রাশিয়ার তুষারে একাকিত্ব
শিবাশিস মুখার্জী
বিমানের চাকা যখন রাশিয়ার মাটি ছুঁলো মনে হলো যেন ইতিহাসের কোনো ধূলিধূসর অধ্যায় খুলে গেল আমার সামনে। তীব্র ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে লাগলো তার ভেতরে ছিল মাটির গন্ধ বরফের গন্ধ আর এক রহস্যময় অতীতের দীর্ঘশ্বাস।
মনে হলো পা পড়েছে জার নিকোলাসের রাজত্বের দেশে একসময় যাদের ছায়ায় ইউরোপ কাঁপত। শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। ঠান্ডা বাতাস যেন কানের ভেতর ফিসফিস করে বলল স্বাগতম, এক অন্য যুগে। সেই সাম্রাজ্যের ভেতর যেখানে একদিন রাজা দার্শনিক শিল্পী আর বিপ্লবী একে অপরের ছায়া হয়ে হেঁটেছিল।
রাশিয়ায় প্রথম পা রাখার মুহূর্তটা যেন ইতিহাসের মাটিতে নিজের পায়ের ছায়া দেখা। মনে হচ্ছিল যে মাটিতে তলস্তয় লিখেছেন War and Peace চেখভের গল্পে ফুটে উঠেছে মানুষের অন্তর্লোক আর লেনিনের কণ্ঠে গর্জে উঠেছিল বিপ্লবের ডাক। সেই দেশেই আমি দাঁড়িয়ে শীতের কুয়াশা ভেদ করে মস্কোর বাতাস টানছি ফুসফুসে।
চেখভের স্মৃতি লেনিনের বিপ্লব, স্টালিনের কঠোরতা সব মিলিয়ে রাশিয়া যেন এক জীবন্ত পাঠ্যপুস্তক। শহরটার প্রতিটি ইট প্রতিটি আলো প্রতিটি শীতল নিশ্বাস ইতিহাসের সুরে বাঁধা। আমি হাঁটছিলাম সেই পথে যেখানে একসময় বিপ্লবীরা মশাল জ্বেলেছিল আর সাহিত্যিকরা ভালোবাসা মৃত্যু এবং জীবনের অসীম প্রশ্ন নিয়ে লিখেছিলেন যেমন War and Peace Anna Karenina যেন প্রতিটি রাস্তা প্রতিটি জানলা ঠিক তলস্তয়ের উপন্যাসের মতো যেখানে সব প্রশ্নের উত্তর নীরবতার ভেতর লুকিয়ে থাকে আর প্রতিটি ছায়া তলস্তয়ের কলমের শব্দে বেঁচে আছে।
কোনো এক বিকেলে যখন মৃদু তুষার পড়ছিল আমি গিয়েছিলাম তার বাড়ির সামনে এক সরল কাঠের গেট কিন্তু তার পেছনে যেন যুগযুগের মানবতার করুণা জমে আছে।
গেটের ধারে দাঁড়িয়ে মনে হলো এই মানুষটা আমাদের শিখিয়েছেন ভালোবাসা মানে কেবল আকর্ষণ নয় এক বিশাল ক্ষমা।
তারপর চেখভ যিনি চিকিৎসক ছিলেন অথচ মানুষের মনের ক্ষত সারাতেন কলমে।
মস্কো শহরের এক সাহিত্য জাদুঘরে তার নাম দেখেই বুকটা কেমন ভারী হয়ে গেল।
ভাবছিলাম এই শহরটিই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল লিখতে The Cherry Orchard যেখানে প্রতিটি গাছ মানুষের অতীতের প্রতীক।
সেই দিন বিকেলে আমি মস্কোর রাস্তায় এক পুরনো চেরি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম দেখলাম তুষারে ভেজা ডালে পাখিরা বসে আছে।
হঠাৎ মনে হলো, চেখভ এখানেই কোথাও হেঁটে যাচ্ছেন নিঃশব্দে ধীরে একটানা বিষাদের ছায়া নিয়ে।
পরের দিন সকালে মস্কোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শীতল বাতাস মুখে লাগছিল মনে হচ্ছিল আমি কোনো উপন্যাসের ভেতর ঢুকে গেছি হয়তো দস্তয়েভস্কির Crime and Punishment-এর পাতায়।
বুঝলাম রাশিয়ার আকাশে একধরনের ভার আছে যে ভার যেন মানুষের আত্মার গভীর প্রশ্ন থেকে উঠে আসে। দস্তয়েভস্কি সেই প্রশ্নগুলোই করেছিলেন পাপ মুক্তি প্রেম ঈশ্বর আর মানুষের ভেতরের অন্ধকার নিয়ে। খুঁজেছিলেন মানুষের যন্ত্রণায় বিশ্বাস করতেন নরক আসলে মানুষের নিজের মনের মধ্যে। আর আমি সেই বরফ ঢাকা মস্কোর পথে হাঁটতে হাঁটতে বুঝেছিলাম এই সত্য কেবল উপন্যাসের নয় জীবনেরও। এখানেই তো তিনি রোদিয়ন রাস্কলনিকভকে সৃষ্টি করেছিলেন যে মানুষ নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে চেয়েছিল আবার সেই অহংকারেই ভেঙে পড়েছিল। হয়তো এই বরফ ঢাকা মাটিতেই দস্তয়েভস্কি কোনো গির্জার ঘণ্টার শব্দে শুনেছিলেন মানুষের অপরাধবোধের কান্না।
ওনাদের ভাবনা আজও রাশিয়ার হাওয়ায় মিশে আছে। ক্রেমলিনের লাল প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন দেখতে পাচ্ছি দস্তয়েভস্কিকে এক হাতে সিগারেট চোখে এক গভীর দৃষ্টি যা মানুষের আত্মার গহ্বর দেখতে পারে।
তলস্তয় চেখভ দস্তয়েভস্কি তাঁরা শুধু লেখক নন তাঁরা রাশিয়ার আত্মা। তাঁদের শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এই দেশের ইতিহাস যন্ত্রণা ভালোবাসা বিশ্বাস আর বিদ্রোহ।
আর আমি, এক বাঙালি শিক্ষক সেই আত্মার মাটিতে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম লেখা মানে আসলে বাঁচা। কারণ দস্তয়েভস্কি শিখিয়েছিলেন মানুষের হৃদয়ই আসল যুদ্ধক্ষেত্র। সেই যুদ্ধই আজও চলছে আমার মধ্যেও প্রতিটি মানুষের মধ্যেও।
আর জার নিকোলাসের রাজপ্রাসাদ ওহ কী রাজকীয় অথচ বিষণ্ন।
ঝলমলে মার্বেল সোনালি ছাদের নিচে লুকিয়ে আছে এক শাসনের নিঃশেষিত গৌরব।
ক্রেমলিনে দাঁড়িয়ে সেই অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল ইতিহাস আসলে এক আয়না যেখানে আলো আর ছায়া একে অপরকে গ্রাস করে।
যতটা সুন্দর ততটাই নিষ্ঠুর।
আমি আরো অনুভব করছিলাম বিদেশযাত্রা মানে শুধু ভৌগোলিক নয় অন্তর্মনের দেশান্তর। এখানে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম নিজের ভেতরের স্টালিন যে শৃঙ্খলা চায় আর নিজের ভেতরের লেনিন যে মুক্তি চায়। এই দুই শক্তির সংঘর্ষই মানুষকে মানুষ বানায়। স্টালিনের যুগের ভয় লেনিনের বিপ্লবের ডাক সব মিলিয়ে এই দেশ যেন এক বিরাট দার্শনিক পরীক্ষাগার যেখানে স্বাধীনতা আর নিয়ন্ত্রণ বিশ্বাস আর সংশয়ের দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। লেনিন যেখানে মানুষকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন সেখানে স্টালিন সেই মুক্তিকেই নিয়ন্ত্রণে বেঁধে ফেলেছিলেন। আর এই দুই মেরুর মাঝে দাঁড়িয়েই রাশিয়ান মানুষ শেখে চেতনা কোনো স্থির বস্তু নয় এটা এক অন্তহীন যাত্রা।
রাতে যখন হোটেলের জানলার বাইরে তাকাতাম মস্কোভা নদী ধীরে ধীরে প্রবাহিত হতো তার গায়ে আলো ঝিকমিক করছে যেন কোনো ক্লান্ত আত্মা ঘুমোতে পারছে না। শহরের নীরবতা, নদীর ধ্বনি দূরের ট্রামের ঘণ্টা সব মিলে মনে হতো আমি যেন এক অদৃশ্য কবিতার ভিতর বসে আছি। রাশিয়া আমাকে শিখিয়েছিল গভীরতা কী জিনিস।
তলস্তয়ের মানবিকতা চেখভের নিঃসঙ্গতা দস্তয়েভস্কির অন্ধকার আর মস্কোর ঠান্ডা সব মিলিয়ে যেন এক আত্মার প্রতিচ্ছবি।
কখনও কখনও মনে হতো এই তুষার এই ঠান্ডা এই নীরবতা সবই যেন আমার নিজের ভেতরের প্রতিফলন।
আমি হাঁটছিলাম একা কিন্তু সেই একাকিত্বের মধ্যে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছিল।
যেন বরফের মধ্যেও কেউ ফিসফিস করে বলছে মানুষ একা হয় কিন্তু একাকিত্ব কখনো বৃথা নয়।
বিদেশযাত্রা যতই পেশাগত হোক সেখানে একটা কবিতা লুকিয়ে থাকে এই রাশিয়া সেই কবিতাকে ছুঁয়েছিল।
আর তখনই মনে হলো, বাবা বলেছিলেন
তোমার সীমা আকাশ।
হয়তো ঠিকই বলেছিলেন।
কিন্তু সেই আকাশের নিচে আমি যে তুষারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি সেটাই আমার সত্যিকারের পাঠশালা।
লেখা পড়া গবেষণা সবকিছুই এই বিদেশযাত্রায় নতুন আকার পেয়েছে। প্রতিটি জায়গা যেন আমাকে শিখিয়েছে একেকটি দর্শন একেকটি জীবনদৃষ্টি। রাশিয়ার সাহিত্যে যেমন মানবিক দুঃখের গভীরতা তেমনি ইতিহাসে আছে ক্ষমতার উজ্জ্বলতা ও অন্ধকার। আমি বুঝেছি মুক্তি দুঃখ প্রেম শৃঙ্খলা সবই মানুষের জীবনকে পূর্ণ করে কিন্তু সেই পূর্ণতা নীরবতার মধ্য দিয়ে আসে।
রাশিয়া ছেড়ে আসার সময় মনে হলো প্রতিটি ধূলিমাখা রাস্তা প্রতিটি তুষারপাত প্রতিটি সাহিত্যিক নাম প্রতিটি রাজপ্রাসাদ আমার সঙ্গে চলে এসেছে। বিদেশযাত্রা শেষ হলেও, ইতিহাস ও সাহিত্য থেকে শেখা দর্শন জীবনের গভীর দিকগুলো চিরকাল আমার ভিতরে থাকছে।
=============

Comments
Post a Comment