হিসাব কষে বাকি।
ফেসবুক-ভাষণ বর্ণিল ভূষণ,বিক্রি হয় রে–নীতি,
অনলাইনে গাইডলাইন,অফলাইনে রাজনীতি।
চাটুকারে অন্ধকারে গড়ে তুলছে গদি,
সত্য বললে কারাদণ্ড,মিথ্যুকের আজাদী।
সংবাদ সাজে ছলের খাঁজে,রঙিলা বিজ্ঞাপন,
শ্রমিকের ঘাম স্বপ্নের দাম, লুটে নেয় কিছু জন।
ধর্মের নামে সওদা জমে মানবতা হলো খুন,
নিরীহ চোখ বন্ধ মুখ,বুকে জ্বলে আগুন।
আঁধার ছুঁড়ে পাঁজর ফুঁড়ে জাগছে কিছু কণ্ঠ,
ঠিক সময়ে বর্জ্য পুড়ে দূর করবে সব গন্ধ।
সেই না আশায় জীবদ্দশায়,চেয়ে আছি নীরব,
সত্যের জয়ে শির উঁচিয়ে লোকের হবে কলরব।
রাক্ষুসী স্রোতের উপাখ্যান
নদী—
ওই যে এক নদী, দেখছো?
অহংকারে উদ্ধত, উন্মত্ততায় অন্ধ,
স্বভাবেই সে দুর্মতি।
তারই তটরেখা ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে
শৈশবের আদ্যন্ত কাল থেকে
আমি তাকে দেখে এসেছি।
সেই প্রথম থেকেই সে
তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত, সর্বগ্রাসী—
অগণিত জীবন সে গিলে নিয়েছে,
হিসেব রাখেনি কোনো জনপদ।
দেখেছি—
এই রাক্ষুসী নদীর গর্ভে
জন্ম নিয়েছে কত হাঙর, কত সর্প,
বিষধর বিচ্ছু আর দংশনমুখর কীট;
বুলেট পিঁপড়া, সিসি ফ্লাই,
কচ্ছপ, কুমির, অজগর—
ভয়ার্ত এক অন্য জগৎ।
নিজ বুকেই সে নির্মাণ করেছিল
এক আরশিনগর।
সবই দেখেছি আমি—
ভীত, অসহায়, বাকরুদ্ধ,
একাকী এক বালুচর।
দেখেছি নদীর সর্বনাশা খেলায়
ধসে পড়েছে কত সুখের ঘর,
দেখেছি পুত্রহারা পিতার
নীরব আর্তনাদ
নির্মম স্রোতের অভিঘাতে।
লাগামহীন উত্তাল ঢেউয়ে
ভেঙে গেছে অগণিত স্বপ্ন,
কচি জীবন গিলেছে
সংরক্ষিত হাঙরের দল—
সবই তো চাক্ষুষ দেখেছি।
যখন প্রকাণ্ড সাইক্লোন
দুর্বার বেগে গ্রাস করেছে উপত্যকা,
দেখেছি তার তাণ্ডবলীলায়
কাঁপতে থাকা উপকূল,
দেখেছি নিঃস্ব মানুষের
নিঃশব্দ শঙ্কা।
চৈত্রের দগ্ধ উত্তাপে দেখেছি
তার শুকিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর,
যৌবন নিঃশেষে
সে আজ কতটাই না অনুর্বর।
অমাবস্যার অন্ধকারে
চন্দ্রালোক যখন স্পর্শ করে না তার দেহ,
কতটা কদর্য হয়ে ওঠে তার রূপ-
সবই দেখেছি আমি,
দেখেছে সবাই তার অবয়ব বিদ্রুপ।
আজও সেই পথ ধরেই হেঁটে হেঁটে
দেখেছি ভাঙন—
শূন্যতায় আজ তার বুকও
আমার মতোই
এক নিষ্প্রাণ বালুচর।
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি—
কিন্তু
হয়নি তা আজ-
জনতার দৃষ্টিগোচর।।
আত্মমগ্নতার আত্মকথন
সময় গড়িয়ে গেলে অনেক কিছুই ধরা পড়ে—
কিছু বোধ জন্ম নেয়,
কিছু সহন নিজেই হয়ে ওঠে নীরব অভ্যাস।
তখন বুঝি,
আমার 'আমি' শেষ পর্যন্ত কারও নয়—
এ একান্তই আমার আত্মস্বত্বা।
মানুষ বড় ব্যস্ত—
হিসেবি জীবনের কঠিন খাঁচায় বন্দি।
জীবন নামের নাট্যমঞ্চে
সবাই অভিনয়রত,
নিরবচ্ছিন্ন অভিনয়,
মুখোশের পর মুখোশ।
টেলিভিশনের ধারাবাহিকও একদিন থামে,
কিন্তু মানুষের অভিনয় যেন থামে না
সে চলে আত্মবিস্মৃতির অসীম পর্বে।
হয়তো আমার এই 'আমি'ও
কখনো কখনো হয়ে ওঠে
আত্মবৈচিত্র্যের বিস্ময়বিন্দু।
ধারালো নিয়তির ধনুকে
তাকে বারবার বিদ্ধ হতে হয়,
ক্ষত জমে আত্মমনে,
রক্তপাত হয় নীরবতায়।
তবু কী আসে যায়?
এই পৃথিবী তো নিজেই
গোলকধাঁধার অদৃশ্য অয়োময়।
দিনশেষে ক্লান্ত আলোর নিচে দাঁড়িয়ে
এই আমিটার পাশে থাকে কেবলই আমি।
তাই এই আমিটাকেই ভালোবাসতে হবে,
এই আমিটাকেই গড়ে তুলতে হবে আত্মযোগ্যতায়।
ঝড়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার
দৃঢ়তা অর্জন করতে হবে
এই আমিটাকেই।
আমি চাই—
আমার আমি হয়ে উঠুক সমৃদ্ধির শিখরপ্রান্ত,
নিজের সঙ্গে নিজেই গড়ে তুলুক
আত্মবন্ধনের মৈত্রী।
এই আমি কখনো হোক
গ্রীষ্মের কালবৈশাখী—অপ্রতিরোধ্য,
কখনো বর্ষার অঝোরবৃষ্টি—প্রাণসঞ্চারী,
কখনো শরতের শুভ্র কাশবীথি,
আবার হেমন্তের সোনালি ফসলেরঘ্রাণ।
এই আমি কখনো হোক কুয়াশার অন্তর্লীনতা,
কখনো শীতের আশ্বাসী উষ্ণতা।
কখনো প্রত্যাশার বৃষ্টিধারা হয়ে
এই আমিটাকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাক
সুখের নিরবচ্ছিন্ন প্লাবনে।
================
মেশকাতুন নাহার
প্রভাষক সমাজকর্ম
কচুয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ
কচুয়া, চাঁদপুর।।

Comments
Post a Comment