ধ্বংস স্তূপে আলো
অদিতি চ্যাটার্জি
ঐশীর মনে হচ্ছে আমতা তে অফিস কলিগ সুস্মিতার বিয়েতে না গেলেই ভালো হতো, হাওড়া স্টেশনে নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে আমতা লোকাল থেকে যখন ঐশী নামলো ঘড়ির কাঁটা দেখাচ্ছে রাত ন'টা দশ ! গরম কাল হলে খুব বেশি অসুবিধা হতো না কিন্তু জানুয়ারির রাত , তবু প্ল্যাটফর্মে অসুবিধা নেই লোক জনের ভিড় ভালোই আছে, পুলিশ- দোকান সব খোলা কিন্তু অস্বস্তি লাগছে বাসের লাইনে যেতে, সেই বেহালা সখের বাজার যাবে, সরকারি বাস পেলে ভালো, একা ক্যাবে অতোটা রাস্তা যেতে সাহস হচ্ছে না ঐশীর। কাগজে যা খবর ইদানীং পড়ছে ও ।
বাসটাতে ভিড় আছে মোটামুটি, ঐশী বসার জায়গা পেল পার্কস্ট্রীটের ছাড়ানোর পর, বসার পর মনে হলো বদমাইশ গুলোর হাত থেকে বাঁচলো। সেই বাসের লাইনে দাঁড়ানো থেকে বিরক্ত করেই যাচ্ছে। একা মেয়ে দেখেনি নাকি! ভাবে ঐশী। একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো , হঠাত্ অনুভব করে কাঁধ আর হাঁটুর ওপর চাপ, " ভাই ইয়ে কৌনসি স্টপেজ হ্যা " হুমড়ি খেয়ে ঐশীর ঘাড়ে পরে দেখার চেষ্টা করছে ছেলেটা। কি দেখছে বন্ধ জানলায় ? কনডাকটার তো সমানেই বলে চলেছে স্টপেজ আসলে!
----"প্লিজ আপনারা একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান তো, আমার গায়ে কেন পড়ছেন "!
অদ্ভুত হাসি চারজনের দলটা হাসতে থাকলো, যেন এতো মজার কথা কোনোদিনও শোনেনি ...." আরে ভাবী জি কো তকলিফ হো রেহি হ্যা রে"
---"আরে ভাবীজি নেহী দিদি হ্যা রে দেখ কে বোল"
---"আরে তুই ঠিক জানিস দিদি ! নাকি অন্য ....."
আবার সেই জঘন্য হাসি।
ঐশী দেখে গোটা বাস বধির, ওর পাশে শান্ত চেহারার একজন মধ্য বয়সী ভদ্র লোক বসে আছেন ঐশী কাতর ভাবে বলে , " দাদা একটু কিছু বলুন !"
ভদ্র লোক বধির যেন শুনতেই পেল না। ঐশী শুনতে পেল পেছনের সিটে চাপা গলায় কোনো স্বামী, স্বামীগিরি করছে নিজের বৌ -র ওপর " তুমি একদম চুপ থাকবে । তারপর ওরা তোমার সাথে অ*সভ্য*তা করুক আর কি"!
ঐশী নিজের ঈশ্বর কে সমানে ডেকে যাচ্ছে , তারাতলার কাছে এসে গেছে বাস আর তো একটু খানি তারপর সখের বাজার, সেখানে নেমে কিছুটা হাঁটা । একটা রিকশা পেলে আর ঝামেলাই থাকবে না। " কিন্তু রিকশা কি পাবো! এতো ঠান্ডা তার ওপর আজ রবিবার, তবে কি ঠান্ডাতে বুড়ো মানুষটা কে ফোন করে ডাকতে হবে? " ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে আসে ঐশীর।
তারাতলায় বাস কিছুটা খালি হয়ে গেল কিন্তু কেউ উঠলো না , ছেলে গুলো ঐশী কে দেখে সমানে হেসে যাচ্ছে । ঐশী আর ঐদিকে তাকাচ্ছে না। বেহালা থানাটা ছাড়াতে ঐশী একদম সামনে চলে আসে, আচমকা কানে আসে ..." আরে দেখ দেখ ভাবীজি গুসসা হো রাহি হ্যা "
---" আরে সানি , তুই তো ভালো গান জানিস শোনা ভাবী নাকি তোর ...." আবার সেই বীভত্স হাসি।
ঐশী আবারও অনুরোধ করে ড্রাইভার আর কনডাকটার কে, " দয়া করে ওদের কিছু বলুন ।"
---"দিদি চুপ থাকুন, সব ম*দ খেয়ে আছে। শীতের এতোটা রাতে বাইরে একা থাকেনই বা কেন? " কনডাকটার তাঁর সুচিন্তিত মতামত পেশ করে দেয়। ঐশীর আর বাবা কে ফোন করা হয় না , ম্যানটন ছাড়াতেই ওরা ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করা হয় না । তবে আশা একটাই সখের বাজার জমজমাট জায়গা, এতো রাতে দুই-একটা দোকান খোলা পাবে , সেখানে দাঁড়িয়ে বাবা কে ফোন করা যাবে ।
ঐশী যখন সখের বাজারে নামে বাস থেকে রাত প্রায় পৌনে এগারো! পুরো সখের বাজারটাই কুয়াশার চাদরে মোড়া, অটো স্যানড খালি, মিষ্টির দোকানটা আধ খোলা, ঐশী প্রায় দৌড়ে সেখানে যেতে চায় কিন্তু ব্যাগটা হাত থেকে পরে গেল সেই মুহূর্তে! ওঠাতে যেতেই দেখে প্রায় ছেলে গুলো ঘিরে ধরেছে।
তবে কি ঐশীও সেই খবরের কাগজের প্রথম পাতার ' ছবি আর খবর' হবে ! প্রায় দৌড়ে যায় মিষ্টির দোকানে " দাদা একটু সাটার টা তুলুন প্লিজ, আমার খুব বিপদ "....
---"কেউ আজ আর দরজা-জানলা খুলবে না ম্যাডাম ।"
---" থোড়ে দের বাঠিয়ে , দোস্তি কিজিয়ে না প্লিজ ...ফির হামলোগ ঘুম নে যায়েঙ্গে " আবার সেই কান ফাটানো হাসি
ঐশী দিশাহীন ভাবে দৌড়াতে থাকে, কে জানে এটা তো ওর রাস্তা বা গলি না, আবাসন আর বাড়ি গুলোর দরজা বন্ধ, সবাই কি আরামে ঘুমোচ্ছে আর ঐশী...
গলা ফাটিয়ে চিতকার করে "হেল্প ......"
আবারও সেই হাসি, ধরে ফেলেছে ওরা ঐশী কে , এইবার ....
কাঁধে একটা আলতো চাপ ,মুখ টা মাস্কে ঢাকা, বোঝা যাচ্ছে লম্বা মানুষটার ছোঁয়ায় একটা নিরাপত্তা আছে ।
লোকটা চিতকার করে ..." কি রে আয় তোরা, এটা কিন্তু আমার পাড়া দ্যাখ ক্লাবে বাকি ছেলে দের ডাকছি, একটা মা*র বাইরে পড়বে না ।"
--" বাদ মে" অশ্লীল একটা অঙ্গ ভঙ্গি করে শয়তান গুলো চলে যায় ।
---" বোন আমার দোকানে আগে এসে বসো, ভয় নেই, থাকো কোথায়? বাড়িতে একটা খবর দাও বরং ।"
ঐশী হাতজোড় করে শুধু, দুই চোখে জল।
ওরা দুইজনে কেউ দেখলো না শুনতে পেল না সেই সব নারীদের যারা উপস্থিত হয়ে ছিল গভীর রাতে সখের বাজারের কোনৌ এক রাস্তা বা গলিতে ঐশীদের সামনে,হতে পারে কেউ মাধবী কেউ সুতপা কেউ রেণুকা কেউ অহল্যা কেউ জানকী আবার কেউ কৃষ্ণা , পাঁচ স্বামী এবং গুরু জনদের উপস্থিতিতে যাকে ভরা সভায় লাঞ্ছিত হতে হচ্ছিল । আবার যাকে উদ্ধার করেছিল তাঁর সখা ।
আজও কি তাহলে ঐশী তাঁর পূর্বসূরি দের মতো উপলব্ধি করলো মানুষ-ই বিশ্বাস ধ্বংস করে, আবার সেই মানুষ-ই বিশ্বাস গড়ে তোলে । কে জানে !
তবে আমরা জানলাম, কালকের খবরে ঐশী দেবনাথ লোকের আলোচনার বিষয়বস্তু হবে না ।
=====================
অদিতি চ্যাটার্জি
রানাঘাট

Comments
Post a Comment