অন্তিম স্বীকারোক্তি
বিতস্তা বোস
"আসবো ম্যাম?"— কনস্টেবল নন্দীর গলা পেয়ে ফাইল গুলোর থেকে মাথা তুলে তাকালো বন্থিশিখা।
"ইয়েস প্লিজ"— গম্ভীর গলায় বললো সে।
কনস্টেবল নন্দী বন্থিশিখার রুমে ঢুকে এসে ওর সামনে টেবিলের উপর একটা বড় সাদা কাগজ রাখলো।
বন্থিশিখা কাগজটা হাতে নিতে নিতে বললো—"অবশেষে তাহলে বিশ্বাসঘাতকতাটা কে করল শুনি!"
কনস্টেবল নন্দীও বিন্দু মাত্র সময় নষ্ট না করে বলে উঠলো—"ওই যে ম্যাম, শেষ যে দুটো ছেলেকে নেপাল বর্ডার থেকে ধরা হলো তাদের মধ্যেই একজন। সে বলেছে সে মাত্র একবারই দেখেছে লোকটিকে, তাও নাকি দরজার আড়াল থেকে। ওর দেওয়া বর্ণনা শুনেই কোনরকমে আমাদের আর্টিস্টকে দিয়ে আঁকিয়েছি এই ছবিটা।"
বন্থিশিখা কাগজে আঁকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো— "লোকটা ছদ্মবেশে ছিল। এই ছদ্মবেশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল লোকটাকে খুঁজে বের করা কিন্তু অতটাও সহজ কাজ হবেনা আমাদের জন্য।" তারপর একটু থেমে বললো— "আচ্ছা আপনি এখন আসুন। আমি দেখি এই ছবিটা দিয়ে আসল লোকটার কোনো ট্রেস পাওয়া যায় কিনা!"
বন্থিশিখা, এস.পি. বন্থিশিখা লাহিড়ী, বিশেষ তদন্তকারী অফিসার হিসেবে মাস দুয়েক হলো আলিপুরদুয়ারে বদলি হয়ে এসেছে। বেশ কয়েকমাস ধরে ডুয়ার্স-এর জঙ্গলে একদল পশু পাচারকারির খোঁজ চলছে। সেই কেসের তদন্তের জন্যেই তাকে এখানে বদলি করা হয়েছে। এস.পি. পদে উন্নতি হওয়ার পর এটাই তার প্রথম বড় কেস। রাত দিন এক করে সে এই পাচারকারীদের ধরার চেষ্টা করে চলেছে। বেশ কিছু চুনোপুটি ধরা পড়লেও এখনও মূল মাথার সন্ধান পাওয়া যায়নি। অবশেষে আজ নেপাল বর্ডারে হাতির দাঁত পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়া একজনের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আঁকা একটি ছবি পাওয়া গেছে মূল মাথার। যদিও ছবিটিতে লোকটি একটি পাঞ্জাবির ছদ্মবেশে রয়েছে। বন্থিশিখা নিশ্চিত লোকটি একই ছদ্মবেশে কখনও থাকেনা। ও ভালো করে তাকালো ছবিটির দিকে। এক মুখ দাড়ি, মাথায় পাগড়ি, চোখে চশমা— এই সবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চোখ দুটোর দিকে চেয়ে বন্থিশিখার কেমন যেনো একটা অস্বস্থি হচ্ছিল। সেই অস্বস্তিটা মুখে বলে বোঝাতে পারবে না, সে নিজেও জানেনা এই অস্বস্তির কারণ। ছবিটি একটা পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে তার জন্যে দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা হাতে নিলো সে। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই আবার সে ছবিটার দিকে তাকালো। ডাকাবুকো অফিসার বন্থিশিখার চোখে প্রথমবার একটা অদ্ভুত ভয় দেখা দিলো। যা কিনা তার ভাবনার অতীত, যা সে কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সেটাই সত্যি হওয়ার ভয়…!
***
সালটা ২০১৩, সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বনি চলেছে আলিপুরদুয়ারের পথে এক আত্মীয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণে। আলিপুরদুয়ারে ছিল তাদের সাত পুরুষের ভিটে। যদিও বাবার চাকরি সূত্রে বনির বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই। তবে ছোটো বেলায় বহুবার গেছে সে আলিপুরদুয়ারে সেই বাড়িতে তার দাদু-ঠাকুরমার কাছে। প্রায় আট বছর আগে দাদু-ঠাকুরমা গত হওয়ার পর তার বাবা সেই বাড়ি বিক্রি করে সেখানকার পাট চুকিয়ে ফেলে। তারপর থেকে সেখানে আর তাদের যাওয়া হয়নি। এবারের এই নিমন্ত্রণটি এড়াতে না পেরে এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাদের সেখানে আবার যেতে হচ্ছে।
কোচবিহার পর্যন্ত ফ্লাইটে গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে আলিপুরদুয়ার পৌঁছতে তাদের সন্ধ্যে হলো। পরদিন সকালে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সকলে হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে হাজির হয়েছে। সকলের মাঝে অত্যন্ত বেমানান ভাবে একটি সবুজ শার্টে উপস্থিত হলো প্রায় ছফুট লম্বা, বছর কুড়ি–বাইশের একটি ছেলে। বৈশাখের ওই প্রচণ্ড গরমেও তার পায়ে মোজা এবং কভার শু। বনি ড্রেসের ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার। তবু এই প্রথমবার একটা খারাপ প্রসাধন জ্ঞানের মানুষকে দেখেও ওর মনের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি হলো, যেন এক মুহূর্তর জন্য ওর হৃদস্পন্দন থমকে দাঁড়ালো। সন্ধ্যেতে বিয়ের সময়ও সেই একই ভাবে একটি নীল শার্টে উপস্থিত হলো সেই ছেলেটি। সকলের থেকে কেমন একটা বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়ালো একপাশে। বনির যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ জন্মেছে ওর প্রতি, ওর বড্ড ইচ্ছা করছিল ছেলেটির পরিচয় জানতে, তার সাথে আলাপ করতে। ওর মনের কথা বোধহয় ঠাকুর শুনতে পেয়েছিল। পরদিন সকালে বনি তার মা বাবার সাথে বসে জলখাবার খাচ্ছে এমন সময় এক ভদ্রলোক তাদের সামনে এসে তার বাবার উদ্যেশে বললো— "ভালো আছো ভুবন?" তার বাবা মাথা তুলে লোকটির মুখের দিকে চেয়ে হেসে বললো—"আরে! সমরেশদা যে। কতদিন পর দেখা।" সে বললো— "আজ তো সন্ধ্যেতে বধূবরণের আগে আর সেরকম কিছু নেই। জলখাবার খাওয়া শেষ করে ঘুরে যাও আমাদের বাড়ি থেকে। সে তো একসময় তোমাদেরই বাড়ি ছিল। দেখে যাও সেই বাড়িটিকে। এই পাশের গলিতেই তো।" বনিদের বাড়ি ওরাই কিনেছিল। অবশেষে তার জোরাজুরিতে তারা গেলো সেই বাড়িতে। বাড়িটা ঠিক আগের মতই আছে শুধু রংটা বদল হয়েছে। বাড়িতে ঢুকতেই সেই ছেলেটির সাথে আবার দেখা। সমরেশ বাবুর ছেলে ও। অবশেষে তার পরিচয় জানতে পারল বনি। খুব স্বল্পভাষী ছেলেটি, নাম শুভ্র বিশ্বাস। সদ্য বি.এ. পাস করে এখন এম.এ. পড়ার পরিকল্পনা করছে সে।
দেখতে দেখতে বিয়ে বাড়ির পর্ব শেষ করে তারা ফিরে এলো কলকাতায়। সারাটা রাস্তা এমনকি কলকাতায় ফিরেও শুভ্রকে ভুলতে পারছিল না বনি। বার-বার মনে হচ্ছিল যদি আর একটিবার তার সাথে দেখা হয়ে যায়। নিয়তির খেলা সত্যিই অদ্ভুত। মাস ছয়েক পর কলেজের বাইরে একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে আবার শুভ্রর সাথে দেখা তার। দুজন দুজনকে দেখা মাত্রই একে অপরের দিকে এগিয়ে এলো তারা। বনির মুখে হালকা হাসি গোধূলি আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
"তুমি এখানে?"— জিজ্ঞেস করলো সে।
"এইতো পাশের কলেজটাই তো আমার। তুমি বুঝি এই কলেজটায় পড়ো?"— বললো শুভ্র।
শুভ্রর চোখের দিকে চেয়ে, বনর তখন চোখের পলক পড়ছে না। তার প্রশ্নের উত্তরে শুধু হালকা ঘাড় নাড়ল। এবার থেকে তার সাথে প্রায়ই দেখা করার সুযোগ পাবে, মনে মনে ভাবলো বনি।
"আমি তো কলকাতার বিশেষ কিছুই চিনিনা। তুমি তো কলকাতারই মেয়ে। তোমার ফোন নাম্বারটা যদি পেতাম…"— শুভ্রর কথাটা যেন বনির মনের ইচ্ছাটাই পূরণ করলো।
এরপর থেকে কলেজের পর প্রায় দিনই দেখা করে তারা। শুভ্র কম কথা বলা ছেলে। তবে যেটুকু কথা বলতো বনি মুগ্ধ হয়ে শুধু শুনতো আর আরও বেশি করে ওর মায়ায় পড়ে যেতো। কি সুন্দর ওর কথা বলা। অল্প কথায় কি সুন্দর করে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে ও। ওর সব পছন্দগুলো বনির পছন্দের ঠিক উল্টো। তবু যেন সেগুলোকেই ওরও পছন্দ হতে শুরু করলো। ওর জঙ্গল ভালোলাগে আর বনির পাহাড়। শুভ্র ভালবাসে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর বনির পছন্দ রক্। হাজার অমিলের মাঝেও যেন দুটি হৃদয় মিলেমিশে যেতে লাগলো। প্রিন্সেপ ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে দুজন দুজনের সাথে অনেক কথা ভাগ করতো। শুধু বনির নিজের মনের কথাটাই বলা হলো না। এভাবেই তিনটে বছর কেটে গেলো। শুভ্র তখন এম.এ. শেষ করে কলকাতাতেই একটি চাকরি করে। অপরদিকে বনিরও গ্র্যাজুয়েশন শেষ। এরপর সে মাস্টার্সের জন্য দিল্লির একটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। সে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার আগে শুভ্রর প্রতি ওর ভালোলাগার কথা ওকে জানিয়ে দেবে। কিন্তু শুভ্রর এতদিন সব কথার মধ্যে একটা কথা স্পষ্ট ছিল। প্রেম–ভালোবাসা এই সবের প্রতি ওর তীব্র অবিশ্বাস, নিজের মতো একা জীবন কাটাতে চাওয়া।
বনির কলেজে আজ কনভোকেশন। শুভ্রও এসেছিল কিন্তু শার্ট নয়, পাঞ্জাবিতে। অনেক গল্প করলো দুজন আর বনি শেষবারের মত দুচোখ ভরে দেখলো তার শুভ্রকে। কিন্তু সেদিনও নিজের মনের কথাটি আর জানিয়ে উঠতে পারল না সে। শুধুমাত্র শুভ্রর একা থাকতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকেই যেন সম্মান জানিয়ে সেদিনও সে চুপ থাকলো। কাল সকালের ফ্লাইটেই সে দিল্লি চলে যাচ্ছে। আর কি কোনোদিন দেখা হবে না দুজনের? সেদিন বাড়ি ফেরার পথে একটা অদ্ভুত চাপা কষ্ট হচ্ছিল বনির। যে কোনোদিন তার ছিলই না তাকেই হারিয়ে ফেলার কষ্ট। দম বন্ধ হয়ে আসা এক যন্ত্রণা। এই তিন বছরে শুভ্র যেন তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। কি করে থাকবে সে শুভ্রকে ছাড়া? "আমি যত বেশি তোমার সাথে কথা বলব তত বেশি করে তোমার মায়ায় জড়িয়ে পড়বো", বনি ঠিক করলো দিল্লি চলে যাওয়ার পর সে আর শুভ্রর সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবে না। "দেখি যদি এই ভাবে ভুলে থাকতে পারি তোমায়"— মনে মনে ভাবলো বনি।
***
ট্র্যাফিক সিগন্যাল, রাজ্য এবং দেশের বর্ডার, বিমানবন্দর, রেল স্টেশন— এই সব জায়গাতেই লোকটির সেই আঁকা ছবিটি পাঠিয়ে দিয়েছে বন্থিশিখা। যদিও সে জানে এই ছবিটি দিয়ে লোকটির সন্ধান সে এই সব জায়গা থেকে কোনো ভাবেই পাবে না। যে এত বড় পশু পাচার ব্যবসা চালাচ্ছে সে একই ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর মত কাঁচা কাজ করবে না। এই সব প্রাথমিক পদক্ষেপ ছাড়া আর কি ভাবে তদন্তটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা বন্থিশিখার মত একজন পোড় খাওয়া আই.পি.এস. অফিসার খুব ভালো করেই জানে। তবু যেন সে অনর্থক ধীরে চলছিল। কেনো সে এমনটা করছে, কাকে বাঁচাতে চাইছে সে— এর উত্তর বোধহয় ওর নিজের কাছেও নেই। বন্থিশিখা অত্যন্ত উত্সর্গীকৃত তার কাজের প্রতি। তবু তার এহেন আচরণ যেনো তার নিজের কাছেই নিজেকে খুব অচেনা করে তুলছিল। এই ভাবেই সপ্তাহ খানেক কাটার পর বন্থিশিখা আজ তদন্তের নতুন ধাপে পা ফেললো। তার নির্দেশে আজ তার তদন্তকারী দল বিভিন্ন সফ্টওয়ারের সাহায্যে সেই ছবিটির থেকে গোঁফ, দাড়ি, পাগড়ি সরিয়ে লোকটির আসল মুখটা খোঁজার কাজ শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি ছবি এক এক করে তার সামনে এনে দেখানো হচ্ছে কিন্তু সে প্রত্যেকবার বলছে,"না এরকম নয়। আরেকবার চেষ্টা করো। এই চোখ ছবিতে আঁকা চোখের সাথে মিলছে না।" অবশেষে একটি ছবি তার সামনে হাজির করা হতেই তার মুখ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। "এই তো সেই চোখ"— মনে মনে ভাবলো বন্থিশিখা। যতটা সম্ভব নিজের মনকে শক্ত করে সে বললো—"গাড়ি বের করো আর ফোর্সও তৈরি রাখো।"
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোর্স নিয়ে বন্থিশিখা পৌঁছলো আলিপুরদুয়ারেই এক গৃহস্হ্ বাড়িতে। গাড়িতে যেতে যেতেই সে তার ফোর্সকে সেখানে পৌঁছে কি করতে হবে সমস্তটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। বাড়িটির সামনে পৌঁছনো মাত্রই পুলিশ ফোর্স পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেললো। কয়েকজন ভেতরে ঢুকে গিয়ে সার্ভিস রিভলবার বের করে সেখানে উপস্থিত সকলকে আদেশ করলো—"কেউ এক পাও নড়বেন না। যে যেখানে আছেন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন।" বন্থিশিখা বাড়িটায় ঢোকার মুখে দেখতে পেলো ফুল দিয়ে সাজানো বাড়িটার সদর দরজার উপরে থার্মকল দিয়ে লেখা 'শুভ্র ওয়েডস্ নিশা'। সেই বাড়ি যেখানে অষ্টাদশীর বনির প্রথম আলাপ হয়েছিল শুভ্রর সাথে। বন্থিশিখা ভেতরে ঢুকে সোজা গিয়ে বন্দুক ধরলো সকলের চোখ এড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করা আসল অভিযুক্ত অর্থাৎ শুভ্রর মাথায়। হ্যাঁ, ছদ্মবেশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল মানুষটি ছিল শুভ্রই। বন্থিশিখা সে ছবি দেখা মাত্রই তাকে চিনতে পেরেছিল। তার বাড়ি এসে যে স্বয়ং তাকেই হাতে নাতে ধরতে পারবে সেটা অবশ্য ভাবতে পারেনি সে। শুধুমাত্র যদি তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় তার মা বাবার থেকে সেই আশাতেই এসেছিল সে।
"হ্যান্ডস আপ"— বন্থিশিখার গলা পেয়ে ঘুরে তাকালো শুভ্র। দুজন দুজনের চোখে চোখ রাখল। আজ প্রায় দশ বছর পর তাদের দেখা। কিন্তু সেটা যে এরকম ভাবে হবে তা দুজনের কেউই কোনোদিন ভাবতে পারেনি। বন্থিশিখার চোখে তখন একরাশ অভিমান আর অসহায়তা। "কেনো এমনটা করলে শুভ্র। তোমার সবটাই কি মিথ্যে ছিল? তোমার সেই বিয়ে না করে সারাটা জীবন একা কাটাতে চাওয়ার ইচ্ছা, তোমার মধ্যের সেই স্বচ্ছ মানুষটা যার প্রেমে আমি বার-বার পড়েছি? সবটাই কি নকল তুমি ছিলে নাকি এখন যা হচ্ছে সেই সব আমার তদন্তের ভুল?"— মনের মধ্যে হাজারটা অনুভূতি ঘুরপাক খেতে লাগলো তার। তারপর যতটা সম্ভব নিজের গলা না কাঁপিয়ে সে বললো —"ওকে গাড়িতে তোলো। সাথে যেন কড়া গার্ড থাকে, কোনোভাবেই যেনো পালাতে না পারে।" সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে শুভ্রকে পুলিশ ঘিরে ধরে টেনে বাইরে নিয়ে চাওয়ার চেষ্টা করলো। শুভ্র যাওয়ার সময় বলে উঠলো— "বনি…", কঠিন আই.পি.এস. অফিসারের বুকের মধ্যে যেন একটা ঝড় উঠলো— সেই কণ্ঠস্বর, সেই একই ভাবে তাকে 'বনি' বলে ডাকা— সে তো চাইলেই ছবিটির লোকটিকে আইডেন্টিফাই না করতে পারত, তবু কেন করল সে এমনটা! ন্যায়ের সাথে সে কোনোদিনও আপোষ করেনি আর তার ডিউটি কে সে সবার আগে রাখে, আজও তাই করলো। "আমি আর পালাবো না বনি। তোমার কাছে ধরা পড়ে গেছি যে"— এক অদ্ভুত বেদনা ভরা নিচু স্বরে বললো শুভ্র। বেড়িয়ে যাওয়ার আগে একবার পেছন ঘুরে বাড়িটিকে দেখে নিলো 'বনি' ওরফে এস.পি. বন্থিশিখা লাহিড়ী।
দুদিনের মাথায় কেসটির প্রথম ট্রায়াল। কোর্ট রুমে অভিযুক্তকে আনা হলো। সাথে সেই কেসের সমস্ত তদন্তকারী অফিসার এবং বন্থিশিখাও উপস্থিত। অদ্ভুত ভাবে শুভ্র এক কথায় তার সব অপরাধ স্বীকার করে নিলো। সাজা স্বরূপ পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা সাথে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডর ঘোষণা করল কোর্ট।
তদন্তের কাজ সফল ভাবে শেষ হয়েছে। দোষীর শাস্তি হয়েছে। এবার যেন তাকে এই আলিপুরদুয়ার থেকে বদলি করা হয় সেই আবেদন জানিয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে মেল করল বন্থিশিখা। উত্তর স্বরূপ তাকে অভিনন্দন জানিয়ে মেল এলো যে খুব শিঘ্রই তাকে ভূপালে এক নতুন তদন্তের জন্যে বদলি করা হবে।
আলিপুরদুয়ারে আজ তার শেষ দিন। কিন্তু থানা থেকে খবর এলো অপরাধী শুভ্র বিশ্বাস তার সাথে অনেকবার দেখা করার অনুরোধ জানাচ্ছে। একজন আই.পি.এস. অফিসার কেন যাবে সামান্য একজন কয়েদির ডাকে তার সাথে দেখা করতে? কিন্তু চলে যাওয়ার আগে যে একবার তার শুভ্রর সাথে, তার দেখা করতে বড্ড ইচ্ছে করছে। সে গেল সংশোধনাগারে শুভ্রর সাথে দেখা করতে। মিনিট দশেকের কথপোকথনে শুভ্র তাকে বললো— "আমি জানি তোমার মনে আমাকে নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরছে। আমি আজ সব কিছুর জবাব দেবো। আমি যখন প্রথম কলকাতায় যাই তখন অলরেডী আমি একটি সামাজ বিরোধী চক্রের সাথে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই জড়িয়ে গিয়েছি। অনেক চেষ্টা করেও আমি সেখান থেকে বেরোতে পারিনি। কলকাতায় গিয়ে তোমার সাথে মেলামেশা করে তোমায় খুব ভালোলাগে। তোমার মধ্যের সেই নির্ভেজাল প্রাণোচ্ছল মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাই আমি। তোমার সাথে যখন কথা বলতাম, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব ইচ্ছা করতো তোমায় নিজের মনের কথা বলে দিতে। কিন্তু আমি চাইনি আমার এই অন্ধকার জীবনের সাথে তোমার জীবনকে জড়াতে। তাই তুমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্স করতে দিল্লি চলে যাওয়ার পর, তোমার সাথে আর যোগাযোগ রাখিনি। আমি আমার সবটুকু দিয়ে আজও তোমাকেই ভালবাসি। শুধুমাত্র কাজের প্রয়োজনেই আমাকে অন্য একজনকে বিয়ে করতেও রাজি হতে হয়েছিল।" বন্থিশিখা শুধু পাথরের মত দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিল। ওর চোখে শুভ্রর প্রতি অবিশ্বাস স্পষ্ট ফুটে উঠছিল। "একটিবার আমায় বিশ্বাস করো বনি।" আজও শুভ্রর জন্য একবুক ভালবাসা লুকিয়ে রাখা বনি তো তাকে বিশ্বাস করতেই চায় কিন্তু এস.পি. বন্থিশিখা লাহিড়ীর কঠোর মস্তিষ্ক যে আবেগে ভাসেনা। আলিপুরদুয়ার ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে শেষ কিছু ফর্মালিটিস্ সারতে সে থানায় এলো। সেখানে ঢোকার মুখে একজন কনস্টেবলের সাথে তার ধাক্কা লাগতে সেই কনস্টেবলের হাতে থাকা শুভ্রর জমা রাখা ঘড়ি আর মানিব্যাগটি মাটিতে পড়ে গেলো। বন্থিশিখার অনেক কষ্টে শক্ত রাখা হৃদয় এক মুহূর্তে ঠুনকো কাচের মতো ভেঙে পড়লো, সেই মানিব্যাগে জ্বলজ্বল করতে থাকা কনভোকেশনের দিন বন্থিশিখার অজান্তেই তোলা তার একটি ছবির দিকে চেয়ে।
=============
বিতস্তা বোস
লারিকা টাউনশিপ, বারাসাত, কলকাতা

Comments
Post a Comment