চেনা প্রতিবেশী
( অষ্টম পর্ব )
দীপক পাল
রান্নাঘরে এসে গরম কড়াইতে সুন্দর করে কাটা বেগুনের টুকরোগুলো ছাড়তে
লাগলো। ওদিকে কমল ত্রিহানকে বললো, ' ত্রিহানদা এতসব মিষ্টির কি দরকার ছিল?'
পবন বললো, ' বৌদিকে দেখ আমাদের মিষ্টি দিয়ে বসিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে কড়াইতে কি
ভাজছে যেন। এখান থেকে শোনা যাচ্ছে ।' ত্রিহান হেসে বলে,
- ' ও কিছু নয় পবন, মনে হয় মাছটাছ কিছু একটা ভাজছে। নাও খাওয়া শুরু করতো।'
একটু পরে দুটো বড়ো বড়ো প্লেটে করে গরম গরম বেগুনি এনে একটা কমল
ও পবনের মাঝে রাখলো ইমন আর একটা ত্রিহানেব সামনে রেখে বললো,
- ' চায়ের জল বসিয়েছি চাটা নিয়ে এসে একসাথে বসে চায়ের সাথে বেগুনি খেতে
খেতে গল্প করবো। বেশ মজা হবে। যাই নিয়ে আসি চা।' পবন কিন্তু বলে ওঠে,
- 'আরে আমি বুজেছি বৌদি বেশ কায়দা করে আমাদের লাঞ্চের ব্যাবস্থাটা করে দিল।'
- ' কি আর এমন খাওয়ালাম। লাঞ্চের এখনও অনেক দেরী দেখবে খিদে পেয়ে যাবে।'
চায়ের ট্রেতে করে চা নিয়ে এলো ইমন। দুকাপ চা পবন ও কমলের টেবিলে
নামিয়ে দিয়ে আর দুকাপ চা নিয়ে ত্রিহানের পাশে গিয়ে বসলো তারপর একটা বেগুনি
তুলে নিয়ে খেতে খেতে চায়ে একটা ছোট্টো চুমুক দিয়ে কমল আর পবনের দিকে চেয়ে
জিগ্গেস করলো ' বলো তোমাদের কথা একটু শুনি। যদি তোমাদের আপত্তি না থাকে।'
কমল হাতের দুটো তালু এক করে একটা চাপ দিয়ে অদ্ভুত রকম হেসে বলে,
- 'সে অনেক কথা বৌদি, ত্রিহানদা জানে সব। ত্রিহানদাকেই বলতে বলুন।' মাদুর থেকে
আহির হঠাৎ উঠে দৌড়ে ইমনের কাছে এসে বলে, ' মা আমি বেগুনি খাব।' ইমন বলে,
- ' বেগুনি খুব গরম বাবা তুই কিকরে খাবি বল? আচ্ছা দাঁড়া দেখছি।' ইমন প্লেট থেকে
একটা বেগুনি তুলে নিয়ে একটু ভেঙে মুখে দিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ফুঁ দিয়ে একটু ঠান্ডা
করে আহিরের হাতে দিয়ে বলে, ' যাও মাদুরে বসে খাও। তোমার মিষ্টিতো শেষ হয়নি।'
আধখানা বেগুনি নিয়ে ফুঁ দিতে দিতে আহির মাদুরে গিয়ে বসলো। ইমন এবার বললো,
- ' ত্রিহান, ওরাতো বলছে তুমি ওদের ব্যাপারে কিছু বলবে, বলোনা প্লীজ এবার।'
- ' হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি। যদি পরোপকারের কথা ওঠে তবে অবশ্যই পবনের কথা সবার আগে
বলতে হবে।' কথাটা পেশ করতেই কমলের আবার সেই হাসি। দুটো হাতের তালু এক
করে চাপ দিয়ে অদ্ভুত ভাবে দাঁত বার করে কোন শব্দ না করে থেমে থেমে হেসে নিল।
' তারপর শোন, গড়িয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক গরীব মহিলা একটা থামের পাশে
একটা খুব সাধারণ ছোট্টো দোকান দিয়ে বিড়ি সিগারেট বিক্রি করতো। উনি বাড়ীতে
বসে নিজেই বিড়ি বানাতো। তার স্বামী রাজমিস্ত্রীর জোগারের কাজ করতো। তাদের
আবার দুটো ছোট ছেলে ছিল। তারা ঠাকুমার কাছে থাকতো। সংসার খুব কষ্টে চলতো।
পবন রোজ ঐ মহিলার কাছ থেকে অফিসে যাওয়ার পথে এক বান্ডিল বিড়ি কিনতো।
আবার ফেরার পথেও প্রায়ই এক বান্ডিল কিনতো। সেই সূত্রে খুব আলাপ ছিল।
একদিন সেই মহিলা দুঃখ করে পবনকে বলেছিল, ' পবনদা এই বিড়ি বিক্রি করে
আর সংসার চালাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে দোকানটা বন্ধ করে দিতে হবে।' পবন বলে,
' যদি আমার কথা শোনেন তবে বলি, এই বিড়ির সাইজ একদম ছোট করুন। একজন
ভাল বিড়ি বাঁধার লোক রাখুন যে ছোট বিড়ি বাঁধতে পারে। তারপর বিড়ির প্রোডাক্শন
আরো বাড়িয়ে দিন দোকানে জায়গা করে থরে থরে বিড়ির বান্ডিল সাজিয়ে রাখুন।
দামটা ঠিক করুন। প্রথম প্রথম বিক্রি কম হবে কিন্তু পরে দেখবেন বিক্রি কি বাড়বে।'
পবনের কথা শুনে সেই মহিলার বিড়ি বিক্রি কিছুদিনের মধ্যে এমন বেড়ে গেল যে
সে বাড়ী মেরামত করে ছেলেদের ভাল স্কুলে ভর্তি করিয়েও সংসার তার খুব ভাল
ভাবে চালাতে পারছে আর তাই দেখে তার স্বামী লেবারের কাজ ছেড়ে তার বৌয়ের
সাথে এই বিড়ির ব্যবসায় নেমে পড়লো। গোটা গড়িয়া ও তার আশেপাশে পান
বিড়ি সিগারেটের দোকানগুলোতে এই বিড়ি সাপ্লাই দিতে থাকলো এবং ভাল বিক্রি
হতে থাকলো। এমনকি আমাদের এই চৌরঙ্গী অঞ্চলের অনেক দোকানেই ঐ বিড়ি
পাওয়া যায়। এখন নাকি সেই মহিলার বাড়ী চারতলা হয়েছে এই বিড়ি বিক্রির
ব্যাবসায়। পবনকে নাকি বলেছিল তার পরামর্শ কজে লাগিয়ে আজ তার স্বচ্ছল
অবস্থা। দুদিন দু বান্ডিল করে বিড়ি নেবার পর পয়সা না নেওয়ায় পবন আর সেই
মহিলার কাছে বিড়ি কিনতে যায়নি। এখন সে এই বিড়ি এখান থেকেই কেনে।'
- ' বাবা এতো দেখছি আলিবাবার গল্প।' কথাটা ইমন বলে হেসে ওঠে।
- ' এতো কিছুইনা। পবন এরকম আরও কত ঘটনা ঘটিয়েছে। কোন বছর যেন
একবার প্রচন্ড বন্যা হয়ে জলস্তর বেশ অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। কমল ও পবনের
বাড়ীতে জল ঢুকে গিয়েছিল। ওরা বৌ বাচ্চা নিয়ে চৌকির ওপরে। যেহেতু ওরা
টুকটাক বাড়ীর কাজ করতো তাই বাড়ীর কাছে ইট বালি সবসময় পড়ে থাকতো।
তাই দিয়ে দুটো চৌকি এক করে নিয়ে তলায় ইট দিয়ে অনেক উঁচু করে নিয়েছিলো।
রান্নার সিলিন্ডার ঠিক ঐ ভাবেই উঁচু করে নিয়েছিল। বাথরুম যাবার রাস্তাটা ওই
ভাবেই যতটা সম্ভব ইট দিয়ে দিয়েছিল। এরপর হয়েছে কি জল যখন নেমে গিয়ে
রাস্তা বেরিয়ে পড়েছে তখন হয়েছিল আর এক বিপদ। পবনের বাড়ী ছাড়িয়ে আর
একটু গেলে একটা বেশ বড় গাড্ডা ছিল। সেখানে একটা কুমিরের বাচ্চা কোথা
থেকে এসে ওখানে আটকা পরে গিয়েছিলো। রাস্তা দিয়ে লোক যাতায়াত করতে
দেখায় কুমিরের বাচ্চাটা ভয়ে না বেরোনোয় ঐ গাড্ডার মধ্যে আটকা পড়ে গেল।
পাড়ার কিছু বাচ্চা খেলতে খেলতে ওকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে বাড়ীতে বলে।
পাড়ার লোকেরা এসে দেখে পবনকে খবর দিয়ে বলে কিছু একটা করতে। নাহতো
বাচ্চারা ওখানে খেলতে যেতে ভয় পাচ্ছে। এমনিতে পবনকে পেছনের রাস্তা দিয়ে
যাওয়া আসার কোন প্রয়োজন পরেনা তবুও ভাবলো এতো লোক ওর ভরসায়
ওর কাছে এসেছে একবার দেখাই যাক না। পবন সবাইকে নিয়ে আগে পেছন
দিকের একটা খাটালে ঢুকলো। সেখানে মোষেদের মুখ বন্ধ করার একটা বড়ো
ও শক্ত মুখোশ ধার করলো গয়লাদের কাছ থেকে। তারপর কারো কাছ থেকে
একটা মোটা ছেঁড়া বেডকভার নিয়ে একটা চাপা চাপা হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জী
পড়ে ঐ গাড্ডায় লাফ দিয়ে পড়লো এবং অত্যন্ত তৎপরতায় কিন্তু সতর্কতার
সাহায্যে বেডকভার দিয়ে কুমিরটাকে জাপটে ধরলো ও বেডকভারের একটা
দিক দিয়ে ওর হাঁ করা মুখটাকে পেঁচিয়ে ছোট করে মোষের জানাটা পড়িয়ে
দিল অত্যন্ত কায়দায় তারপর কুমিরটাকে বগলে করে নিয়ে সবার সহায়তায়
উঠে এলো। পাড়ার যত উপস্থিত ছেলে ছোকরারা হৈ হৈ করে উঠলো আনন্দে।
তারপর ইট পাথর মারতে লাগলো ঐ আমরা কুমিরটাকে। বড়দের বারণ কেউ
শুনলোনা। বেচারা কুমিরটা ছিল বাচ্চা তার ওপর কতদিন না খেয়ে ছিল সে
কে জানে। তাই বলে পবনের বীরত্বও কম নয়। আর কারো তো সাহস হয়নি
কুমিরটাকে ওপরে তুলতে বরং তারা এসেছিল একটা হিল্লে করতে ওর কাছে।'
- ' বাবা কি সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা কি সত্যি।!'
- ' আমি তো চোখে দেখিনি শুনেছি ক্যান্টিনের বাবুয়ার কাছে। তবে এখানেই
শেষ নয় এর পরেও আরো আছে। বাবুয়া যেদিন পবনের কুমির ধরার গল্পটা
বলেছিল সেদিন সেই সময়টাতে ভাল বৃষ্টি হচ্ছিলো। বাবুয়া এমন রসিয়ে গল্প
বলছিলো যে আমরা আশেপাশে যতজন চেয়ার বসে কাজ করছিলাম কলম
নামিয়ে শুনছিলাম আর বেশ হাসাহাসি করছিলাম। হাসাহাসি শেষ হতেই তান
ধরলো কমল। বললো, এক গলিতে থাকলেও আমি কিন্তু পবনের ব্যাপারটা
জানতাম না তখন। আমাদের ঘরেওতো জল ঢুকেছিল। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে
শুয়ে পড়েছিলাম। তখনও ঘরে পায়ের পাতার ওপর জল ছিলো। সকালে ঘুম
ভাঙতেই দেখি ঘরের জল শুধু না কোথাও কোন এতটুকু জল নেই। ধীরে ধীরে
খাট থেকে নামলাম। সর্বত্র নোংরা হয়ে আছে। আমি আস্তে করে বারান্দার
দিকের দরজাটা খুললাম। আর খুলতেই আমার চক্ষু একেবারে চড়ক গাছে
চড়ে বসলো। বারান্দায় জলতো নেই উপরন্তু বারান্দার দুদিকে দুটো ইলিশ
মাছ পড়ে আছে। মড়া কিন্তু টাটকা। এত আনন্দ হলো যে দু হাতে দুটো ইলিশ
মাছ ঝুলিয়ে ঘরে ঢুকে হৈ চৈ করে উঠলাম। সবাই উঠে পড়ে দেখো আমি দুটো
ইলিশ মাছ ধরে এনেছি। এই কথা শুনে আবার একচোট হাসাহাসি চললো।'
- ' বাবা একেবারে ঘরের দুয়ারে জোড়া ইলিশ! তাও আবার ধারেকাছে কোন
নদী নেই। যাঃ এটা আবার হয় নাকি কখনো।' ইমনের সন্দেহের উত্তরে কমল,
- ' কেন হয়না বৌদি এবারে তো তাই হয়েছে। কুমির ভেসে এসেছে ইলিশ ভেসে
এসেছে হাঙরবাচ্চা ভেসে আসতে পারে।' ইমন ইঙ্গিতটা বুঝে হেসে উঠলো।
পবন গুম হয়ে বসে থাকলো। ত্রিহান বললো,
- ' আরে এখনওতো পুরোটা শেষ হয়নি, এরপরে আরো আছে। শোন তবে।
আমাদের একজন পিয়ন ছিল তার নাম বিকাশ। সে আসতো চাকদা থেকে।
সে একটা চেয়ারে বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বাবুয়া আর কমলের সব কথা
শুনছিলো এবার সে মুখ খুললো। তাহলে আমার কথাটা শুনলেতো আপনারা
অবাক হয়ে যাবেন বিশ্বাস করবেন না ঠিকই কিন্তু যেটা সত্যি সেটা আমি
বলতে মোটেই ভয় পাইনা। বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার। একবার
আমরা বন্ধুরা বাইচ্ লরলাম ডুব সাঁতার দিয়ে একদমে কে কতদুর যেতে পারে।
এমনিতে নদীতে স্নান করতে গিয়ে আমরা পদ্মা এপার ওপার করতাম। সেদিন
গোয়ালন্দে নেমে আমরা সাত আটজন ডুব সাঁতার দিতে থাকলাম। তখন ছিল
আমার অফুরন্ত দম। সাঁতার কাটতেছি তো কাটতেছি। দম আর ফুরায় না
আমার। আর যে কে কোথায় আছে তাও জানি না। সাঁতার কাটতে কাটতে যখন
দম ফুরালো তখন ভেসে উঠে দেখি ওপরে হাওড়া ব্রিজ। বলে সে চুপ করলো।
আমরা তখন হেসে লুটোপুটি। খালি পবন দুর থেকে গম্ভীর হয়ে বললো, গুল
মারার আর জায়গা পায়না। যত্তসব। বিকাশ কিন্তু চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে
তখন। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।' ওদিকে ইমন হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে গড়িয়ে
পরে আরকি। কখন আহির এসে দাঁড়িয়ে ছিল ওর মার কাছে, সেও ইমনকে
জড়িয়ে ধরে কি বুজেছে কে জানে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। ইমন হাসতে
হাসতে বলে, 'ওরে বাবারে অনেক দিন পরে প্রান খুলে হাসলাম। ধন্যবাদ কমল ও
পবন তোমাদের। এরকম মাঝে মাঝে এসে আমাদের খুশী করো।' পবন বলে,
- 'আমার কথা শুনে অনেকে বিদ্রুপের হাসি হাসে, আমি তাতে কিছু মনে করিনা
আমার কথা শুনে কেউ যদি আনন্দ পায় ও হাসে তাতে আমার কিছু করার নেই।'
( চলবে )
==============
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.

Comments
Post a Comment