প্রথম উপার্জন
শাঁওলী সরকার
সবে তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। এক পিসতুতো দাদা বলল, মৌ বসেই তো থাকবি এখন দুটো টিউশনি কর। তাহলে পড়াশোনার মধ্যেই থাকতে পারবি!
বললাম দাদাকে, পারব গো?
দাদা বলল, কেন পারবি না? তুই যদি তোর ভাই বোনকে পড়াতে পারিস আর অন্যকে কেন পারবি না? কর, করেই দ্যাখ, আমি জানি তুই ভালোই পারবি।
বললাম, ঠিক আছে এতই যখন বলছো তখন চেষ্টা করে দেখি! তবে, তার আগে তোমার মনির ( আমার বাবা) অনুমতি নিয়ে নি। দেখি উনি কি বলেন!
সন্ধ্যে বেলায় বাবার কাছে গিয়ে পাড়লাম কথাটা।
বাবা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আমার কথা। বললেন, সে তো ভালোই কথা। কিন্তু, একমাস বাদে তোমার রেজাল্ট বের হলে তোমার পড়ার চাপ বাড়বে, তখন সময় কি পাবে সেটা নিয়মিত করার জন্য? তারপর, হঠাৎ পড়ানো ছেড়ে দিলে তোমার ছাত্রদের কি হবে? ভেবে দ্যাখো, আমার অনুমতি আছে। তবে, নিজের ক্ষতি করে অবশ্যই নয়।
ভাবলাম চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি!
দাদার সাথে গেলাম ছাত্রদের বাড়ি। একজন দ্বিতীয় শ্রেনী , আরেকজন ষষ্ট শ্রেনীতে পড়ে। ছাত্রদের দেখে বেশ ভালো লাগলো। কথাবার্তায় ভদ্র ও মার্জিত। ছাত্রদের মা বললেন, এদের এইরূপ দেখে ভালো ভেবে নিও না। এনারা ল্যাজবিহীন বাঁদর। আমি তোমাকে একটা লাঠি দিয়ে যাবো। তেড়ি বেড়ি করলেই সপাটে লাগাবে!
আমি হেঁসে বললাম, না না, মারতে হবে কেন? ওরা এমনিতেই পড়বে!
নির্দিষ্ট দিনে পাড়াতে গিয়ে টের পেলাম আমার ছাত্ররা কতটা ভদ্র?
পড়ানো শুরু হতেই বড়জন বলল, দিদি টয়লেটে যাব, কিছুক্ষন পর বলল, জল খাব।
এভাবে কিছুক্ষন পর পরনানা বাহানা শুরু হল তার।
এরপর যেতেই ছোটজন বলল, দিদি ওর কিচ্ছু হয়নি। দাদা বাগানে গিয়ে লাট্টু ঘোরানো প্র্যাকটিশ করছে।
আমি বললাম, তাই না কি? চল, তাহলে আমরাও গিয়ে খেলি!
ছোটজন অবাক হয়ে বলল, তুমি খেলবে?
ওকে বকবে না?
আমি বললাম, আরে না না, বকবো কেন?খেলাতো ভালো জিনিষ। চল, আমরাও খেলবো।
ওদের বাগানে গিয়ে দেখি বড়জন সত্যিই লাট্টু খেলছে!
আমাকে দেখেই আঁতকে উঠলো। আমি বললাম, ভয় পাবার কিছু নেই। আমি আজ থেকে তোর ছাত্রী। আমাকে তুই লাট্টু খেলা শেখাবি। তার বদলে তোকে আমার কাছে মনযোগ দিয়ে পড়তে হবে। পড়বি তো?
খুব খুশি হয়ে বলল, ঠিক আছে। তবে তুমি মা, বাবাকে বলবে না তো? তুমিই বা আমাকে মারবে না তো?
আমি বললাম, একদম বকবো না, মারবো না। মা, বাবাকেও বলে দেবো না বকতে, কেমন?
আমি তখন থেকে হয়ে গেলাম ওর ছাত্রী। ওর কাছে খেলা শিখতে লাগলাম।
এদিকে আমাদের হৈ হট্টগোল শুনে ওদের বাড়ির লোকজন তখন বাগানে এসে ভিড় করেছে। ইশারায় তাদের কিছু বলতে বারণ করলাম।
এভাবে কিছুক্ষন খেলার পর বললাম, ও,ওগো আমার মাষ্টারমশাই এবার তাহলে আমার কথাটা রাখুন। আমরা এখন একটু পড়াশোনাটা করি।
দেখলাম, হাসি মুখে রাজি হয়ে গেল। লক্ষ্মী ছেলের মত দুঘন্টা পড়াশোনা করে নিল।
এইভাবেই প্রতিদিন আগে একটু নানা রকম খেলা হত, তারপর হত পড়াশোনা।
দেখলাম বাচ্চাদুটো কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলো। পড়ায় মনোযোগী হয়ে উঠলো।
এভাবে একমাস হয়ে গেল ওদের পড়ানো।
মাইনা দিতে এলেন, ওদের মা বাবা। ওদের মা এসেই আমার হাত দুটো ধরে বললেন, কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দেবো বুঝে পাচ্ছি না।
আমি বললাম, কিসের জন্য ধন্যবাদ? আমি আমার ভাইয়ের মত স্নেহে ওদের পড়িয়েছি মাত্র।
ওদের মা বললেন,না গো। আগে ওদের দুষ্টুমিতে বিরক্ত হয়ে যেতাম। রোজ স্কুল থেকে ওদের নামে নানা অভিযোগ আসতো। এখন এগুলো সব বন্ধ হয়েছে। ওরা এখন পড়াশোনাতেও মনোযোগী হয়েছে।এ সব হয়েছে তোমার জন্য। এইবলে, তিনি আমায় একটা খাম ধরিয়ে দিলেন।
বাড়ি ফিরে দেখলাম অনেকগুলো টাকা। জীবনের প্রথম উপার্জন।
বাবা অফিস থেকে ফিরলে তার হাতে দিতেই খুশি হয়ে বললেন, মায়ের হাত দাও।
মা আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন।
ভাই বোন এসে বলল, আমাদের কি দিবি, দিদি?
আমি বললাম, কি লাগবে?
দুজন বিশাল লিষ্ট ধরিয়ে দিল।ওদের কান্ড দেখে সবাই মিলে হেঁসে উঠলাম।
পরদিন মায়ের সাথে গিয়ে বাবার পছন্দের জিনিষ - একটি পাঞ্জাবী আর দামী চাপাতা, মায়ের জন্য পানের ডিব্বা, ভাইয়ের জন্য খেলার জুতো আর বোনের জন্য বার্বি ডল নিয়ে এলাম।
জীবনের প্রথম উপার্জন দিয়ে সবার হাসি মুখগুলো আমার কাছে ছিল দামি উপহার।
===================
SHAONLI SARKAR
P. O : Raiganj
Dist : Uttar Dinajpur

Comments
Post a Comment