ভাস্কর সিনহা
প্রস্তাবনা:
সময়ের প্রবাহে পরিবর্তন অনিবার্য। সভ্যতার ইতিহাসে পরিবর্তন ও বিবর্তনের পথ ধরে এগিয়ে আসে নিত্যনতুন আধুনিকতা, আর এই আধুনিকতার বেগেই অনেক সময় ধুয়ে যায় আমাদের লোকজ সংস্কৃতি, বিশেষত লোকজ শিল্পকলা। বাংলার মাটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, প্রাণ-প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ লোকজ শিল্পসমূহ আজ ক্রমশ বিলুপ্তপ্রায়। পুরুলিয়ার ছৌনাচ, বাঁকুড়ার মৃৎশিল্প—বিশেষত মাটির ঘোড়া, গাজন উৎসবের মত শিল্প ও সংস্কৃতিগুলো আজ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবন্ধে এই বিলুপ্তপ্রায় লোকশিল্পের ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা, হারিয়ে যাওয়ার কারণ এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ নিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে।
লোকজ সংস্কৃতি ও শিল্পকলা মূলত গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। বাংলার প্রাচীন গ্রামীণ সমাজে মাটির শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য ও উৎসব ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পুরুলিয়ার ছৌনাচ বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অনন্য নিদর্শন। এই নাচে মুখোশ, রঙিন পোশাক, বিশেষ শারীরিক ভঙ্গিমার সমন্বয়ে ফুটে উঠত পৌরাণিক কাহিনির বিভিন্ন চরিত্র। কিন্তু নগরায়ণের প্রভাবে গ্রামীণ জীবনযাত্রায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, যার ফলে এই লোকশিল্পের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। আজকের প্রজন্ম প্রযুক্তি-নির্ভর বিনোদনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে, যা ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিকে সরিয়ে দিয়ে নতুন রূপে সমাজকে গড়ে তুলছে।
বাঁকুড়ার মৃৎশিল্প, বিশেষত মাটির ঘোড়া, বাঙালির সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। এই শিল্পে রয়েছে শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া ও গভীর সৌন্দর্যবোধ। একসময় ঘরোয়া উপকরণ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে মাটির পাত্র ও ঘোড়ার ব্যবহার ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আধুনিক প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটির পাত্র ও ঘোড়ার চাহিদা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন, যার ফলে বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা এই শিল্প ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
গাজন উৎসব পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ জীবনে একটি প্রাচীন ধর্মীয় অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের শেষে শিবের পুজো উপলক্ষে এই উৎসবে বিশেষ নৃত্য, গান, মেলা ও লোকনাট্যের আয়োজন করা হয়। এই গাজন উৎসব সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক ছিল। আধুনিক সময়ে সমাজের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়ায় গাজনের মতো উৎসবগুলো ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের তরুণ সমাজ শহরের জীবনধারায় আকৃষ্ট হয়ে লোকজ উৎসবের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।
লোকজ শিল্প হারানোর এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক উদাসীনতা, এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন। তাছাড়া, এই শিল্পীদের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও সাংগঠনিক সহায়তা দেওয়া হয় না বললেই চলে। বর্তমানে লোকজ শিল্পী ও কারিগরদের জন্য পর্যাপ্ত বাজার ও বিপণন কৌশলের অভাবও শিল্পের টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতির যথাযথ সংরক্ষণ এবং প্রচার করা। শিল্পীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লোকজ শিল্পের বিশেষ পাঠ্যক্রম চালু এবং স্থানীয় পর্যায়ে উৎসব-প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব। সরকারি উদ্যোগে সাংস্কৃতিক পর্যটন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই বিলুপ্তপ্রায় শিল্পগুলোর পুনরুজ্জীবন ঘটানো যেতে পারে।
শুধুমাত্র অতীতকে আঁকড়ে থাকা নয়, বরং অতীতের আলোকে বর্তমানকে সমৃদ্ধ করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। শিল্প ও সংস্কৃতির সঠিক সংমিশ্রণেই সম্ভব একটি সুস্থ, ঐক্যবদ্ধ ও মননশীল জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ। লোকজ শিল্পের পুনর্জাগরণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রেখে যাওয়া আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। সুতরাং, আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই লোকজ শিল্পের প্রাণ ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে, আমরা শিকড়ের সন্ধানে আবার নতুন যাত্রার সূচনা করতে পারি।
লোকশিল্পের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা:
বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও শিল্পের ইতিহাস হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে। পুরুলিয়ার ছৌনাচ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লোকনৃত্য, যার শিকড় রামায়ণ ও মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনীতে নিহিত। মুখোশ পরে যুদ্ধের গল্প ফুটিয়ে তোলা ছৌনাচে রয়েছে লোকজ ধর্মবিশ্বাস ও জীবনযাপনের গভীর ছাপ। বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া শুধুই সৌন্দর্যবোধ নয়, লোকজ দেবতার বাহন হিসেবে এর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় তাৎপর্য। গাজন উৎসব, শিবের আরাধনার সাথে গ্রামীণ বাংলার মানুষের মিলনের উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়, যা ঐক্য ও সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ছিল। কিন্তু আজকের দিনে এই সংস্কৃতিগুলো বিলুপ্তির পথে কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে নগরায়ণের প্রতিক্রিয়া। গ্রামীণ জীবনব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তনে লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বিশেষত, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শহুরে সংস্কৃতির আকর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। পুরুলিয়ার ছৌনাচ, যা একসময় ছিল গ্রামীণ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ, তা এখন কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ছৌনাচের শিল্পীরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য থেকে সরে গিয়ে নতুন পেশার দিকে ঝুঁকছেন। ফলে শিল্পের মধ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যে দক্ষতা ও পারদর্শিতা বহমান ছিল, তা এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাঁকুড়ার বিখ্যাত মাটির ঘোড়া শিল্পের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। একটি সময় ছিল যখন গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মাটির ঘোড়ার ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। এই শিল্পটি ছিল পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক। প্রতিটি মৃৎশিল্পীর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে তৈরি হতো অনন্য এই শিল্পকর্ম। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক, ধাতব ও আধুনিক উপকরণের সহজলভ্যতা এবং স্বল্পমূল্যের কারণে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমেছে। ফলে মৃৎশিল্পীরা আর্থিক সংকটে পড়ে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বহু পরিবার, যাদের একমাত্র রুটি-রুজি ছিল মৃৎশিল্প, আজ তারা অন্য পেশার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন।
গাজন উৎসবের ক্ষেত্রেও একই দৃশ্য। একসময়ের উৎসাহ-উদ্দীপনা ভরা এই উৎসব আজ অনেকটাই নিষ্প্রভ। গ্রামীণ ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐক্যের প্রতীক এই গাজন উৎসবে একসময় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতো। বর্তমানে শহুরে সভ্যতার প্রসারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান ও ধরনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হওয়ার কারণে গ্রামের সাংস্কৃতিক জীবন শূন্যতায় ভুগছে। ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান ও লোকজ রীতিনীতির প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহের অভাবেও গাজন উৎসবের উৎসাহ অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে।
লোকজ শিল্পের এই বিলুপ্তির কারণ হিসেবে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য— তা হলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সহায়তা, শিল্পীদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, এবং ব্যাপক বিপণনের সুযোগ না থাকায় লোকজ শিল্প ও শিল্পীদের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, শিক্ষা ব্যবস্থায় লোকশিল্পের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যথাযথভাবে তুলে না ধরার কারণে নতুন প্রজন্ম তাদের শিকড় ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞই থেকে যাচ্ছে।
এসব শিল্পের বিলুপ্তি ঠেকাতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি ও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা, আর্থিক সহায়তা, শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও উন্নত বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। নতুন প্রজন্মের মাঝে এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ পাঠ্যক্রম চালু এবং নিয়মিত লোকজ উৎসব আয়োজন অত্যন্ত কার্যকর হবে। এভাবেই আমাদের লোকশিল্প বাঁচিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে সম্ভব হবে আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের প্রকৃত সন্ধান।
লোকশিল্পের বর্তমান অবস্থা ও বিলুপ্তির কারণসমূহ :
বর্তমানে পুরুলিয়ার ছৌনাচ শিল্পীরা আর্থিক সংকট ও উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রায় একই চিত্র বাঁকুড়ার মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। শিল্পীরা জীবিকা নির্বাহের জন্য বাধ্য হচ্ছেন শহরমুখী হতে। গ্রামীণ জীবনধারার পরিবর্তন, আধুনিক প্রযুক্তির আগমন ও নতুন প্রজন্মের গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া—এ সবকিছুই এই লোকশিল্পের বিলুপ্তির প্রধান কারণ। আধুনিক প্রজন্মের কাছে এসব শিল্প তাদের জীবনধারার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, ফলে ক্রমাগত উপেক্ষিত হচ্ছে এসব লোকজ শিল্প।
পুরুলিয়ার ছৌনাচ একসময় গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনা প্রকাশের অপরিহার্য মাধ্যম ছিল। উৎসব-অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পীদের ব্যাপক চাহিদা থাকত। কিন্তু এখন সময়ের প্রবাহে শিল্পীদের পরিবেশনার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। স্থানীয় সংস্কৃতির পরিবর্তনে এবং গণমাধ্যমে বিনোদনের নতুন রূপের উপস্থিতিতে গ্রামীণ দর্শক-শ্রোতারাও বিমুখ হয়ে পড়েছে। আধুনিকতার প্রভাবে তরুণ প্রজন্ম টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে গ্রামীণ লোকজ ঐতিহ্যের প্রতি তাদের আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে। ছৌনাচের শিল্পীরা আর্থিক সংকটে পড়ে, জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছেন, এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পরবর্তী প্রজন্মকে এই শিল্পে পারদর্শী করে তোলার ইচ্ছেও হারিয়ে ফেলছেন।
অন্যদিকে, বাঁকুড়ার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রেও একই রকম সংকট দৃশ্যমান। এক সময় বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া বাংলার প্রতিটি ঘরের সৌন্দর্য বাড়াত, লোকায়ত দেবতার প্রতীক হিসেবে তার ব্যবহার ছিল সর্বজনীন। কিন্তু প্লাস্টিক, স্টিল ও অন্যান্য আধুনিক উপকরণ সহজলভ্য ও অপেক্ষাকৃত কমদামী হওয়ায় মানুষ এখন মাটির তৈরি জিনিসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। গ্রামীণ হাট-বাজারে মাটির পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় মৃৎশিল্পীরা দিন দিন পেশা পরিবর্তন করছেন। শিল্পীদের আয়ের উৎস সীমিত হওয়ায় তারা বাধ্য হচ্ছেন শহরের শ্রমিক, দোকানদার বা ছোটো চাকরির দিকে ঝুঁকতে। একসময়ের গর্বিত ও জনপ্রিয় এই শিল্প আজ শিল্পীদের কাছেই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতির প্রতি নতুন প্রজন্মের বিরাগের কারণেও এই শিল্পগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রামীণ লোকশিল্প সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকায়, তরুণরা এই ঐতিহ্যের গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যত বাড়ছে, লোকজ শিল্পের স্থান তত সংকুচিত হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বিপণনের অভাব এবং শিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের উদ্যোগ না থাকায় শিল্পগুলির ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সামাজিক সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া এই লোকশিল্পের অস্তিত্ব আগামী দিনে আরও সংকটে পড়তে বাধ্য। তাই এই শিল্পগুলিকে বাঁচানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লোকশিল্প বনাম আধুনিক শিল্পের সম্পর্ক ও পরিবর্তন:
আধুনিক শিল্পকলার সঙ্গে লোকশিল্পের সম্পর্ক গভীর ও জটিল। আধুনিক শিল্প মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, শিল্পীর ব্যক্তিগত ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। অন্যদিকে লোকশিল্প সামষ্টিক জীবনধারা, বিশ্বাস ও লোকাচারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। এই মৌলিক পার্থক্যই এই দুই শিল্পধারার সম্পর্ককে কঠিন ও জটিল করেছে। আধুনিক শিল্প সমাজের নগরায়ন, বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু লোকশিল্প এই দ্রুত পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছে।
লোকশিল্পের মূল শক্তি তার সহজ-সরল অভিব্যক্তি, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার মধ্যে। এই শিল্পের মধ্যে নিহিত রয়েছে গ্রামীণ মানুষের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ, প্রকৃতি ও মানবের নিবিড় সম্পর্ক এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। কিন্তু আধুনিক শিল্পের সাথে এই সরলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততার বিরোধ তৈরি হয়। আধুনিক শিল্প কলায় শিল্পীর ব্যক্তিগত দর্শন ও মানসিক দ্বন্দ্বকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে চলে যায়। এর ফলে আধুনিক শিল্প ও লোকশিল্পের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে, যা দুই ধারার শিল্পীদের একে অপরের প্রতি নির্লিপ্ত করে তুলছে।
আধুনিক শিল্পের নগরকেন্দ্রিক বিস্তার এবং বাজারনির্ভর বিপণন পদ্ধতির কারণে লোকশিল্পীরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছেন। শিল্পের বিপণন ও প্রচার কৌশলে আধুনিক শিল্পীরা প্রযুক্তিগত সুবিধা পাচ্ছেন, যা গ্রামীণ লোকশিল্পীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাশাপাশি, আধুনিক শিল্পীরা আর্থিকভাবে বেশি সক্ষম ও প্রভাবশালী হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও বেশি পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে, লোকশিল্পীরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাদের শিল্পকর্ম তুলে ধরার সুযোগ পান না।
লোকশিল্পের সৌন্দর্য ও গভীরতা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগের অভাবও এই দুই ধারার দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিল্পকলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোকশিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি করা হয় না। ফলে আধুনিক শিল্পের চমকপ্রদ উপস্থাপনা ও উচ্চ সামাজিক মর্যাদার প্রতি আকর্ষণ ক্রমেই বাড়ছে, এবং লোকশিল্প ঐতিহ্যগত আবেদনের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। আধুনিক শিল্পের জগতে সাফল্য ও অর্থনৈতিক লাভের হাতছানি থাকলেও, লোকশিল্পে সেই সুযোগ না থাকায় নতুন শিল্পীরা এই পথ বেছে নিতে অনুৎসাহিত হচ্ছেন।
ফলে এই দুই ধারার মধ্যে সম্পর্কের অবনতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর সাংস্কৃতিক সংকট। তবে এই অবস্থার উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত সাংস্কৃতিক নীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি। আধুনিক শিল্পের বিকাশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি লোকশিল্পের রক্ষা ও সংরক্ষণও জরুরি। একটি সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য দুই ধারার শিল্পীদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ও পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। এই ধরনের উদ্যোগই পারে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য করতে এবং দুই ধারার মধ্যে একটি কার্যকরী সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করতে।
লোকশিল্পের বিলুপ্তি ও আধুনিক শিল্পের বিকাশ:
লোকশিল্পের বিলুপ্তি আধুনিক শিল্পের বিকাশের সাথে সরাসরি যুক্ত। আধুনিকতার স্রোতে গ্রামীণ জীবন ও লোকাচার ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার কারণে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ সংস্কৃতির জীবনধারা ও শিল্প ঐতিহ্য ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই হারিয়ে যাওয়া শিল্পই ছিল আমাদের জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বস্তুত, শিল্পের বিলুপ্তি প্রক্রিয়ায় কেবলমাত্র প্রযুক্তি কিংবা নগরায়ন দায়ী নয়, বরং দায়ী সমাজের ক্রমাগত সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আধুনিক জীবনধারার প্রত্যাশা ও ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ ও শ্রদ্ধা ক্রমশ কমে গেছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্পের প্রতি উদাসীনতার অন্যতম কারণ হলো, এগুলো তাদের কাছে তথাকথিত ঽআধুনিকঽ জীবনধারার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। গ্রামীণ পরিবেশ ও প্রাচীন সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের যুবসমাজের সংযোগ কমে যাওয়ায়, লোকশিল্পের সঙ্গে তাদের অনুভূতিগত সংযোগ তৈরি হচ্ছে না।
এছাড়া, শিল্পের এই বিলুপ্তির পেছনে অন্যতম বড় কারণ হল অর্থনৈতিক অসাম্য। লোকশিল্পীরা তাদের শিল্পকর্ম থেকে যথাযথ আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না, কারণ তাদের সৃষ্টি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হয়ে উঠতে পারছে না। আধুনিক শিল্পের ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণের ফলে, পৃষ্ঠপোষকদের আগ্রহ এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নগরকেন্দ্রিক শিল্পের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে লোকশিল্পীরা আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন এবং তাদের শিল্পকর্ম ক্রমশ অবহেলিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, লোকশিল্পের উপকরণ ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাও এই শিল্পকে পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক শিল্পীরা তাদের শিল্পকে উন্নত প্রযুক্তি, ডিজিটাল মাধ্যম, এবং আধুনিক উপকরণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিতে পারছেন। এই সুবিধা লোকশিল্পীরা পান না বললেই চলে। ফলে লোকশিল্পের প্রসার ও প্রচার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, সেগুলো বেশিরভাগই যথেষ্ট নয় বা বাস্তবায়নে ঘাটতি দেখা যায়। লোকশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত শিল্পীদের জন্য যথাযথ বাজার সৃষ্টি না হওয়া, গ্রামীণ সংস্কৃতি ও শিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতার অভাব এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ঘাটতি—এসবই লোকশিল্পের বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করছে।
লোকশিল্পের বিলুপ্তি কেবলমাত্র একটি শিল্পের ক্ষতি নয়, বরং একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ও আত্মিক মূল্যবোধের বিরাট ক্ষতি। আধুনিক শিল্পের বিকাশে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদা ও স্বীকৃতি অর্জিত হয়, তেমনি লোকশিল্পের বিলুপ্তিতে হারিয়ে যায় জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান সম্পদ। তাই আধুনিক শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি লোকশিল্পের সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন সমান গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে, যাতে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত থাকে।
লোকশিল্পের পুনর্জাগরণে করণীয়:
লোকশিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। শিল্পীদের আর্থিক নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহী নতুন প্রজন্ম তৈরি করা সম্ভব। পাশাপাশি আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তির সঙ্গে লোকশিল্পের সম্মিলন ঘটানো যেতে পারে। ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে এসব শিল্পকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে নতুন বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব। এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে লোকশিল্পের গুরুত্ব বাড়ানো দরকার।
একটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি পর্যায়ে শিক্ষা নীতিতে লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করে তোলা হলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নিয়মিত কর্মশালা, প্রদর্শনী ও শিল্পীদের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে লোকশিল্প সম্পর্কে তাদের মধ্যে গভীর উপলব্ধি সৃষ্টি হবে।
সরকারি উদ্যোগে লোকশিল্প গ্রাম বা শিল্পকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটানো সম্ভব। যেমন, বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া বা পুরুলিয়ার ছৌনাচের জন্য নির্দিষ্ট শিল্পগ্রাম বা সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন করলে দর্শক এবং পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি পাবে, যা শিল্পীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করবে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই উদ্যোগে যোগ দিয়ে আরও শক্তিশালী বিপণন ব্যবস্থা তৈরি করতে পারেন, যা লোকশিল্পকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরবে।
এছাড়া, লোকশিল্পের ডিজিটাল আর্কাইভ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটানো সম্ভব। লোকশিল্পের ভিডিও, ডকুমেন্টারি, ইন্টারঅ্যাকটিভ ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা যাবে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় শিল্পীদের কার্যক্রম এবং তাদের জীবনগল্প তুলে ধরে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এতে লোকশিল্পের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সর্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
তাছাড়া, তরুণদের জন্য শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করে লোকশিল্পের ঐতিহ্যবাহী কৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা দরকার। এর ফলে তারা শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, বরং উদ্যোক্তা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন। লোকশিল্পের পুনর্জাগরণ শুধু একটি জাতীয় দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের পুনরুদ্ধার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জও বটে। এই সমন্বিত প্রচেষ্টাই পারে হারিয়ে যেতে বসা লোকশিল্পকে আবারও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে।
লোকশিল্পের ভবিষ্যৎ:
লোকশিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের সচেতনতা ও উদ্যোগের ওপর। শুধুমাত্র স্মৃতিকাতরতার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং আমাদের জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে লোকশিল্পের পুনরুজ্জীবন জরুরি। ভবিষ্যতে আধুনিক শিল্প ও লোকশিল্পের মেলবন্ধনে তৈরি হতে পারে নতুন একটি শিল্পধারা, যা আমাদের অতীতের গৌরবকে ধরে রাখবে আধুনিকতার ছোঁয়ায়।
লোকশিল্পের পুনর্জাগরণ একটি বৃহৎ সাংস্কৃতিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা উচিত। একুশ শতকের বিশ্বায়নের যুগে, শিল্প ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ হয়ে উঠেছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে লোকশিল্পকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে হবে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জীবন্ত প্রতীক হিসেবে লোকশিল্পের পুনঃপ্রবর্তন সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা ও দূরদর্শী পরিকল্পনা।
আগামী দিনে বৈদ্যুতিন মিডিয়া ও অপ্রকৃত বাস্তবতা মাধ্যমে লোকশিল্পকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করা যেতে পারে। অপ্রকৃত বাস্তবতার প্রদর্শনী, আদানপ্রদানমূলক ওয়েবসাইট, ও অপ্রকৃত বাস্তবতার মিউজিয়াম তৈরি করলে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের লোকশিল্প সহজেই পৌঁছে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, পুরুলিয়ার ছৌনাচ কিংবা বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়ার অপ্রকৃত বাস্তবতার প্রদর্শনী বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত কর্মশালার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে লোকশিল্প আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার জন্য লোকশিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতাকে যুক্ত করে নতুন রূপরেখার প্রবর্তন জরুরি। বর্তমান সময়ে বেশভূষাশৈলী, গৃহসজ্জা, এবং আধুনিক শিল্পের সঙ্গে লোকশিল্পের সৃজনশীল সমন্বয় নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারে। যেমন—মাটির তৈরি গৃহসজ্জা সামগ্রী, আধুনিক গহনা, পোশাক কিংবা সাজসজ্জায় ঐতিহ্যের নকশা ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটানো সম্ভব।
পাশাপাশি, সাংস্কৃতিক পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে লোকশিল্পের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্পকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হলে শিল্পীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। ফলে গ্রামের অর্থনীতিতে আসবে ইতিবাচক পরিবর্তন, যা লোকশিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সর্বোপরি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় লোকশিল্প ও সংস্কৃতির গুরুত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা ও শিল্পবোধ জাগিয়ে তুলতে পারলেই এই ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পগুলোর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে লোকশিল্প হয়ে উঠতে পারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের পরিচয়ের এক গর্বিত ও অপরিহার্য
উপসংহার:
লোকজ শিল্পের হারিয়ে যাওয়া আমাদের জাতীয় ক্ষতি। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমাদের শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করাও অপরিহার্য। এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখার মধ্য দিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টিকে থাকবে। আমাদের সচেতন উদ্যোগ, সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতাই পারে এই হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্পকে আবারও জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলতে।
বাংলার গ্রামীণ জীবনে লোকশিল্পের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, কেননা এটি সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রাম, আনন্দ-বেদনা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত ছিল। আধুনিকায়নের প্রবল স্রোতে যখন মানুষ নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখনই সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক শূন্যতার। তাই এই শূন্যতা পূরণের জন্য আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং রক্ষা করা আজকের দিনে একটি অপরিহার্য কর্তব্য (সেনগুপ্ত, ২০১৪)।
বিশেষত পুরুলিয়ার ছৌনাচ, বাঁকুড়ার মৃৎশিল্প ও গাজনের মতো সমৃদ্ধ লোকশিল্পকে হারানো মানে জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কেই হারানো। আজকের দিনে যখন বৈশ্বিক পরিসরে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে, তখন আমাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধরে রাখার গুরুত্ব সর্বাধিক। এই লোকশিল্পগুলি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও গর্বের জন্ম দিতে পারে (ঘোষ, ২০১০)।
লোকশিল্পের হারিয়ে যাওয়া শুধু শিল্পীদের আর্থিক অনিশ্চয়তা বা সাংস্কৃতিক ক্ষতি নয়, বরং এটি সমাজের নৈতিক অবক্ষয়কেও নির্দেশ করে। কেননা, যে সমাজ নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে, সে সমাজের নৈতিক ভিত্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় লোকশিল্প ও লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি। এতে করে তরুণ প্রজন্ম নিজেদের শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হবে (চক্রবর্তী, ২০১৮)।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে লোকশিল্পীদের আর্থিক সহযোগিতা, বিপণন ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের লোকশিল্পকে উপস্থাপনের মাধ্যমেই এই শিল্পগুলি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেতে পারে। সেইসঙ্গে শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ, উন্নত সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনাও এই শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে (দাশগুপ্ত, ২০১৬)।
এই সচেতন উদ্যোগের মাধ্যমেই আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারব। কারণ, শিকড়ের সন্ধানেই নিহিত আমাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের পুনর্জাগরণ।
তথ্যসূত্র:
১. সেনগুপ্ত, আশিস (২০১৪), "বাংলার লোকসংস্কৃতির ইতিহাস", কলকাতা: সাহিত্যলোক প্রকাশনী, পৃ. ৮৪-৯২।
২. ঘোষ, বিনয় (২০১০), "লোকায়ত বাংলা", কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, পৃ. ১২০-১২৬।
৩. চক্রবর্তী, সুদীপ্ত (২০১৮), "বাংলার লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ", কলকাতা: পুস্তক বিপণী, পৃ. ৪৫-৫৬।
৪. দাশগুপ্ত, শুভ্র (২০১৬), "আধুনিকায়ন ও বাংলার লোকশিল্পের সংকট", কলকাতা: প্রতিভাস পাবলিকেশন, পৃ. ৩৩-৪২।
=================
ভাস্কর সিনহা
বিশ্ব ভারতী এবং আই আই টি দিল্লীর প্রাক্তনী। দুবাই নিবাসী।

Comments
Post a Comment