শীতের অদৃশ্য উষ্ণতার
আবু সাঈদ
হে প্রিয়জনেরা,
সেটি ছিল এমন এক রাত্রি, যেখানে বাতাস নিজের নিশ্বাসকেও ভয় পেত,
আর তারার আলো যেন আকাশের জমাট ঠান্ডায়
কম্পিত হয়ে উঠেছিল, ঠিক শিশিরবিন্দুর মতো, যা ভোরের আগে জন্মেই যেন মৃত্যুকে চেনে।
শীত এসে শহরের দরজায় কড়া নাড়ল না,
বরং জরজরিত রাজকীয় অচঞ্চলতায়
ঠিক তেমনি প্রবেশ করল,
যেন কোনো সুলতান নিদ্রিত প্রাসাদের ফটক হঠাৎ খুলে
নীরব পদচারণায় সিংহাসন দাবি করে।
তার পদক্ষেপে ধুলো জমাট বসল,
তার নিঃশ্বাসে ঘুমন্ত পথিকের হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরল,
আর সে এমনভাবে পৃথিবীর গায়ে চাদর বিছাল,
যেন রাত নিজেই ক্লান্ত হয়ে আকাশ থেকে নেমে এসে
মাটির বুকে বিশ্রাম নিতে চাইল।
সেদিন আমি দেখা পেলাম এক অপরিচিতের,
সে ছিল না ধনী, না গরিব; না পথিক, না বসতি-বাসী।
তার পরিচয় ছিল বাতাসের মতোই অদৃশ্য,
আর কথাবার্তা ছিল তেমনই সুচারু,
যেন শব্দ তার কাছে দাস, ছন্দ তার বাহন।
সে বলল:
হে যাত্রী, শীতকে কি তুমি কেবল কামড়ানো হাওয়া ভাবো?
না!
শীত হল সময়ের নীরব পণ্ডিত,
যে আমাদের শেখায়
আগুনের দাহ কত আশীর্বাদের,
আশ্রয় কত দয়ার,
আর মানুষের উষ্ণতা কত মহৎ সঙ্গ।
তার কণ্ঠে ছিল এমন ভার,
যেন দূর মরুভূমির বুকে ঘুরে বেড়ানো প্রাচীন কবির ধ্বনি,
যার প্রতিটি শব্দ
রূপকের তলোয়ার,
উপমার জাল,
প্রতীকের কাফেলা নিয়ে আসে।
আমি বললাম,
তুমি কে, যে শীতের মাহাত্ম্যকে বিষাদের পোশাকে সাজিয়ে
এমন সৌন্দর্যের পুষ্পমাল্য পরালে?
সে হেসে উঠল
ঠিক তেমনি,
যেমন বরফের উপর সূর্য প্রথম ছোঁয়া দিলে গলে যাওয়া স্ফটিকের আলো।
বলল:
আমি সেইজন,
যাকে শহর ভুলে যায়,
কিন্তু ঋতু মনে রাখে;
আমি সেই সুর,
যা কেবল শীতে শোনা যায়
মানুষের হৃদয়ের কম্পন,
যা উষ্ণতার অভাবে আরও স্পষ্ট হয়।
আমরা হাঁটলাম কুয়াশার গলিপথ ধরে।
শীত ছিল আমাদের সঙ্গী,
আর বাতাস ছিল বাদক,
যে বাঁশির মতো পাতার ফাঁক দিয়ে সুর তোলে।
অপরিচিতটি আবার বলল
হে চলমান কলমধারী,
শীতকে উপলব্ধি কর আগুনের আলোয় নয়,
অন্ধকারের গভীরতায়।
কারণ আলোর উষ্ণতা সবাই দেখে,
কিন্তু অন্ধকারের শীতলতা
শুধু তারা টের পায়
যাদের হৃদয় এখনো ব্যথা ধারণ করতে পারে।
তার কথা যেন জমাট বরফে লেখা আগুনের পঙ্ক্তি।
আমি অনুভব করলাম
শীত কেবল শরীরের নয়,
এ পৃথিবীর অন্তর্গত নিঃশব্দ অধ্যায়,
যেখানে মানুষ নিজের অন্তর্লোকের সাথে
নির্জনে মুখোমুখি হয়।
ঠিক তখনই অপরিচিতটি থেমে দাঁড়াল।
তার চোখে ঝিলিক
যেন কুয়াশার ভেতর লুকিয়ে থাকা এক চাঁদ।
বলল:
যদি কখনো মনে হয়
শীত খুব কঠিন হয়ে গেছে
মনে রেখো,
বরফের নিচেই নদী বয়ে চলে,
কুয়াশার আড়ালেই সূর্য লুকায়,
আর মানুষের হৃদয়
যদিও বাহিরে শীতল
ভেতরে উষ্ণতার আগুনই বহন করে।
এই বলে সে মিলিয়ে গেল
ঠিক যেমন কুয়াশায় হারিয়ে যায়
ভোরের শেষ অন্ধকার।
আর আমি
শীতের সেই রাতকে বুকে ধারণ করে
বুঝলাম,
শীত কেবল রুক্ষতা নয়;
স্নিগ্ধতার রূপ, গভীরতার পাঠ,
আর মানুষের হৃদয়ের অদৃশ্য উষ্ণতার
কাব্যিক ঘোষণা।
============
নাম:আবু সাঈদ
ঠিকানা:শিবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, বগুড়া।

Comments
Post a Comment