কাদের কিংবা কেদার
সন্তোষ ঢালী
ছোটখাটো ফর্সামতো হাফপ্যান্ট পরা হাসিখুশি যে লোকটা এসে সামনে দাঁড়াল, তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে না থেকে পারা যাবে না। প্রথম দেখাতেই আকৃষ্ট করল সে। পরনে উদ্ভট হাফপ্যান্ট, সার্কাসের ক্লাউনের মতো গায়ে হাফহাতা রঙচঙা গেঞ্জি, মাথায় নেপালি টুপি, পায়ে দৃষ্টিকটূ রঙিন চপ্পল। এমনিতেই সবসময় খুব ঠান্ডা দার্জিলিঙে তার উপর শীতকাল। বোঝার উপর শাকের আটির মতো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও আছে। শীত খুব জাকিয়ে বসেছে। এই শীতে সামান্য এ পোশাকে বিস্মিত হওয়ারই কথা। কিম্ভূতকিমাকার পোশাক-পরিচ্ছদ। কোনোটার সাথে কোনোটারই কোনো মিল নেই। অসামঞ্জস্য। সাইজও এক একটা এক এক রকমের। প্রথম দেখাতেই যে কেউ একটু ভিড়মি খাবে এবং কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হবে। হোটেল বয়। তাকে অবশ্য বয় বলা চলে না, কারণ তার দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে; যদিও দাড়ি নেই, গোঁফ আছে। চার্লি চাপলিন মার্কা গোঁফ। দেখলেই হাসি পায়। বেশ চটপটে। ‘ঘুম’। পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম রেল স্টেশন। বৃষ্টিস্নাত দার্জিলিং। স্টেশন পাশ কাটিয়ে আমাদের জিপ এসে থামল হোটেলের সামনে। কাছেই। ‘হোটেল মিল্কিওয়ে’। হর্ন শুনেই ছুটে এলো হোটেল বয়। ল্যাগেজগুলো নির্ধারিত রুমে পৌঁছে দিয়ে একটু পরেই হাতমুখ ধোয়ার জন্য গরম জল নিয়ে ফিরে এলো সে। কম দামি হোটেল, তাই গিজার ছিল না। নাম জিজ্ঞেস করলাম। একগাল হাসির সাথে উড়ো খইয়ের মতো উত্তর ছুটে এলো—
— কাদের, আব্দুল কাদের।
প্রথম দর্শনেই কুপোকাত। ঠোঁটের কোণে কৌতুকময় হাসি। চোখেমুখে রহস্য। বলল—
— স্যার, যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে ডাকবেন। বান্দা হাজির। স্নান করবেন স্যার? গরম জল নিয়ে আসবো?
— না। যা ঠান্ডা! স্নান করার কথা ভাবাই যায় না। আজ আর স্নান নয়।
— হাত-মুখ ধুয়ে তাহলে খাবার ঘরে আসুন। টেবিলে খাবার দেই।
— আচ্ছা। হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে আসছি। তুমি যাও। গরম গরম খাবো।
নাম কাদের। অথচ বিশুদ্ধ হিন্দুয়ানি বাংলায় কথা বলছে। জল বলছে। স্নান বলছে। যা হোক, সে বলতেই পারে। এটা কোনো বিষয় নয়। ভাষা দিয়ে কি মানুষের জাত নির্ণয় করা যায়? ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংএ। খাবার টেবিলে বসতেই কাদের এসে হাজির। মেন্যু জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে বলে গেল একগাদা তোতা পাখির মতো— সাদাভাত, আলুভর্তা, শিমভর্তা, পেপেভর্তা, উচ্ছেভাজি, আলুপটলের ডালনা, সব্জি, কোরাল মাছ, বোয়াল মাছ, টুনা ফিস্, মুরগির মাংস...। মুখস্থ নামতার মতো। কোরাল মাছ, বোয়াল মাছ বলছে কিন্তু টুনা ফিস্। যেহেতু বিদেশি মাছ, তাই সেটা তার কাছে ফিস্। খাবার অর্ডার দিয়ে বসে থাকলাম। একটু পরেই গরম গরম খাবার এলো। ঝট্পট্ খাবার পরিবেশন করে চলে গেল পাশের টেবিলে। শাঁখা-সিঁদুরপরা এক মহিলা, সাথে বয়স্ক এক বিধবা মহিলা। সাথে আরও কয়েকজন পাশের টেবিলে। তাদের খাবার পরিবেশন করতে গেল। বয়স্ক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন—
— বাবা, তোমার কী নাম?
— আজ্ঞে, কেদার। কেদার চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণ।
আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। একটু আগেই আমাকে বলল যে তার নাম কাদের? পাশাপাশি দুই টেবিলে দুই নাম হয়ে যায় একজন মানুষের? তাও আবার হিন্দু নাম আর মুসলমান নাম? কেমন করে? ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন কয়জনা’। আমাকে বলল আব্দুল কাদের। আর ওদিকে বলল কেদার চক্রবর্তী। মানে কী? কোনটা ঠিক, আর কোনটা বেঠিক? বিষয় কী? অলক্ষ্যে খেয়াল করছিলাম তার আচার-আচরণ, চাল-চলন, হাব-ভাব, বেশ-ভূষা; চটপটে এবং হাসিখুশি। মজার। বেশ অদ্ভুত আর রহস্যময় লাগছিল তাকে। কিন্তু দুই জায়গা দুই নাম। একটু পরেই কাছে ডাকলাম। বললাম—
— তোমার নাম কেদার? আমাকে যে বললে কাদের?
— স্যার, উনি বয়স্ক হিন্দু মহিলা তো, মুসলমানের হাতে খাবেন না হয়ত। তাই এখানের কাদের ওখানের কেদার হয়ে গেলাম। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মতো। আমি তো যে, সে-ই। শুধু শুধু ঘোট পাকিয়ে লাভ কী? ঝামেলা হবে। কাদের ওরফে কেদার, যা ইচ্ছে তাই বলে ডাকতে পারেন আমাকে। আমাকে পেয়ে যাবেন। নামে কিইবা আসে যায়? ওটা বাইরের লেবাস। হিন্দু টেবিলে কেদার, আর মুসলমান টেবিলে কাদের। ভেতরে তো আমি যা, তাই-ই?
— তা বুঝলাম, হিন্দু এলে কেদার, আর মুসলমান এলে কাদের। এর কারণ কী? আর খ্রিষ্টান এলে কি কর্ডন? খ্রিষ্টানদের জন্য একটা খ্রিষ্টান নাম লাগবে না? আর একটা নাম বানিয়ে নাও।
ভুবনভোলানো একটা হাসি দিয়ে চলে গেল কাদের কিংবা কেদার। আমি তো অবাক। চমৎকার সিস্টেম। এখানে কাদের, ওখানে কেদার। এখানে পানি, ওখানে জল। এখানে খানা, ওখানে খাবার। দু’টো একই তো, যে নামে ডাকো। চমৎকার আইডিয়া। মনে মনে বুদ্ধির তারিফ করলাম তার। কিন্তু মনে একটা ধন্দ লেগে গেল। আসলে সে কী? হিন্দু না মুসলমান? এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না আমার। হিন্দু হলেই বা কী, মুসলমান হলেই বা কী? কিন্তু কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিলাম না। ও ব্যাটা আব্দুল কাদের কী করে রাতারাতি কেদার চক্রবর্তী হয়ে গেল? বেশ মজারই লাগছিল বিষয়টা। গলায় কাঁটা বিঁধে থাকার মতো মনের ভেতর একটা খট্কা থেকেই গেল। কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক জানতে হবে প্রকৃত রহস্যটা কী।
সন্ধ্যার পর যেমন গাঢ় হয়ে আসে অন্ধকার, ঠান্ডাও তেমনি জাকিয়ে বসে আঠার মতো। ঠান্ডা আর অন্ধকার যেন যমজ দুই ভাই। এক সাথে আবির্ভূত হয়। তাই রাতে আর বেরুতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। চা খেতেও বেরুতে ইচ্ছে করছিল না। ইন্টারকমে ফোন দিয়ে কাদেরকে চা আর বিস্কুট নিয়ে আসতে বললাম। কিছুক্ষণ পরেই দরোজায় খট্খট্ শব্দ। ভাবলাম কাদের এসেছে। বললাম—
— প্লিজ কাম অন। দ্য ডোর ইস ওপেনড।
ভাবলাম কী, আর ঘটল কী? সুন্দরী এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ঢুকে পড়ল রুমে। মাথা থেকে একটা বোঝা নামিয়ে খুলতে শুরু করল। ভেতর থেকে একটার পর একটা বের করতে লাগল শাল-চাদর। আধো আধো বাংলাতেই বলতে লাগল যে তার কাছে নানা রকমের শাল-চাদর আছে। ইচ্ছে হলে দু’একটা কিনতে পারি। আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, এই রাতের বেলা শীতের মধ্যে এরা নিশ্চিন্তে হোটেলের কামরায় ঘুরে ঘুরে শাল-চাদর বিক্রি করে; কোনো ভয় নেই, ডর নেই। কত রকম বিপত্তি ঘটতে পারে? আমি জানালাম যে, আমার কোনো চাদর লাগবে না। সে নাছোড়বান্দা। দু’একটা বিক্রি না করে যাবেই না। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, সে কলেজে পড়ে। এভাবে ফেরি করে শাল-চাদর বিক্রি করে পড়ার খরচ চালায়, আর সংসারে সহযোগিতা করে। জেনে একটু করুণা হলো। ভাবলাম, দু’একটা কেনা যাক। মেয়েটা চাদর দেখাচ্ছিল। এরই মধ্যে চা-বিস্কুট নিয়ে বলরাম হাজির। ওকে দেখেই বকা-ঝকা শুরু করল ওদের ভাষায়। সে ভাষা আমি ঠিক বুঝে উঠতেও পারছিলাম না। বুঝলাম, কাদের তাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি বললাম— আহা থাক না, বেচারি এসেছে এই শীতের মধ্যে; একটা চাদর না হয় কিনি? কাদের কোনোভাবেই কিনতে দেবে না। ওগুলো নাকি ভালো চাদর নয়। তারা মানুষকে ঠকায়। উল্টোপাল্টা দাম রাখে। ওদের কাছ থেকে কখনওই কিছু কেনা যাবে না— ইত্যাদি ইত্যাদি বুঝাল আমাকে। এবং মেয়েটাকে বের করে দিতেই সক্ষম হলো। আমার কোনো কথাই শুনল না সে। হা হতোস্মি! আমার আর কী করা? চায়ের কাপে চুমুক দেয়া ছাড়া আমার আর করার কিছু ছিল না। যদিও মেয়েটার জন্য মনটা খারাপ লাগছিল। আহা বেচারি! আমাকে ছবক দিল কাদের—
— এইসব মেয়েছেলেকে বিশ্বাস করবেন না স্যার। ওদের কাছ থেকে কিছু কিনবেন না। এরা মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে খারাপ জিনিস দিয়ে অনেক টাকা দাম রাখে।
— না হয় রাখলই। না হয় একদিন ঠকলামই। তাই বলে এভাবে অপমানিত করে তাড়িয়ে দেবে?
— স্যার, আপনি চেনেন না এদের? আপনার পকেট গড়ের মাঠ করে ছেড়ে দেবে।
— এরা পড়ালেখা করে। পড়ার খরচ চালায়। সংসারে সহযোগিতা করে। এটুকু সহযোগিতা করা উচিত না?
— সব জায়গায় সহানুভূতি দেখাতে যেতে হয় না স্যার। রাতে কী খাবেন? তাড়াতাড়ি খেয়ে দ্রুত শুয়ে পড়তে হবে। সকালে টাইগার হিলে যেতে হবে সূর্যোদয় দেখতে।
— ও হ্যাঁ, ভোর সাড়ে তিনটায় তুমি আমাকে ডেকে দেবে। পৌনে চারটায় গাড়ি ছাড়তে হবে। নইলে সূর্যোদয় দেখা যাবে না। জিপ চ’লে এলেই তুমি গরম জল নিয়ে আসবে। স্নান তো করবো না, শুধু হাত-মুখটা কোনোমতে ধুয়ে গাড়িতে উঠবো। ডাকতে ভুল করো না যেন।
— সূর্য উদয় হতে ভুল হতে পারে স্যার, এই বান্দার কখনও ভুল হয় না। যথাসময়ে বান্দা হাজির হবে। একটু পরে নিচে গিয়ে খেয়ে আসবেন। দেরি করবেন না।
— কাদের একটু দাঁড়াও। একটা সত্যি কথা বলবে?
— কী কথা স্যার? এই বান্দা কখনও মিথ্যা কথা বলে না। চাঁদ-সুরুজের আলো মিথ্যা হতে পারে, এই বান্দা কখনও মিথ্যে কথা বলে ন।
— তোমার আসল নামটা কী?
— এই কথা? আসলে আমার নাম কেদার। কেদার চক্রবর্তী। খুশি স্যার?
— আমার খুশি অখুশিতে কিছু যায় আসে না। ঠিক আছে। যাও।
ভাবলাম, যাক সত্যটা জানা গেল। মনের একটা দ্বন্দ্বের ভার নেমে গেল। দ্বন্দ্ব হিন্দু-মুসলমানের নয়; মনের ভেতর একটা খচ্খচানি ছিল, সেটা বেরিয়ে গেল।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে জামা-কাপড় আর পাল্টালাম না। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা। জমে যাচ্ছিলাম। জুতোটা খুলে মোজা পায়ে রেখেই শুয়ে পড়লাম। গায়ে জামা-প্যান্ট, সোয়েটার, মাফলার, মাঙ্কিটুপি সব সহকারে শুয়ে তার উপর আবার দু’টো কম্বল চাপিয়ে কবরের মতো অবস্থা করে শুয়েও ঠান্ডা মনে হয় যায় না। এমনিতেই ঠান্ডা, তার উপর সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি তো আছেই। পাশের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো দু’টো ঘন কুয়াশার মধ্যে ভূতের চোখের মতো লাগছিল। উত্তর মেরুতে এস্কিমোদের ইগলুর মধ্যে শুয়ে আছি মনে হয়। হিম করা ঠান্ডা। বরফের কবর যেন। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই নি। মৃতের মতো ঘুম।
রাত সাড়ে তিনটায় ঘুম ভাঙে কাদেরের থুড়ি কেদারের কড়া নাড়ার শব্দে। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। ঠান্ডায় বরফের মতো জমে যাচ্ছিলাম। কী আর করা? ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি’। জিপগাড়ি এসে গেছে। উঠতেই হলো। দরোজা খুলতেই ভিড়মি খাবার পালা। দুয়ারে দাঁড়ায়ে জাম্বুবান। স্বয়ং কেদার। সামনে যদি হিড়িম্বা রাক্ষসীকেও দেখতাম, এতটা বিস্মিত হতাম না। চোখ ডলতে ডলতে দরোজা খুলতেই সামনেই মূর্তিমান কেদার। নাকি কেদারের ভাস্কর্য! খালি গা, খালি পা। শুধু পরনে ছোট্ট একটা জাঙ্গিয়া। হাফ-প্যান্টও না; স্রেফ একটা জাঙ্গিয়া। গায়ে কোনো স্যান্ডো গেঞ্জিও নেই। আর কোথাও কোনোও একগাছা সুতোও নেই। এই ঠান্ডায় যেখানে ত্বকের নিচে রক্ত জমাট বাঁধার উপক্রম, কেদার সেখানে সম্পূর্ণ খালি গায়ে। এ কী মানুষ, নাকি রোবট? নাকি রবারের তৈরি? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সে স্বাভাবিক। কোনো কাঁপাকাঁপি নেই। কাচের জগ হাতে। জগে গরম জল। বড় বড় দু’টো প্লাস্টিকের বোতলে জগ থেকে ঢেলে দিলো। আর চোখের সামনে বোতল দু’টো কুঁচকে ছোট হয়ে গেল। যেন ম্যাজিক। আর এক বিস্ময়ে আমি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এ কী দেখছি চোখের সামনে? ভেলকি? জাদু?
ঘন কুয়াশা। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো ঘুমুচ্ছে যেন বা। মিটিমিটি করছে। ম্লান। জিপ গাড়িটা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশেই দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা দেবদারু গাছ। আমরা গাড়িতে উঠতেই ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে গোঙানি দিয়ে উঠল গাড়িটা। হেড লাইটের আলো কুয়াশাকে বিদ্ধ করছে। কাদের বলল—
— স্যার, পথে কিন্তু ফ্ল্যাক্স হাতে সুন্দরী মেয়েরা গাড়িতে উঠতে চাইবে। ফ্ল্যাক্স-সুন্দরী। কফি বিক্রি করবে। উঠাবেন না। বিস্বাদ কফি। বাচ্চাদের পেচ্ছাবের মতো। গাড়িতে উঠালে কিন্তু কফি খেতেই হবে। হেসে হেসে মিষ্টি করে কথা বলবে। খাতির করবে। পার পাবেন না। সাবধান।
গাড়ি ছাড়তেই বদমাইশটা চেঁচিয়ে বলল— স্যার, আমার নাম কিন্তু কেদার না, কাদের। আব্দুল কাদের। মরহুম আব্দুল কাদের।
আবার ধন্দে ফেলা। আবার মরহুম! আবার মনের মধ্যে খচরমচর। কেমন লাগে?
কথা সত্য। কিছুদূর যাবার পর মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামাল সুন্দরী এক মেয়ে। ভূতের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল কুয়াশার মধ্যে একাকি। দেখে মায়াও হচ্ছিল। হাতে কফির ফ্ল্যাক্স। উঁকি মেরে দেখল সিট খালি আছে কিনা। একটা সিট খালি। নিষেধ করা সত্ত্বেও উঠে পড়ল জোর করে। বারণ মানল না। ‘ও যে মানে না মানা’। গাড়িতে উঠেই সার্চ লাইটের মতো দৃষ্টি দিয়ে চোখ বুলিয়ে সবাইকে দেখে নিলো। তারপর শুরু হলো ভাব জমানোর চেষ্টা। এরপর থেকেই কফি পান করানোর জন্য চেষ্টা শুরু করল। কাদেরের কথা মনে পড়ল। হাসি রাগ অভিমান সবই চলল। অবশেষে বাধ্য হয়েই এক কাফ কিনতে হলো ত্রিশ রুপি দিয়ে। অমন বিস্বাদ কফি বাপের জন্মেও খাই নি। পানসে যাকে বলে। তবু খেলাম, একটু গরম তো হলো শরীর। ওটুকুই সান্ত্বনা। টাইগার হিলে যাওয়াই সার হলো। সূর্যোদয় কপালে নেই। ঘন কুয়াশা ভেদ করে সূর্যদেবের দর্শন মিলল না। প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য অবশ্য মন ভুলাল। তারপর ফেরার পালা। সেই কফিওয়ালিও উঠল আমাদের সাথে। যে মেয়ে যে গাড়িতে চড়ে যায়, সে সেই গাড়িতেই ফেরে। এটাই সিস্টেম। আর কোনো কফি খাওয়াতে পারে নি বলে সে কী অভিমান! সারা পথ একটাও কথা বলে নি আমার সাথে। আরেক দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকল।
আবার ফিরে এলাম হোটেলে। এবার বালতিতে করে গরম জল নিয়ে এলো কাদের। স্নান শেষে কাদেরকে আবার জিজ্ঞেস করলাম—
এবার সত্যি করে বলো তো, আসলে তোমার নাম কী?
— স্যার তখন মিথ্যে বলেছিলাম। আমার নাম আসলে কেদারই।
এক একবার এক এক কথা বলে। প্রহেলিকা সৃষ্টি করে। একবার বলে, আসলেই কাদের। আরেকবার বলে, আসলেই কেদার। তার চোখে-মুখে সবসময় একটা দুষ্টুমি। কোনটা ঠিক, আর কোনটা বেঠিক বোঝার উপায় নেই। কাদের বা কেদার সম্পর্কে নানা কিছু জানতে ইচ্ছে করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম—
— কাদের, বিয়ে করেছ?
— আজ্ঞে স্যার আংশিক। আংশিক বিয়ে করেছি।
— আংশিক আবার বিয়ে হয় নাকি? কী উদ্ভট কথা বলো?
— স্যার, হয়। ফিফ্টি পার্সেন্ট বিয়ে করেছি।
— তোমার সব কিছুতেই শুধু হেঁয়ালি। ফিফ্টি পার্সেন্ট বিয়ে হয় কেমন করে?
— স্যার, আমার বিয়ে সব ঠিকঠাক। বিয়ে করতেও গেছি। সব ঠিক ছিল। কিন্তু পাত্রী ঠিক ছিল না।
— সে কেমন? পাত্রীর কী হয়েছিল?
— কিছুই হয় নি। বিয়ে বাড়ি গিয়ে শুনি পাত্রী ফুটে গেছে। মানে পালিয়ে গেছে। আগের প্রেম ছিল কার সাথে যেন, তার সাথে পালিয়ে গেছে। বিয়ে তো আর পাত্রীর বাবার সাথে হবে না? কী আর করা? মনোক্ষুণ্ন হয়ে ফিরে এলাম। আর ওমুখো হই নি। নেড়ে কয়বার বেলতলায় যায়? আর বিয়ে করি নি। সেও পালিয়ে বাঁচল। আমিও বিয়ে না করে বাঁচলাম। সংসার নেই, ঝামেলা নেই। একা ভবতোষ। এই যে কখনও কেদার, কখনও কাদের; এভাবেই আছি। আমিই স্বামী, আমিই স্ত্রী। এই আমার সংসার।
এভাবেই কাদের এবং কেদার বলে চালিয়ে দিল তিন দিন। দার্জিলিং শহরটাই যেমন সারাক্ষণ ঘন কুয়াশায় আবৃত, কাদের কিংবা কেদারের মনটাও তেমনি রহস্যে ঢাকা। যাবার দিন বললাম—
— আজ চলে যাব। সত্যটা আজকে বলে দাও, তুমি কাদের, না কেদার?
— স্যার আসলে আমি কাদের।
— তুমি হিন্দু, না মুসলমান?
— স্যার, আমি হিন্দুও না, মুসলমানও না। আবার হিন্দুও, মুসলমানও। যা ভাবেন।
এর সাথে পারা গেল না। দার্শনিকের মতো কথা বলে। এক রকম হাল ছেড়ে দিলাম। তবুও গাড়িতে উঠে বললাম— একেবারে সত্যটা যদি বলো, তাহলে একশো টাকা বখশিস দেবো।
— তাহলে বখশিস দ্যান।
বখশিস দিলাম। খুশি হয়ে বলল— একেবারে সত্যি বলছি, স্যার, আমার নাম কেদার। কেদার চক্রবর্তী।
বললাম— ধন্যবাদ সত্যি নামটা বলার জন্য। ভালো থেকো কেদার। বাই বাই। আবার দেখা হবে কখনও হয়ত।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। পেছন পেছন কেদার হাঁটছে। গাড়ির বেগ বাড়ছে। ক্রমশ ঢালুর দিকে ছুটছে। গাড়ি যখন জোরে ছুটতে শুরু করেছে, দূর থেকে কেদার চিৎকার করে বলছে—
— স্যার, আসলে আমার নাম কেদার না। কাদের। শ্রী আব্দুল কাদের। আমার বাড়ি শিলিগুঁড়ি... আমি বিয়ে করেছি... আমার দুইটা বউ আছে; আর দুইটা বাচ্চা আছে। একটার নাম রাম, আরেকটার নাম রহিমা। স্ত্রীর নাম শ্রীমতী ...
গাড়ি ছুটে চলছে। বাকি কথা স্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট হয়ে গেল। শোনা যাচ্ছিল না। ইচ্ছে হচ্ছিল গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে গিয়ে দুই গালে দু’টো থাপ্পর কষিয়ে দিয়ে আসি। ভাবলাম, থাক সে কেদার কিংবা কাদের হয়েই রহস্যে আবৃত। ওতেই তার খুশি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কাদের কিংবা কেদার দেবদারু গাছটার পাশে আরেকটা দেবদারু হয়ে দাঁড়িয়েই রয়েছে সেই রহস্যময় হাসি এঁটে মুখে। গাড়ি বাঁক নিতেই অদৃশ্য হলো কাদের কিংবা কেদার। হাসিটা থেকে গেল অক্ষয় অম্লান হয়ে মনে। একই অঙ্গে যেন হিন্দু আর মুসলমান।
* * * *
Comments
Post a Comment