সাধুর আশীর্বাদ
কল্যাণ সেনগুপ্ত
একটু খেতে দিবি ভাই ? পায়ে ফোস্কা তাই ভিক্ষা করতে যেতে পারিনি। কাতর স্বরটা কানে লাগল ধড়াস করে। শুনে ঘন্টুর চোখ যায়। বট গাছের বাঁধানো চত্বরে, ছায়া মাখা রোদ্দুরে এক মাথা এলোমেলো চুল আর দাঁড়িতে এক সাধু দাঁড়িয়ে। গোল বাঁধানো চত্বর, পিছন দিয়ে উনি এসেছে তাই চোখে পড়েনি। বাঁধানো চত্বরে রাখা তার ঝোলা আর লাঠি। এখানে এমন সাধুর উপস্থিতি তেমন দেখা যায় না। নেহাত জুতোর ফিতে খুলে যেতেই বসেছিল বেদি তে জুতো বাঁধতে। আজ আবার ক্লাস সেভেনে তৃতীয়বার শুরু। আগের দুবার একটুর জন্যে পাস করাটা হাত ফস্কেছে । মনটা খারাপ আবার আজ জন্মদিনে টিফিন বাক্স ভর্তি ওর পছন্দের আলুর পরোটা আর সাদা আলুর তরকারি । আরেকটা বাটিতে চালের পায়েস। আজ যা একটা টিফিন হবে না ,ওফ, এই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল ঘণ্টু।
জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়েই সব গুলিয়ে গেল। মাথায় জটা, মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি। পরনে একটা গেরুয়া ধুতি আর সাদা ফতুয়া। দুটোই বেশ মলিন। কত ধুলো বালি লেগে। এরকম সাধু এত কাছ থেকে ও দেখেনি। বড় বড় ক্ষুধার্থ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে হল আহা ,কতদিন খায় নি কে জানে। সাধু বললে পয়সা নেই। তাই খেতে পারিনি। নরম মনের ঘণ্টু মাথা নীচু করে ব্যাগ থেকে টিফিন বাক্সের কৌটো দুটো বার করে এগিয়ে দিলে এই নিন ।এইটুকু আমার আছে। আপনি খান ।
হাত পেতে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার টিফিন বুঝি ? তাহলে তুমি কি খাবে? না,না থাক।
পায়েসের জন্যে কষ্ট টা চেপে রেখে বললে থাকবে কেন ? ও আমি বন্ধুদের সাথে ওদের টিফিন ভাগ করে খাবো। প্রায়ই খাই। আপনি খান। স্কুল থেকে ফিরবার সময় বাক্স দুটো নিয়ে যাব। নাহলে মা মারবে।
বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় বল নাচাতে নাচাতে ফিরছিল ঘণ্টু। খেয়াল করেনি বট তলায় সেই সন্যাসী তখনো বসে। তিনি ই ডাকলেন ও খোকা, ও খোকা। এদিকে এদিকে। ঘণ্টু চোখে পড়তে এগিয়ে গেল । কাছে যেতেই পিঠে হাত বুলিয়ে স্নেহ মিশ্রিত গলায় বললে খুব ভালো খেয়েছি দাদা। তুমি খুব দয়ালু। ভগবান তোমার ঠিক ভালো করবে। ঘণ্টু অবাক, আপনি ওনাকে চিনেন?
চোখ বুজে বললেন খুব চিনি।
সঙ্গে সঙ্গে পরের প্রশ্ন উনি কি আমাকে পাশ করিয়ে দিতে পারেন ?
হাত ঘুরিয়ে শূন্যে তুলে সাধু বাবা বললে আলবাত। চাই কি তোমায় হিমালয়ের চূড়ায় ও তুলে দিতে পারেন। ঘণ্টু খানিক এগিয়ে বলে একবার শুধু পাশ করিয়ে দিক উনি। " কেন? তুমি স্কুলে পাশ করতে পারছ না?
কাঁচুমাচু উত্তর ,এতদিন কোনোরকমে হয়ে যাচ্ছিল। এই সেভেনে এসেই আটকে গেল। গোল পাকালো। অনুযোগের সুরে বলে জানেন ভূগোল, ইতিহাস যেন আমাকে গিলে খেতে চায়? করুন হয় গলা। আসলে আমার পড়াশুনাটা তেমন ভালই লাগে না।
সাধুবাবা হেসে ফেলেন ।আমারও তাই ছিল তোমার মত। ঠিক আছে । তাহলে আজ নয়। কাল ভালো দিন আছে । এবার সাধুদের স্বভাব সিদ্ধ ভাবে তুই তে নেমে আসে। তোকে আমি একজন সাথীকে দেব যে তোকে ঠিক পাশ করিয়ে দেবে। কাল বিকেল চলে আসিস। কাল তোর পাশের ব্যবস্থা করব।
চোখদুটো উজ্জ্বল হয় ওঠে । তাই? ঠিক আছে আমি আসবো। মনে মনে ভাবতে ভাবতে ও বাড়ি যায়। কে আসবে ওর সঙ্গে ? তাহলে তাকে রাখবে কোথায়? রাত্রে বাবা মুদির দোকানের থেকে ফিরে বাইরের কাউকে দেখলে এমন রেগে যাবে যে রাত্রে দু দুবার উঠে পড়লে ঘুম ভেঙে।
পরদিন কোনো রকমে স্কুল ফেরত সাধু বাবার কাছে হন্তদন্ত হয়ে চলে এসেছে । কাউকে রাখার অসুবিধা সমস্ত টা বলতে হবে ।
চারিদিক খালি লোকজন নেই। সন্ধ্যে হয়ে আসছে ।
ব্যস্ত হয় ঘণ্টু আজ দেবে বলেছিলে ?
দেবো তো। আগে আমার পাশে চুপটি করে বস দেখি।
জটা র চুল গুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে পদ্মাসনে বসে চোখ বুজে ডান হাতের তালু ঘণ্টু র মাথার ওপর রেখে বললে চোখ বন্ধ, চোখ বন্ধ। তারপর হিং বিং করে বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র পড়লে। তারপর পিঠে হাত রেখে বললে যা ঈশ্বরকে তোর সঙ্গী করে দিলাম। আর কেউ তোকে রুখতে পারবে না। টিচার রা তো কোন ছার।
ঘণ্টু র মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । সত্যি? পারব আমি? কিন্তু কোথায় সে ?কোথায় ঈশ্বর ?
সাধু বাবা হাসলে বুকের মধ্যে হাত রেখে সে বললে ওনাকে একেবারে দিয়েছি ভিতরে চালান করে। আর চিন্তা নেই।
চিন্তায় পড়ে ঘণ্টু।
এবার আমি কি করব?
উনি সব মনে রাখতে পারেন একবার শুনেই।তোর কাজ রোজ কি পড়া হল ওনাকে শুনিয়ে রাখা। উনি মনে রেখে ঠিক সময় তোকে মনে করিয়ে দেবেন। ব্যস হয়ে গেল।
বলে দু হাতে তালি দিয়ে হাতের ধুলো ঝাড়ে । স্কুলের পরীক্ষা তো কোন ছাড় অফিসের পরীক্ষা ও পাশ হয়ে যাবে।
তাই? অবিশ্বাস্য, শুধু ওনাকে.......। ভয় ধরায়,কিন্তু শোনাবো কি করে?উনিতো আমার বুকের মধ্যে। ঘণ্টু র ব্যাপারটা বোধগম্য হয় না।
কোনো ব্যাপার নয়। উনি চুপটি করে বসে থাকবেন ভিতরে । প্রত্যেক দিন স্কুলে যা পড়াচ্ছে সেটা বাড়ি এসে ওনাকে শুনিয়ে দিতে হবে। কারণ ওনার স্কুলে যাওয়া বারণ।
কেন?
নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। হেসে গলা তুলে আশ্বস্ত করে তোর তো পড়াশুনা করতেই হবে না। ঘণ্টু র অবিশ্বাস্য লাগে এ ছাড়া আমাকে পড়তেই হবে না? পাশ করে যাবো? বাহ!
ওই যে বললাম কষ্ট করে একবার শুনিয়ে দিলেই তুই নিশ্চিন্ত।
তাহলে বাড়ি যাই আজ ?
হ্যা, শুধু খবরদার, কেউ যেন না জানে ওনার কথা। তাহলেই সব ম্যাজিক ভ্যানিশ। ব্যস, এবার শুধু দেখবি পাশ কাকে বলে। একেবারে তরতর করে পাশ কাটিয়ে পাশ। ফেল আর তোকে ছুঁতে পারবে না।
গদগদ ঘণ্টু খানিক এগিয়ে ফিরে আসে । ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বলে আপনি আমার খুব উপকার করলেন।
ছোট ভাই ফটিক হঠাৎ ডেকে উঠল দাদা, দাদা।
ঘণ্টু তাকালে ভাইয়ের দিকে কি বলছিস ? সন্ধ্যে বেলা এক টেবিলে বসে দুজনে পড়াশুনা করে। ফটিক দু বছরের ছোট । পড়ে এখন দুজনে একই ক্লাসে। উদ্বিগ্ন স্বরে ফটিক বলে তুই এমন বিড়বিড় করছিস কেন? তুই তো এমন ভাবে পড়িস না। তোর কি শরীর খারাপ ?
ঘণ্টু হাসলে বুঝবি না। ক্রিকেট খেলার স্ট্যান্স বদল করার মত স্টাইল পাল্টাচ্ছি । আমার কাজ তো শুধু স্কুলে কি পড়িয়েছে সেটা ওনাকে বলে দেওয়া ব্যস। খতম।
ওপর থেকে নীচ অবধি দাদা কে দেখে জিজ্ঞাসা করে তাহলে কে উনি ? ঘরে তো আর কেউ নেই।
সর্বনাশ ,সেটা বলা বারণ । কথা ঘোরায়, বুঝলি না ? নিজেকে, নিজেকে।
কি যে বলিস? বুঝতে পারি না। দাদার দার্শনিক কথায় বিরক্ত হয় ফটিক।
বাড়িতে বাবা, মা ,ভাই কেউ সাধু বা আর কথা জানে না। কিন্তু শুতে গিয়ে ঘণ্টু র মনে পড়ল সব তো বলা হয়েছে কিন্তু বাংলা ক্লাসে কি পড়ানো হয়েছিল সেটাতো বলা হয় নি। একদম বেমালুম ভুলে গেছিল। আবার সেটা মনেও পড়ছে না। তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে আগে বই খোলে। এক ঝলক দেখে নিয়ে শুয়ে শুয়ে ই ওনাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়। যাক পড়াশুনা তো আর করতে হচ্ছে না ।নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ঘণ্টু।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরবার পথে ওনার সঙ্গে দেখা গাছ তলায়। চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করেন কি সব ঠিকঠাক রেখেছ তো ভায়া ,ঈশ্বরকে? দেখো অযত্ন যেন না হয়। সব শুনিও যা পড়ছ স্কুলে। খবরদার আর কেউ যেন না জানে।
দিনগুলো ভালই কাটছে। দিব্যি ফুরফুরে। ক্লাসে কিন্তু মাঝে মাঝেই স্যারের প্রশ্নের উত্তর গুলো মুখের ডগায় কেমন করে যেন চলে আসছে। অনেক সময়ে পাশের কাউকে স্যার কিছু জিজ্ঞেস করলে দেখছে সেই উত্তর টা ও জানে। তার মানে ভিতরের সেই ঈশ্বর না কি সে ভিতর থেকে বলে দিচ্ছে। বেশ মজা ই লাগছে। দেখতে দেখতে এসে গেল হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা। আশ্চর্য , এক বার বই নিয়ে বসলেই সব পাতা গুলো দিব্যি এসে সামনে দাড়িয়ে পড়ছে। চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছে পাতার পর পাতা। যেন বই পড়ছে চোখ বুজে। ভুরু কুঁচকে ফটিক দুলে দুলে পড়ছে অথচ ঘণ্টু র তেমন হেলদোল নেই। বইটা সামনে নিলেই পাতাগুলো একের পর এক চলে আসছে মনে। দেখতে পাচ্ছে। ঐতো সিরাজ যুদ্ধ করছে , এইতো ক্লাইভ বন্দী করছে, বাবর থেকে বাহাদুর শা যেন পর পর বসে চেয়ারে। ঐতো হিমালয়, ওই মরুভূমি,ঐতো গঙ্গা, বিয়াস, যমুনা আর জঙ্গল। আটলাস ম্যাপটা যেন ক্রমশ বই ছেড়ে বড় হচ্ছে। বড় হচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে। অংকের করা খাতাগুলো যেন যেন পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে চোখের সামনে। সত্যি সাধু বাবার জবাব নেই। ফটিক ভাবছে এবার দাদা কে গ্রাম ছেড়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হবেই আর পুরো ঘরটা ওর হবে।
পরীক্ষার শুরুর দিন গাছতলা ফাঁকা। উনি কি কোথাও গেছেন? ভিক্ষা করতে বেড়িয়েছেন ?
প্রশ্ন পত্র দেখার পর আর দেখার সময় নেই , একটার পর একটা পয়েন্টস, উত্তর চলে আসছে। পেন্সিল চিবুতে চিবুতে ফটিক মুখ ঘুরিয়ে দেখলে দাদা এত কঠিন প্রশ্নের মধ্যেও খাতায় কিসব লিখছে , লিখেই চলেছে। ফটিক এদিকওদিক চেয়ে বারবার বাথরুমে গিয়েও কিছু কিনারা পেলে না ভাব সম্প্রসারণের, ব্যাকরণের। দাদা এদিকে একবার তাকাচ্ছেও না। ও কি জানে? উল্টে খাতায় লেখা শেষ করে বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে উল্টে পাল্টে দেখে জমা দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘণ্টু।
মন পড়ে আছে গাছ তলায়। কিন্তু ফিরবার পথে উনি নেই। এবার কেমন অসহায় লাগে। কাল থেকে কি হবে ঈশ্বর যদি ঘণ্টু র কথা না শোনে?
পুরো পরীক্ষা শেষ হল তারপরেও সাধু বাবার আর দর্শন পাওয়া গেল না উনি যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমনি হঠাৎ মিলিয়ে গেলেন।
দুচারদিন যেতে না যেতেই একদিন স্কুলে ভীষণ কান্ড । সারা গ্রামে র লোকজন দারুন উত্তেজিত। হেড মাস্টার প্রেয়ার হলে বলেছেন লড়াই করে কি করে ফিরে আসতে হয় ঘণ্টুর কাছ থেকেই সবাই যেন শেখে। বোমা টা ফাটিয়ে নাকি বলেছেন , দু বছরের ফেলু ঘণ্টুই নাকি সেভেনে তিন বিভাগ মিলিয়ে হাফ ইয়ারলি তে প্রথম । কি করে সম্ভব? ক্লাসের প্রথম দশজন হেড মাষ্টারের কাছে ঘণ্টুর খাতা দেখতে চাইলে । নিখুঁত উত্তর দেখে কেউ কেউ বললে ঘণ্টু জালিয়াতি করেছে। প্রথম যে হয় তিলক জিজ্ঞেস করেই ফেলল।কোন মানে বই পড়েছিস রে? আমায় একটু বল। আমিতো তোর বন্ধু।
ঘণ্টু বলেনি, বলতে পারেনি। বললে তারা বিশ্বাস করবে কিনা জানা নেই। ওতো পড়াশুনা করেই না, শুধু চুপিচুপি খবর গুলো দিয়ে রাখে ঠিক জায়গায় । এরপরে দিব্যি ঈশ্বরের পিঠে চড়ে টগবগ করে একের পর এক ক্লাস ডিঙিয়ে চলেছে সে। আগের দ্বিতীয়,তৃতীয়, চতুর্থ এরা খুঁজে চলেছে রহস্য টা কোথায় ? কপিধ্বজে চড়েছে, কোথায় ঘণ্টু থামবে কেউ জানে না।

Comments
Post a Comment