অন্ধকারের মহাকাব্য
কাবেরী
সময় তখনও জন্ম নেয়নি। আলো-অন্ধকারের সীমানা তখনো কোনো দেবতা বা দানবের দখলে নয়। এক অনামা, অচিন্ত্য শূন্যতা—যাকে বলা হয় "প্রথম রাত্রি"—নিজের দীর্ঘ নিস্তব্ধতায় এক অদৃশ্য কম্পন। সেই কম্পন থেকেই জন্ম নিল দুই শক্তির বীজ—ঋতুরা এবং শ্যাবোর।
ঋতুরা ছিল আলোছায়ার মাঝামাঝি এক সত্তা—কোন দেবতা বা দানব নয়। তার অস্তিত্ব ছিল মূলত "ইচ্ছাশক্তি"—যা কিছু তিনি চান, অস্তিত্বে তার প্রতিধ্বনি জেগে ওঠে। শ্যাবোর ছিল অন্ধকারের নিখাদ আকৃতি—নির্গুণ, নিঃস্পন্দ, চির ক্ষুধার্ত।
দুই সত্তা শূন্যতার মাঝে পাশাপাশি জন্ম নিলেও, তাদের পথ আলাদা হলো সৃষ্টির প্রথম মুহূর্তেই।
---
শূন্যতার কালো সমুদ্রে একদিন ঋতুরা একটি জ্যোতি কল্পনা করলেন। সেই কল্পনা থেকেই জন্ম নিল প্রাথমিক আগুন, আলো থেকে তম:হ্রাস, এবং তার শ্বাস থেকে বাতাস। তিনি একে সাজালেন পৃথিবীর বিন্যাসে—মাটি, জল, বায়ু, আগুন, এবং আকাশ।
কিন্তু কোন সৃষ্টি কখনো মূল্যহীন নয়।
ঋতুরা জানতেন না তার প্রতিটি সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে শ্যাবোর আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কারণ, যেখানে সৃষ্টি আছে, সেখানে ধ্বংসের ক্ষুধা জন্ম নেয়—আর সেই ক্ষুধাকেই খাদ্য বানিয়ে শ্যাবোর বেড়ে ওঠে।
সৃষ্টি যত বাড়ল, শ্যাবোর তত গভীর হলো, ততই অন্ধকারের শেকড় পৃথিবীর গহ্বরে ছড়িয়ে পড়ল।
---
পৃথিবী তখন নবীন। পাহাড়ে সদ্য বরফ গলা শুরু হয়েছে, যেখানে বন মানে ছিল ধূলোর ভাঁজে সবুজের প্রথম নিশ্বাস।
ঋতুরা সৃষ্টি করলেন মানুষ।
মানুষকে তিনি দিলেন দুটি বৈশিষ্ট্য—
চিন্তা, যা আলো থেকে আসে,
এবং আকাঙ্ক্ষা, যা আসে অন্ধকারের প্রান্ত থেকে।
ফলে মানুষ ছিল দুই জগতের সন্তান—সৃষ্টি ও ধ্বংস, ন্যায় ও অনিয়ম, সৌন্দর্য ও বিকৃতির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা এক সত্তা।
মানুষ জানত না, তাদের প্রতিটি আকাঙ্ক্ষা শ্যাবোরকে পুষ্ট করে। কিন্তু তাদের প্রতিটি অনুসন্ধান ঋতুরাকে শক্তি দেয়।
এই দ্বন্দ্বের উপরই দাঁড়িয়ে ছিল ভবিষ্যতের মহাকাব্য।
---
সময় বহমান হলো। মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের মতো জগৎ গড়ে তুলতে শুরু করল। আর তার মধ্যেই সবচেয়ে শক্তিশালী সভ্যতা তৈরি হয়ে গেল রুদ্রালোকে—এক বিশাল নগর, যা আগ্নেয় পর্বতমালার উপত্যকায় স্থাপিত।
রুদ্রালোকের শাসক ছিলেন এক মহাশক্তিধর রাজার বংশধর—রাজা আরহ্যান। মানুষ তাকে দেবসদৃশ সম্মান দিত, কারণ তার হাতে ছিল আদ্যাগ্নির একটি টুকরো—যা ঋতুরা তাকে উপহার দিয়েছিলেন।
আগুনের সেই টুকরো দিয়ে আরহ্যান নির্মাণ করেছিলেন অশোক-লোহা, যুদ্ধযন্ত্র, এবং আলো-বর্ম। তার সৈন্যরা ছিল অগ্নিদেবের মতো দ্রুত এবং তপ্ত।
কিন্তু রুদ্রালোকের উত্থানের ছায়ায় অন্ধকারও জেগে উঠেছিল।
শ্যাবোরের ফিসফিসানি রাতের গভীরে কিছু মানুষের মনে ছায়ার বীজ রোপণ করছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল কোলাস, এক ভবঘুরে পুরোহিত, যার চোখে সবসময় রাতের ভাঁজ লেগে থাকত।
---
কোলাস একদিন দাবি করল:
"ঋতুরার সৃষ্টি অসম্পূর্ণ। আলো আর অন্ধকার আলাদা হওয়া উচিত নয়। যদি মানুষ সত্যিকারের শক্তি পেতে চায়, তবে তাদের দুই শক্তি একত্র করতে হবে।"
শুরুতে কেউ বিশ্বাস করেল না ।
কিন্তু কোলাসের কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত যাদু—হারিয়ে যাওয়া বন, মৃত পাহাড়, নিথর নদীর নিঃশ্বাস তার কথায় যেন প্রতিধ্বনিত হতো। মানুষ ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হয়ে গেল।
তার বিশ্বাসের কেন্দ্র ছিল:
ধ্বংসের মধ্যেই জন্ম আছে।
অন্ধকারকেই গ্রহণ করলেই মানুষ পূর্ণতা পাবে।
এই দর্শন শ্যাবোরের ইচ্ছারই প্রতিধ্বনি ছিল।
কোলাসের অনুসারীরা বাড়তে লাগল। তারা রাতের বেলায় ছায়ার শপথ নিত, আগুনের আলো নিভিয়ে শ্যাবোরের নাম উচ্চারণ করত।
ঋতুরা দূর থেকে এসব দেখতেন। কিন্তু তিনি মানুষের ইচ্ছার প্রতিক্রিয়া দিতেন—জোর করে পথ বদলাতেন না।
---
একদিন রুদ্রালোকের আকাশে তিন দিন তিন রাত ধরে আগুন রঙের ধূমকেতু দেখা গেল। নগরের জ্যোতিষীরা বলল এটি ধ্বংসের সংকেত।
আরহ্যান উদ্বিগ্ন হলেও কিছু বুঝতে পারলেন না।
কিন্তু চতুর্থ রাতে, ঋতুরার দূতের মতো এক ছায়া এসে তার সামনে দাঁড়াল। তার কণ্ঠ ছিল বাতাসের মতো ঠান্ডা।
"রুদ্রালোকের আলো নিভে যাবে," সে বলল, "যদি তোমরা অন্ধকারের ক্ষুধাকে থামাতে না পারো।"
আরহ্যান জিজ্ঞেস করলেন, "কার কথা বলছ?"
দূত উত্তর দিল, "যার চোখে রাতের প্রাচীন ছায়া—কোলাস। সে শ্যাবোরের দ্বার খুলতে চায়।"
এই কথা বলে দূত মিলিয়ে গেল।
আরহ্যান বুঝলেন যুদ্ধ অনিবার্য।
---
কোলাসের অনুসারীরা এক রাতেই নগরের তোরণ জ্বালিয়ে দেয়। ছায়ার ধোঁয়া উঠতেই শ্যাবোরের শক্তি সশব্দে গর্জে ওঠে। অন্ধকার যেন প্রাণ পেয়েছে—ছায়া থেকে তলোয়ার, রাত্রি থেকে বর্ম তৈরি হতে লাগল।
রুদ্রালোকের সেনারা আগুন-তলোয়ার নিয়ে ছুটে এল।
যুদ্ধের ধ্বনি রাতের আকাশ চিরে ছুটল।
ধাতুর ঠোকাঠুকি, আগুনের চিৎকার, ছায়ার গর্জন—সব মিলিয়ে পৃথিবী যেন কেঁপে উঠল। আগুন আলো দিত, কিন্তু ছায়া সেই আলো শুষে নিত। শ্যাবোরের শক্তি ক্ষুধার মতো বাড়তে লাগল।
কোলাসের চোখে তখন উন্মাদ আগুন।
সে গর্জে উঠল—
"অন্ধকারই পূর্ণতা! আলো শুধু বিভ্রম!"
তার কণ্ঠে শ্যাবোরের প্রতিধ্বনি ছিল।
---
যুদ্ধের চরম মুহূর্তে আরহ্যান কোলাসের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তাদের সংঘর্ষে আগুন আর ছায়া একে অন্যকে ছিন্নভিন্ন করতে লাগল।
আরহ্যানের তলোয়ারে থাকা ঋতুরার আলো অন্ধকার চিরে ফেললেও, শ্যাবোরের শক্তি এক অদম্য শূন্যতার মতো ফিরে এসে তাকে গ্রাস করতে লাগল।
শেষ মুহূর্তে কোলাস আরহ্যানের তলোয়ার ভেঙে দিল।
আরহ্যান পড়ে গেলেন।
রুদ্রালোকের আলো নিভে গেল।
আর সেই মুহূর্তেই কোলাস অন্ধকারদ্বার খুললেন—শ্যাবোরকে পৃথিবীতে আনতে।
---
অন্ধকারদ্বার খোলার সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশচেরা গর্জন শোনা গেল। শ্যাবোরের বিশাল ছায়া পৃথিবীতে নামতে শুরু করল।
তখন ঋতুরা নিজে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন।
তার আলোকদেহ ছিল অসংখ্য তারার প্রতিধ্বনি, কিন্তু তার চোখে ছিল নিরপেক্ষতা—তিনি বিচার করেননা, দোষারোপও দেননা।
তিনি কোলাসকে থামতে বললেন,এবং বললেন।
"মানুষের সৃষ্ট আকাঙ্ক্ষাই তোমাকে এত শক্তি দিয়েছে," আরও বললেন, " তুমি কি জানো, অন্ধকার পূর্ণতা নয়—এটি একান্ত আকাঙ্ক্ষার আয়না। তুমি যা চেয়েছ, সেটিই তোমাকে গ্রাস করবে।"
কোলাস হাসল—ঠান্ডা, গভীর, শূন্য হাসি।
"আমি শ্যাবোরের ইচ্ছা পূরণ করেছি। এখন অন্ধকার পূর্ণ হবে।"
ঋতুরা বললেন,
"পূর্ণতা কোন দিকেই নেই—না আলোতে, না অন্ধকারে। কিন্তু যেহেতু তুমি নির্বাচিত পথ ধরে এগিয়েছ, তার ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে।"
তিনি হাত তুলতেই কোলাসের চারপাশে আলো ও ছায়া ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরতে লাগল।
দুই শক্তি তার দেহের দুই দিক থেকে টানতে লাগল—আকাঙ্ক্ষা আর ভয়, সৃষ্টি আর ধ্বংস, আলো আর রাত্রি।
কোলাস নিজেই নিজের দ্বন্দ্বে ছিঁড়ে পড়ে গেল।
তার দেহ ছায়ার স্তূপে পরিনত হল ।
শ্যাবোর আর পৃথিবীতে নামতে পারল না। অন্ধকারদ্বার ভেঙে পড়ল।
---
যুদ্ধ শেষে শহর এখন ধ্বংসস্তূপ। রাজা আরহ্যান আর নেই। আগুনের টুকরোও ম্লান।
মানুষদের চোখে তখন শূন্যতা—তারা বুঝতে পারছিল না কোন শক্তিকে বিশ্বাস করবে।
ঋতুরা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—
"তোমাদের ইচ্ছাই পৃথিবী গড়ে উঠবে। সৃষ্টির ইচ্ছা আলোকে ডাকে। ধ্বংসের ইচ্ছা অন্ধকারকে ডাকে। তোমরা যে পথ বেছে নেবে, সেই পথই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।"
কেউ কেউ তাকে প্রণাম করল।
কিন্তুু কেউ প্রশ্ন করল না।
ঋতুরা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মানুষ নতুন সভ্যতা গড়তে শুরু করল ধ্বংসস্তূপের ওপর। কেউ আলো বেছে নিল, কেউ ছায়া। কিন্তু তারা জানত—আলো বা অন্ধকার কোনোটাই নিখুঁত নয়।
তারা শুধু পথ বেছে নেয়।
আর পথই তাদের রূপ দেয়।
—-
হাজার বছর পরেও বলা হয়—
রাত্রির নিস্তব্ধতায় কারও যদি আকাঙ্ক্ষা অতিরিক্ত বেড়ে যায়, শ্যাবোর তার কানে ফিসফিস করে।
আর কারও মনে যদি অতিরিক্ত সৃষ্টির তৃষ্ণা জ্বলে ওঠে, তখন ঋতুরা তার স্বপ্নে আসে।
মানুষ আজও দুই শক্তির মাঝে দাঁড়িয়ে।
সমাপ্ত
======================
কাবেরী, কুলপি, দঃ ২৪ পরগণা

Comments
Post a Comment