সংশোধন
তপন তরফদার
এ কথাটা সবাই জানে মানুষ নিজকে শুধরে নিতে জানে। এটাও জানে কিছু মানুষ আছে যারা জেনে শুনেও নিজেদেরকে শুধরায় না, শুধরাবার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করে না। এটাই সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিছু পরিবার আছে যারা নিজেরা সমাজের সঙ্গেই পাল্টে ফেলে এবং সমাজকে প্রগতি পন্থী পথে পরিচালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। প্রগতিশীল হয়ে সমাজের,মানুষের উপকার করতে পারলে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা ওরা বুঝবে না যারা কোনদিন ওই পথের পথিক হয়নি।
আমাদের গোবিন্দপুর পাড়ার ডাক্তার বাবু হরিশ চন্দ্র দে ডাক্তারির সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা কে মান্যতা দেন। ভাল মন্দর পার্থক্য বুঝিয়ে দেন। হরিশের ছেলে মহেশ বাবার আর্দশকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসে. শ্রদ্ধা করে। বড় হয়ে ডাক্তার হবে মানুষের সেবা করবে। মহেশ চেষ্টা করেও ওই ডাক্তারি পড়ার পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না। হরিশ বলে শিক্ষকরাও সমাজের ভালোর জন্য অনেক কাজ করতে পারে। শিক্ষকরা দেশের মেরুদন্ড গড়ে তোলে। মহেশ সাফল্যের সঙ্গে পাশ করে শিক্ষক হয়। ওকে শিক্ষকতা করতে সুন্দরবনে পাঠানো হয়। পৃথিবীর সব থেকে বড় 'ম্যানগ্রোভ' এই সুন্দরবন।
নাম সুন্দরবন, কে রেখে ছিল, কেন রেখেছিল কি উদ্দেশ্যে রেখেছিল জানার চেষ্টা করেও সঠিক প্রমাণিত তথ্য জানতে পারেনি মহেশ। অনেকে মনে করে এখানে প্রচুর সুন্দরী গাছ আছে বলে সুন্দরবন বলা হয়। আবার অন্য মত এই অঞ্চলটিকে সমুদ্রের বন বলা হত। ইংরেজদের উচ্চারণের বিকৃতির ফল স্বরূপ সুন্দরবন হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। মহেশের স্কুল মাতলা নদী পেরিয়ে সজনেখালি ছাড়িয়ে ঝাড়খালির নোনাভাটি গ্রামে। অন্য ব্যক্তিরা সচেষ্ট হত যাতে ওই সব জায়গায় না যেতে হয়। মহেশ কিন্তু মনের আনন্দেই মেনে নিয়েছে। ২০০৪সালে প্রখ্যাত লেখক অমিতাভ ঘোষের পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস 'দি হাঙ্গরি টাইড',সলমান রুশদির বুকার পুরস্কারজয়ী 'মিডনাইটস চিলড্রেন' উপন্যাসে সুন্দরবনের পটভূমিতে লেখা। সারা বিশ্বের নজরে এসেছে সুন্দরবন। নৌকায় যেতে যেতে দেখেছে সুন্দরী,গেওয়া গাছের ঝুপসি ছায়া কাদা মাটিতে মাখামাখি করছে কুমির। রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের দেখা পায়নি। আগে আরও ঘন ছিল এই বন। চোরা কারবারিরা কাঠের জন্য ধ্বংস করছে এই বন।
বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম। রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের বাস। ওদের সঙ্গে প্রকৃতির সঙ্গে ধাপ্পাবাজ মানুষদের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় বলেই কি সুন্দর নাম সুন্দরবন। মহেশ সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পায় না।কিন্তু এদের বেঁচে থাকার লড়াইকে কুর্ণিশ জানাতে হয়। নদী নালায় বনে জঙ্গলে কাঁকড়া, মাছ, মধুর ওপরেই এদের জীবন। এরা সরল মনে বিশ্বাস করে ওঝা গুনিনদের।বিশ্বাস করে স্বামী সমুদ্রে যত দিন মাছ ধরে বাড়িতে ফিরবে না ততদিনে সিঁথিতে সিঁদুর দেবেনা। এই প্রথা চালু করার পিছনে বৈজ্ঞানিক কোনো যুক্তি নেই। বুঝালেও ওরা বোঝেনা,প্রথা ভাঙতে পারেনা, সংশোধন করেনা। ভয় পায়। শিশুরা ছাড়া গরুর মত বড়ো হয়। কিশোর হলেই সংসারের আয়ের জন্য যে কোনো কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েদের অবস্থা আরও করুণ। নারী পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় বাড়ির লোকেরা টাকার লোভ এড়াতে পারেনা।
মহেশ ভেবে ভেবে ঠিক করতে পারেনা কোন বিষয়টি নিয়ে এদের সচেতন করবে। সংশোধন করবে। তুষার কাঞ্জিলালা জুনিয়র স্কুলটি সবে হয়েছে। স্কুলের পরিচালক কমিটির সভাপতি নরেশ নস্করের একটা ঘরে ভাড়ায় থাকে।নরেশ বাবু বলেছিল ভাড়া দিতে হবে না। মহেশ জোর করেই ভাড়া দেয়। নরেশের এক মেয়ে দুই ছেলে। মেয়ে বড় নাম ছায়া। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় ছেলে দেবেশ সপ্তম ও ছোট ছেলে ভবেশ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ওদের মা সুলতা সহজ সরল গৃহকর্ত্রী। সুলতা বলে আমার ছেলেদের সঙ্গে তুমিও দুটো ডাল ভাত খেয়ে নেবে। মহেশ বলে সে তো ভাল কথা। কিন্তু মাসিমা আমার খাওয়ার খরচটা আমি দোবো। সুলতা বলে তোমার জন্য আমাদের খরচ বাড়ছেনা।আমাদের যা রান্না হয় তাতেই হয়ে যাবে। তাও যদি তোমার আপত্তি থাকে তুমি আমার বাচ্চাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দিও। তোমার মনে কোনো সংশয় থাকবেনা।মহেশ অবাক হয়ে যায়।সুলতা কি পড়াশুনা করেছে জানেনা।এত সুন্দর করে গুছিয়ে মানুষের মন জয় করে অসাধারণ কথা বলতে পারে এই সাধারণ মা।
কয়েক মাসেই স্কুল ছুটদের বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে স্কুলে ফেরত এনেছে। একটু সংশোধন করে মিড ডে মিলে মুখোরোচক অথচ পুষ্টিকর খাবারের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। পড়াশুনা ঢিমেতালে এগোচ্ছে।কিন্তু গ্রামের সার্বিক স্বাস্থের কোনো উন্নতি হয়না।
মহেশ সংশোধন করে স্কুলে চালু করতে পেরেছে খাওয়ার আগে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া। বোঝাতে পেরেছে হাত ধোওয়ার উপকরিতা। কিন্তু মাঠে ঘাটে শৌচ করলে সকলের কত ক্ষতি হয় বুঝলেও কাজের সময় অবুঝ হয়ে যায়। কি করা যায়।নরেশ বাবু ও চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। মহেশ বলে আমি দেখছি কাকাবাবু কি করা যায়। ছায়া দেবেশ ভবেশদের পড়ানো শেষ করে নিজেই ঔই বনবাদাড়ে শৌচ করা খারাপ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছায়া বলে আমাদেরকে কি পরিমাণে লজ্জায় পড়তে হয় যা সবাইকে বলা যায়না। মহেশের সঙ্গে ছায়া খোলামেলা কথা এবং মেলামেশা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা দুজনেই ভুলে গেছে। মহেশ বলে আমি একটা প্লান করেছি তোমারা যদি সাহায্য কর। ছায়া বলে মনপ্রাণ দিয়ে করব।
মহেশ গ্রামের পূজারী মদনের উপর নজরদারি করে। সন্ধা নামলেই কানে পৈতে লাগিয়ে বিলের ধরে গাড়ু নিয়ে ঝোপের মধ্যে বসে পরে। শনিবারের বার বেলা শেষ করে সূর্য অস্তমিত। মদন যেই বসেছে দুর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসলো অনেকটা বাঘের মত। হঠাৎ দেখা যায় হেলে পড়া গরান গাছের তলায় আলোর ঝলক।বনবিবি এক হাতে লাঠি অন্য হাতে ত্রিশূল। বাতাসে ভেসে আসে কিরে মদন আমার পূজা করিস আর এতো খারাপ কাজ করিস। কোনো রোগ হলে আমাকে ডাকবি না। তোদের কলেরা হবে। মদন ছুটে দেবীর পায়ে পরতে যায়। কাউকে পায় না। মদন হাঁক দিতে দিতে ঘর মুখো,চিৎকার করে বলতে থাকে বনবিবির দেখা পেয়েছি।উনি আদেশ করেছেন যেখানে সেখানে শৌচ করলেই মহামারি হবে।
যে কথা এতদিন বলে আসছিল নরেশরা কোনো কাজ হচ্ছিলো না। পূজারীর কথায় ভয় পেয়ে গ্রামের সবাই বদআভ্যাস ত্যাগ করলো। নরেশ বাবু খুব খুশি। মহেশকে ধন্যবাদ জানালে মহেশ বলে আসল কাজ করেছে ছায়া আর দেবেশ। ছায়া দেবীরূপ ধারন করেছিল। দেবেশ বাঘ সেজেছিল। আমি শুধু আলোর ও শব্দের কারসাজি করেছি। গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে মান্য করে ভগবানের নির্দেশ। তাই প্ল্যান সংশোধন করে পূজারীর উপরই প্রয়োগ করি। একশো শতাংশ ফলের আশায়।
এমন সুদিন অনেক দিন আসেনি এখানে। নোনাভাটি গ্রাম নির্মল গ্রামের স্বীকৃতি পেয়েছে। নরেশবাবু কে দলের এবং সরকারের পক্ষ থেকে সর্ম্বধনা দেওয়া হবে। সুদিনের মাঝেই দুঃসংবাদ। মহেশকে বারাসাতের বিধান রায় স্কুলে বদলি করা হয়েছে। ছায়া, রবীন্দ্রনাথের পোষ্টমাস্টারের রতনের মত শুধুমাত্র 'চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে' সংশোধন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
=============
তপন তরফদার, প্রেমবাজার(আই আই টি)খড়্গপুর ৭২১৩০৬

Comments
Post a Comment