নোবেলের সাত কাহন
পুলকরঞ্জন চক্রবর্তী
এক.
নোবেল পুরষ্কার নিঃসেন্দহে বিশ্বের অন্যতম একটি সম্মানিত পুরষ্কার । প্রতি বছর অক্টোবর মাস এলেই প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীদের সাথে সাধারণ মানুষও উদগ্রীব হয়ে থাকেন নোবেল পুরস্কারের ঘোষণার দিকে । পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন , চিকিৎসার সঙ্গে সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতির মতো ছ'টি ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তি ও সংস্থাকে এই পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষিত হয় । ডিনামাইটের আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত নোবেল পুরষ্কার মানব কৃতিত্বের সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়েছে ।
এই পুরষ্কারগুলি এমন ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেয় যাদের কাজ মানুষের জীবন আরও উন্নত ও সুন্দর করে তোলে । বছরের পর বছর ধরে, নোবেল পুরষ্কারগুলি শ্রেষ্ঠত্ব,ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব মানুষকে মনে করিয়ে দেয় নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা এবং করুণা বিশ্বকে আরও ভালো কিছুর জন্য পরিবর্তন করতে পারে। এই ভাবনা থেকেই নোবেল পুরস্কার হয়ে উঠেছে সবচেয়ে অর্থবহ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি পুরস্কার ।
নোবেল পুরস্কার কেবলমাত্র বিজ্ঞান, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রগতিকেই উৎসাহিত করে না, এই পুরষ্কার অন্যদেরও মানবতার সেবা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। আজও , তাই নোবেল পুরষ্কারকে "বিজ্ঞানের এভারেস্ট " হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে ।
আলফ্রেড নোবেল তার বেশিরভাগ সম্পদই , নোবেল পুরস্কারের জন্য রেখে গিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন এই অর্থ যেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণের জন্য প্রদান করা হয়। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে, তাঁর মৃত্যুর পরে এই পুরস্কার দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছিল ।
দুই .
তাঁর পুরো নাম ছিল আলফ্রেড বারনাড নোবেল। ১৮৩৩ সালের ২১শে অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে জন্ম হয়েছিল আলফ্রেডের । নোবেলের দাদা ছিলেন একজন সেনা সার্জেন এবং তার বাবা ইমানুয়েল টেকনিক্যাল স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন।
সেন্ট পিটাসবার্গে বিজ্ঞানের পাঠ শেষ করে আলফ্রেড প্রথমে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায় । পরে, উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যান ফ্রান্সে র প্যারিসে । প্যারিসে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বিজ্ঞানী আস্কানিয়ো সোবেরোর । সোবেরোর ততদিনে নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করে ফেলেছেন । নাইট্রোগ্লিসারিনের ব্যবহারগত দিক নিয়ে গবেষণা করছিলেন তিনি । আলফ্রেড সেখানে থেকে সোবেরোর কাছে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিজ্ঞানটি ভাল করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
১৮৫২-তে তিনি ফিরে এলেন পিটার্সবার্গে , নিজের বাসভূমিতে । সেখানে ফিরেই তিনি যোগ দিলেন পারিবারিক অস্ত্রব্যবসায়। ব্যবসায় যোগ দিলেন ঠিকই, কিন্তু নাইট্রোগ্লিসারিন তাঁর মাথা থেকে সরে যায়নি । অস্ত্রের ব্যবসার পাশাপাশি নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজটিও শুরু করলেন সমান তালে । সেই সময়ে সঙ্গে পেলেন ভাই এমিলকে।
১৮৬৩ সালে নাইট্রোগ্লিসারিনের সঙ্গে বারুদ মিশিয়ে বানিয়ে ফেললেন ব্লাস্টিং অয়েল। বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য বানানো হলো ফিউজ়যুক্ত ব্লাস্টিং ক্যাপ। ব্লাস্টিং অয়েল ও ব্লাস্টিং ক্যাপ দুটোরই পেটেন্ট নিয়ে নিলেন তিনি । ব্যবসা চলছিল ভালোই কিন্তু , যুদ্ধ শেষে সব ব্যাঙ্ক একসাথে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় অর্থের অভাবে তাদের ব্যবসাটি বন্ধ হয়ে যায় ।
পিটার্সবার্গের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে পুরো পরিবার নিয়ে আলফ্রড চলে আসেন স্টকহলমে। সেখানে আলফ্রেড আর তাঁর ভাই এমিল পুনরায় নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শুরু করলেন । সেই পরীক্ষা চলাকালে একদিন এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে যায় । সেই দুর্ঘটনায় মারা যায় আলফ্রেডের ভাই এমিল। কিছুদিন পরে মারা গেলেন বাবাও । মাত্র ৩১বছর বয়সে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হলো আলফ্রেডকে। ততদিনে তাঁর ব্লাস্টিং অয়েল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, চার দিকে চাহিদা বেড়েই চলেছে । সেই অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে জার্মানি ও স্কটল্যান্ডে আরও দুটি কারখানা খুললেন আলফ্রেড। কিন্তু সবচেয়ে মুশকিল ছিল সুরক্ষার বিষয়টি । গরম কিছুর সংস্পর্শে এলেই বা ধাক্কা লাগলেই নাইট্রোগ্লিসারিনে বিস্ফোরণ ঘটে প্রচুর শ্রমিক মারা যেতে লাগলেন । সবচেয়ে ভয়ংকর দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল ১৮৬৬ সালে , জার্মানির ক্রুমেলে। এই দুর্ঘটনা পরে কারখানায় মৃত্যুমিছিল চিরতরে তাঁর জীবন বদলে দিল ।
ক্রুমেলের দুর্ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা সছিদ্র বালির স্তুপ ঘুরিয়ে দিল আলফ্রেডের জীবনের মোড়
আদি প্রাণী ডায়াটমের দেহাবশেষে নাইট্রোগ্লিসারিন ভরে, এই ছিদ্রযুক্ত বালির আবরন দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কথা ভাবলেন তিনি । তাঁর মনে হলো এমন জিনিস ধাক্কা খেলে যেমন সহজে ফাটবে না, তেমনই গরম হলেও সহজে বিস্ফোরণ ঘটবে না । এটা ব্লাস্টিং ক্যাপ দিয়ে ডিটোনেট করে ফাটানোও যাবে সহজে ।
১৮৬৭ সালে নতুন এই বিস্ফোরকটির পেটেন্ট নিলেন আলফ্রেড। গ্রিক শব্দ 'ডুনামিস' মানে প্রবল শক্তি। সেখান থেকেই এই নতুন আবিষ্কারের তিনি নাম দিলেন
' ডিনামাইট ' ।
সেই সময়ে পাথরে ফুটো করতে নিউম্যাটিক ড্রিলের আবিষ্কার বড় ভূমিকা নিয়েছে । সেই ফুটোকে ফাটিয়ে চৌচির করার সহজ পথ নিয়ে এল আলফ্রেডের 'ডিনামাইট'।শুধু পাহাড় নয়, বড় বড় বাড়ি মুহূর্তে ভেঙে দিতে ডিনামাইটের জুড়ি ছিল না। অল্প দিনেই ডিনামাইট হয়ে ওঠে একটি জনপ্রিয় বিস্ফোরক।
তিন .
১৮৮৮ সালের ১২ জুন। সকালের সংবাদপত্রে বড় বড় হরফে নিজের নাম দেখে চমকে উঠলেন আলফ্রেড । সেদিন কাগজে তিনি দেখলেন তাঁরই মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছে কাগজের প্রথম পাতায় । চমকে উঠলেন তিনি । শিরোনামে লেখা ছিল 'মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করা ব্যবসায়ীর মৃত্যু' । আসলে , পত্রিকাটি ভুল করে আলফ্রেডের ভাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গে তাঁকে গুলিয়ে ফেলেছিল। ভুল করে প্রকাশিত সেই শোক সংবাদ আলফ্রেড নোবেলকে তাঁর উত্তরাধিকার এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রভাব সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। সেই মুহূর্তটিই বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার , নোবেল পুরস্কার তৈরির অনুপ্রেরণা জোগায়।
আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট আবিস্কার করেছিলেন সহজে ঘর বাড়ি ভেঙে ফেলতে বা বিস্ফোরন ঘটিয়ে পাহাড়ে ফাটল ধরাতে । আলফ্রেড মানুষের কাজের সুবিধে হওয়ার কথা ভেবেছিলেন , শ্রমিকের কাজের সুবিধের কথা ভেবেছিলেন। তিনি মানুষ মারার কাজে ডিনামাইট ব্যবহার করতে বলেননি । কিন্তু, মানুষ ধ্বংস ও মৃত্যুর কাজে লাগালো ডিনামাইটকে। তার নিজের আবিস্কারে মানুষের নির্বিচার মৃত্যু দেখে আহত হয়েছিলেন আলফ্রেড ।
মানুষটি জীবনে কোনোদিন ধূমপান করেননি, কখনও মদের গ্লাস ছুঁয়ে দেখেননি। একাকী জীবন তাঁর , বিয়েও করেননি তিনি । তেমন কোনো বন্ধুবান্ধবও ছিল না । মৃত্যুর অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে প্রভূত অর্থের মালিক আলফ্রেড সেই সময়ে জীবনে নিরাসক্ত হয়ে পড়েন ।
প্রথম জীবনে আলফ্রেড কবি হতে চেয়েছিলেন , বেশ কিছু কবিতাও লিখেছিলেন। নিজের মৃত্যুর খবরে আলফ্রেডের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল তাঁর সযত্ন লালিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে।
চার.
১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুর এক বছর আগে, ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ৬৩ বছর বয়সে, আলফ্রেড নোবেল তার আগের উইলে পরিবর্তন করলেন । সেই উইলে উল্লেখ করলেন পুরস্কার দেওয়ার কথা । তিনি লিখলেন, তাঁর সম্পত্তির বেশিরভাগ অংশ পাঁচ ভাগে ভাগ করে নোবেল পুরস্কারের তহবিল সংগ্রহ করা হবে। সুইডিশ ভাষায় হাতে লেখা চার পৃষ্ঠার সেই উইলে তিনি সারাজীবনের সঞ্চিত ধন-সম্পদের বিলিবন্টনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন । পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসা, সাহিত্য এবং শান্তিতে পুরষ্কার দেওয়ার জন্য তিনি সঞ্চিত অর্থের একটি বড় অংশ দান করে দিলেন । নোবেলের উইলে অর্থনীতিতে পুরষ্কার দেওয়ার কোনো কথা তিনি বলে যাননি তাই নোবেলের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদ থেকেও অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কারের অর্থ আজও দেয়াও হয় না। তাঁর উইলের একটি নির্দিষ্ট অংশে এই পুরস্কার দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন,
...আমার বাকি সব সম্পদের বিলিবন্টন করা হবে এভাবে , আমার মূলধন যা আমার নির্বাহী কর্মকর্তারা নিরাপদে বিনিয়োগ করেছেন তা দিয়ে একটা তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিল থেকে বার্ষিক যে সুদ পাওয়া যাবে তা প্রতি বছর পুরষ্কার হিসেবে ভাগ করে দেয়া হবে তাদেরকে যাঁরা আগের বছর মানুষের কল্যাণে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। বছরে যে সুদ পাওয়া যাবে সেই সুদকে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে । এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করবেন , এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক আবিষ্কার বা উন্নয়ন করবেন, এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করবেন, এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি কোন আদর্শ স্থাপনের লক্ষ্যে সাহিত্যে সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন এবং এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি বা সৈন্যসংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে, শান্তি সম্মেলনের আয়োজন ও প্রচারের লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি কিংবা সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন।
তিনি আরও লিখেছেন, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের পুরষ্কার দেবে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরষ্কার দেবে স্টকহোমের ক্যারোলিন ইন্সটিটিউট, সাহিত্যের পুরষ্কার দেবে অ্যাকাডেমি ইন স্টকহোম এবং শান্তি পুরষ্কার দেবে নরওয়ের পার্লামেন্ট (স্টরটিং) কর্তৃক নিয়োজিত পাঁচ সদস্যের এক কমিটি।
এই পুরস্কার তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়ে নোবেল পুরষ্কারে পরিণত হয়। তৈরি হয় নোবেল ফাউন্ডেশন। ১৯০০ সালের ২৯ শে জুন এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছিল । আলফ্রেডের উইলের ভিত্তিতে নোবেল পুরস্কারের অর্থ ও প্রশাসন পরিচালনা করাই ছিল এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ। নোবেল ফাউন্ডেশন এই পুরস্কারের নিয়মাবলী চূড়ান্ত করার পরে নোবেল কমিটি প্রথম পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন সংগ্রহ করা শুরু করে। পরবর্তী কালে তারা প্রাথমিক নির্বাচিত প্রার্থীদের একটি তালিকাও পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে দেয়। বিভিন্ন পুরস্কারের জন্য নির্দিষ্ট সুইডিশ একাডেমি এবং নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি বিজয়ী নির্বাচন করে।
আলফ্রেড নোবেল পুরস্কারের জন্য গণিতকে তাঁর উইলে অন্তর্ভুক্ত করে যাননি। ফলে , বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় দেওয়া হলেও গণিতের উপর কোনো নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। কেন তিনি পুরস্কারের জন্য গণিতের কথা বলেননি সেই নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অনেক কৌতূহল এবং জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গণিতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনা করেই তৈরি হয়েছে এই জল্পনা । বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সম্ভবত গণিতকে তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে দেখেছিলেন আলফ্রেড , আর সেই কারণেই হয়তো তিনি গণিতকে পুরস্কারের জন্য ভাবেননি ।
তিনি সেই ক্ষেত্রগুলোই বেছে নিয়েছিলেন যেখানে মানবজাতির উপকার হতে পারে। এছাড়া, যেহেতু মর্যাদাপূর্ণ কয়েকটি গণিত পুরষ্কার তখন প্রচলিতই ছিল, যেমন সুইডিশ গণিতবিদ গোস্টা মিত্তাগ-লেফলারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পুরস্কার , সেই কারনে নোবেল হয়তো আরও একটি প্রতিযোগিতামূলক পুরষ্কার দেওয়ার কথা ভাবেননি ।
পাঁচ
১৮৯৬ সালে নোবেলের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর, ১৯০১ সালে প্রথম নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়েছিল।
পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসা, সাহিত্য এবং শান্তির ক্ষেত্রে মোট পাঁচটি নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে, অর্থনীতি বিজ্ঞানে পুরষ্কার দেওয়ার প্রচলন হলে নোবেল পুরস্কারের সংখ্যা দাঁড়ায় ছ'য়ে। অর্থনীতির পুরষ্কারটি আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল পুরষ্কার না হলেও এটি আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে "দ্য সেভেরিগেস রিক্সব্যাঙ্ক পুরষ্কার" নামে পরিচিত। এই পুরস্কারটি সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেভেরিগেস রিক্সব্যাঙ্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য এবং অর্থনীতির অনুষ্ঠানটি সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয়, যার সভাপতিত্ব করেন সুইডেনের রাজা। নরওয়ের অসলোতে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি দেয় নোবেল শান্তি পুরস্কার।
পুরস্কার গ্রহণের সময়ে বিজয়ীরা নোবেল বক্তৃতাগুলিতেও অংশগ্রহণ করেন, যেখানে তারা তাদের গবেষণা বা মানবিক কাজের অন্তর্দৃষ্টি বিশ্ববাসীর সঙ্গে ভাগ করে নেয়। আলফ্রেডের উইলের মর্মানুসারে পুরস্কার প্রাপকদের হাতে একটি স্বর্ণপদক, ডিপ্লোমা এবং আর্থিক পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এই আর্থিক পুরস্কারের মূল্য বর্তমানে ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা যেটি ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১০.৩ কোটি টাকা । নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত ব্যক্তি ' নোবেল লরিয়েট ' হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়ে থাকেন ।
নোবেল লরিয়েটদের যে স্বর্ণপদকটি দেওয়া হয়, সেটি অবশ্য বিশুদ্ধ সোনার তৈরি নয়। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ২৩ ক্যারেট সোনা দিয়ে নোবেল পুরস্কারের পদক তৈরি করা হয়েছিল । পরে, ১৮ ক্যারেটের সোনা দিয়ে পদক তৈরি করা শুরু হয়। ১৮ ক্যারেটের সোনার পদকে দেওয়া থাকে ২৪ ক্যারেটের সোনার প্রলেপ।
১৯৮০ সালের পর থেকে স্বর্ণপদকের বিশুদ্ধতাই কমেনি , কমে যায় ওজনও। আগের পদকগুলির ওজন হতো ২০০ গ্রাম আর এখন সেটি দাঁড়িয়েছে ১৭৫ গ্রামে।
ছয়.
প্রথম নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০১ মার্চ ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমের গ্র্যান্ডে হোটেলে এক ভোজসভার মাধ্যমে । সেই ভোজসভায় ১১৩ জন পুরুষ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সেই বছরেই এক্স-রে আবিষ্কারের জন্য প্রথম নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল উইলহেম রন্টজেনকে। এটি ছিল পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার। চিকিৎসায় প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জার্মান চিকিৎসক ও অনুপ্রাণবিজ্ঞানী এমিলি ভন বেরিং। ১৮৯০ এর দশকে তিনি ডিপথেরিয়া প্রতিরোধক তৈরি করেন, যা আজও হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করে চলছে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ১,০১২ জন ব্যক্তি ও সংস্থা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন , এদের মধ্যে কেউ কেউ একাধিকবার পুরস্কার লাভ করেছেন, মোট ৮৯২ জন ভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা এই সম্মাননা অর্জন করেছেন। এই বছরে এই তালিকায় যুক্ত হলেন আরও ১৪ জন।
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মালালা ইউসুফজাই। ২০১৪ সালে তিনি মেয়েদের শিক্ষার জন্য লড়াই করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। অন্যদিকে মার্কিন পদার্থবিদ জন বি. গুডেনাফ হলেন সবচেয়ে বয়স্ক নোবেল লরিয়েট যিনি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে তার কাজের জন্য ৯৭ বছর বয়সে ২০১৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
এখন পর্যন্ত মোট নয়জন ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। প্রথম এশীয় হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ১৯১৩ সালে তাঁর বিখ্যাত রচনা গীতাঞ্জলির জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি দু'বার নোবেল পুরষ্কার জিতেছেন। এদের একজন হলেন জন বার্ডিন যিনি পদার্থবিজ্ঞানে প্রথমবার ১৯৫৬ সালে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের জন্য এবং দ্বিতীয় বার ১৯৭২ সালে অতিপরিবাহিতার (সুপারকন্ডাক্টিভিটি) তত্ত্ব উদ্ভাবনের জন্য এই পুরষ্কার পেয়েছিলেন । আরেকজন হলেন পোলীয় ও ফরাসি বিজ্ঞানী মেরি কুরি । মেরি কুরি ছিলেন নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী ও একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি দুটি ভিন্ন বিজ্ঞান ক্ষেত্রে দুটি নোবেল পুরষ্কার জিতেছেন । ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞান এবং ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল তাঁকে । তার আবিষ্কারগুলি আধুনিক পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার ১৯৫৮ সালে রসায়নে নোবেল পান ইনসুলিন অণুর গঠন নির্ধারণের জন্য। ১৯৮০ সালে পুনরায় তিনি রসায়নে নোবেল পেয়েছিলেন ভাইরাসের নিউক্লিওটাইড ধারা বা ডিএনএ সিকুয়েন্সিং উদ্ভাবনের জন্য। তিনি ছিলেন রসায়নে দুবার নোবেলজয়ী প্রথম বিজ্ঞানী।
২০০১ সালে শার্পলেস রসায়নে নোবেল পান কাইরালি-অণুঘটিত জারণ বিক্রিয়ার জন্য। এরপর ২০২২ সালে তিনি আবার রসায়নে নোবেল পান ক্লিক কেমিস্ট্রি ও বায়ো–অর্থোগোনাল কেমিস্ট্রির উন্নয়নের জন্য। স্যাঙ্গারের পর তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি রসায়নে দুবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ।
মার্কিন রসায়নবিদ লিনাস পাউলিং হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি রসায়ন এবং শান্তিতে দুটি আলাদা ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তিনি রাসায়নিক বন্ধন বোঝার এবং বর্ণনা করার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করেছিলেন। পরে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালিয়েছিলেন। পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আবেদনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি । ১৯৫৪ সালে রসায়নে এবং ১৯৬৩ সালে শান্তিতে দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন পাউলিং ।
মানবতার সেবায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার কারণে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস ১৯১৭, ১৯৪৪ ও ১৯৬৩ সালে তিনবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা ও আহতদের চিকিৎসা প্রদানে এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিশ্বব্যাপী শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সহায়তায় অসাধারণ অবদানের জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর)
১৯৫৪ এবং ১৯৮১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে।
নোবেলের দীর্ঘ ইতিহাসে দুজন স্বেচ্ছায় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই দুজনের প্রথমজন হলেন ফরাসি দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে এবং দ্বিতীয়জন ভিয়েতনামের সংগ্রামী রাজনীতিবিদ লে দুক তাও।
ফরাসি লেখক জঁ পল সার্ত্রে ছিলেন অস্তিত্ববাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা । তাকে আধুনিক অস্তিত্ববাদের জনকও বলা হয়। সার্ত্রের অসাধারণ কাজের মধ্যে রয়েছে, 'বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস' শীর্ষক বইটি। যেখানে তিনি তাত্ত্বিকভাবে অস্তিত্ববাদের উপর তাঁর মতামত উপস্থাপন করেছেন। ইউরোপের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয় কেমন ছিল, সেটা গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
পল সার্ত্রে ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি এই পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন , নোবেল এমন এক সম্মান, যা পাশ্চাত্যের লেখক এবং প্রাচ্যের বিপ্লবীদের বাক্রুদ্ধ করে দেয়।
তিনি বলেছিলেন , আলজেরিয়ায় যুদ্ধ চলাকালে তাঁরা ১২১ জনের স্বাক্ষরিত বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন, তখন তাঁদের পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দিলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে সম্মানিত করা হয়েছে বলে তাঁরা তা গ্রহণ করতেন। সংগ্রামের শেষে পুরস্কৃত হতে তিনি তাঁর অপারগতা প্রকাশ করেন।
১৯৭৩ সালে ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা লে দুক তাও এবং মার্কিন জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল নোবেল কমিটি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ঘটাতে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে এই দুজনের মুখ্য ভূমিকা ছিল । কিন্তু লে দুক তাও পুরস্কার নিতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন । কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভিয়েতনামে প্রকৃত শান্তি তখনও ফিরে আসেনি। যেহেতু শান্তিই প্রতিষ্ঠা হয়নি, সেহেতু শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য কোনো পুরস্কার তিনি গ্রহণ করতে পারেন না। সুইডিশ একাডেমি পঞ্চাশ বছর ধরে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন বা বাছাইয়ের সব তথ্য গোপন করে রাখে। তাই এই চিঠির কথা জানা যায় ৫০ বছর পরে। হেনরি কিসিঞ্জার ও লে দুক তাওকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রতিবাদে সেই সময়ে নোবেল কমিটির দুই সদস্য পদত্যাগও করেছিলেন। কারণ হিসেবে তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও ভিয়েতনামে যুদ্ধ বন্ধ না হওয়াকেই তুলে ধরেছিলেন ।
বার্ট্রান্ড রাসেলও প্রাথমিক ভাবে নোবেল নিতে তাঁর অসম্মতি প্রকাশ করেছিলেন , কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা গ্রহণ করেছিলেন ।
প্রায় ছয় দশক আগে ১৯৫৮ সালে মস্কোর ঔপন্যাসিক ও কবি বরিস পাস্তারনাককে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। সমসাময়িক গীতিকবিতা এবং মহান রাশিয়ান মহাকাব্য রচনায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
তিনি প্রাথমিকভাবে এই সম্মান গ্রহণ করলেও পরে তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের চাপের মুখে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
হিটলারের নিষেধাজ্ঞার কারণে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েও পুরস্কার নিতে আসতে পারেননি তিন জন জার্মান বিজ্ঞানী। ক্যারোটিনয়েড ও ভিটামিন নিয়ে কাজ করার জন্য ১৯৩৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন জার্মান জৈব রসায়নবিদ রিশার্ড কুন। রিশার্ড কুন নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেননি। সব জার্মান নাগরিকদের জন্য নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৯৩৭ সালে অ্যাডল্ফ হিটলার একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। হিটলারের জারি করা নিষেধাজ্ঞার কারণেই কুন নোবেল পুরস্কার নিতে পারেননি । একই কারণে পুরস্কার নিতে পারেননি অ্যাডলফ বুটেনান্ডও। ১৯৩৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ক্রোয়েশিয়ান বিজ্ঞানী লিওপোল্ড রুজিকার সাথে যৌথভাবে জার্মান জৈব রসায়নবিদ অ্যাডলফ বুটেনান্ড । যৌন হরমোন নিয়ে গবেষণার জন্য তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল । তিনিই প্রথম একটি বিশুদ্ধ পুরুষ যৌন হরমোন তৈরি করতে এবং এর রাসায়নিক গঠন নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাকে বলা হয়েছিল , 'অ্যান্ড্রোস্টেরোন'।
বঞ্চিতদের তালিকায় ছিলেন আরও একজন । জার্মান প্যাথলজিস্ট ও ব্যাকটিরিওলজিস্ট গেরহার্ড ডোমাকক ১৯৩৯ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পেয়েও সেটি নিতে যেতে পারেননি হিটলারের নিষেধাজ্ঞার কারণেই । পরবর্তীকালে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে ডিপ্লোমা সনদ ও পদক তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল , কিন্তু পুরস্কারের অর্থ তাঁর কাছে পৌঁছায়নি।
সাত.
এই বছরে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ীদের নাম ৬ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবরের মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে । শান্তি পুরস্কারের ঘোষণা হয়েছিল অসলোতে , অন্য পুরস্কারের ঘোষণা হয় স্টকহোমে । ডিসেম্বরের ১০ তারিখে আলফ্রেডের জন্মদিনে প্রাপকদের হাতে তুলে দেওয়া হলো সেই পুরস্কার ।
২০২৫ সালের চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মেরি ই. ব্রুনকো, ফ্রেড র্যামসডেল এবং শিমন সাকাগুচি৬ অক্টোবর এই তিন বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণা করে সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেমব্লি। মেরি ই ব্রাঙ্কো যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেলের ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেমস বায়োলজির গবেষক, ফ্রেড র্যামসডেল যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর সোনোমা বায়োথেরাপিউটিক্সের গবেষক এবং শিমন সাকাগুচি জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্সের উপর তাদের যুগান্তকারী গবেষণার জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন তারা। এই গবেষণার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আমাদের ধারণায় বিপ্লব এসেছে এবং অটোইমিউন ডিসঅর্ডার, ক্যান্সার এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেমব্লি এক বিবৃতিতে বলেছে, 'তাদের আবিষ্কার গবেষণার একটি নতুন ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং নতুন চিকিৎসার বিকাশকে উৎসাহিত করেছে।'
পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ. ডেভোরেট এবং জন এম. মার্টিনিস। বৈদ্যুতিক সার্কিটে কোয়ান্টাম টানেলিং এবং শক্তির স্তরের উপর তাদের যুগান্তকারী গবেষণা অণুবীক্ষণিক কোয়ান্টাম জগৎ এবং ম্যাক্রোস্কোপিক বাস্তব জগতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তৈরি করেছে। এই অর্জন কোয়ান্টাম কম্পিউটার, নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং উন্নত সেন্সিং প্রযুক্তির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
ধাতব-জৈব কাঠামো (MOFs) আবিষ্কারের জন্য জাপানের কিউটো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সুসুমু কিতাগাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রিচার্ড রবসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ওমর এম. ইয়াঘিকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে রসায়নে । ধাতব-জৈব কাঠামো বিশিষ্ট পদার্থগুলিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্থান রয়েছে যা গ্যাস আটকে রাখতে পারে, ক্ষতিকারক রাসায়নিক সঞ্চয় করতে পারে, বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পারে এবং এমনকি শুষ্ক বাতাস থেকে জল সংগ্রহ করতে পারে, এগুলো বিজ্ঞান এবং পরিবেশের জন্য যথেষ্ট সুবিধা প্রদান করে।
বিশৃঙ্খলা ও হতাশার মধ্যে শিল্পের স্থায়ী শক্তি তুলে ধরার জন্য হাঙ্গেরীয় লেখক লাসজলো ক্রাস্নাহোরকাইকে দেওয়া হয়েছে সাহিত্যের নোবেল পুরষ্কার । তার অনন্য লেখার ধরণটির জন্যই তিনি পরিচিত। ক্রাস্নাহোরকাই অযৌক্তিকতা, গভীর প্রতিফলন এবং কাব্যিক গল্প বলার মিশ্রণ ঘটিয়ে মধ্য ইউরোপীয় সাহিত্য ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এবং পূর্ব দর্শন থেকে অনুপ্রেরণাও গ্রহণ করেছেন।সুইডিশ অ্যাকাডেমি বলেছে, আকর্ষণীয় এবং দুরদর্শী রচনার জন্য তাকে এ বছর সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তার লেখনি বৈশ্বিক ভয়াবহতার মধ্যে শিল্পের শক্তিকে পুনরায় নিশ্চিত করেছে।
লাসজলো ক্রাস্নাহোরকাই তার ডিস্টোপিয়ান ও বিষণ্ণতাময় উপন্যাসগুলোর জন্য বিখ্যাত। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে, সাটানট্যাঙ্গো, দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স। এগুলো পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। তিনি ২০১৫ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার জেতেন।
২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলায় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের সাহসী নেত্রী মারিয়া করিনা মাচাদো । অবাধ নির্বাচন, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের জন্য তার নিরন্তর লড়াইকে সম্মান জানিয়েছে নরওয়ের নোবেল কমিটি। তার সাহস এবং শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ লক্ষ ভেনেজুয়েলার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে যারা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছেন এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছেন ।
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনজন অর্থনীতিবিদ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষক জোয়েল মোকির, ফ্রান্সের নাগরিক ও কলেজ দে ফ্রান্স এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের গবেষক ফিলিপ আগিয়োঁ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি, প্রভিডেন্সের অধ্যাপক পিটার হাউইট। উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁরা এই পুরস্কার পেলেন। তারা দেখিয়েছেন, উদ্ভাবনই ভবিষ্যৎ অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি। তাঁদের গবেষণা মনে করিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয় বা নিশ্চিত কোনো প্রক্রিয়া নয়।নোবেল কমিটি তাদের বিবৃতিতে বলেছে, গত দুই শতাব্দীতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্ব দেখেছে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এর ফলে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ, আর এর ওপরই গড়ে উঠেছে আমাদের সমৃদ্ধির ভিত্তি। এ বছরের অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী-জোয়েল ময়কার, ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট দেখিয়েছেন, কীভাবে উদ্ভাবন আরো অগ্রগতির প্রেরণা হতে পারে ।
এই তিন অর্থনীতিবিদের মধ্যে অর্ধেক পুরস্কার পেয়েছেন জোয়েল মোকির। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্তগুলো শনাক্ত করার জন্য তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। 'সৃজনশীল বিনাশ' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধির তত্ত্ব দেওয়ার জন্য বাকি অর্ধেক পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছেন ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট। রয়টার্সের তথ্যানুসারে, এই পুরস্কারের মূল্য প্রায় ১২ লক্ষ ডলার।
যথারীতি দ্বন্দ্ব রইল, মতান্তর রইল। পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বিতর্কও থেকে গেল। কিন্তু নোবেল পুরস্কারের গুরুত্ব এতে এতটুকুও কমে যাচ্ছে না। আলফ্রেড নোবেল যেমন ছিলেন তেমনই থাকলেন চিরস্মরণীয় হয়ে । থেকে গেল তাঁর স্মরণে তৈরি নোবেল পুরস্কারও।
=====================
Pulakranjan Chakraborty
Village- Jatadharpur
PO- KALARA
Dist Paschim medinipur
Pin no : 7365933874

Comments
Post a Comment