সময়ের স্থির জগৎ
জয় মণ্ডল
পঁচিশ বছর ধরে প্রবীণ ঘড়ি মেরামতকারী বাবলু দাস ওরফে সুরেনবাবু, তাঁর দোকানের কোণে রাখা একটি পুরোনো, খোদাই করা কাঠের বাক্সকে এড়িয়ে চলতেন। বাক্সটি ছিল তাঁর বাবার শেষ স্মৃতি, যা তিনি কোনোদিন খোলেননি। বাক্সটি খুললেই নাকি সময় থেমে যায়, ছোটবেলায় তাঁর বাবা এমনটাই বলতেন।
একদিন রাতে, বাইরে প্রবল ঝড় বইছিল। সুরেনবাবু হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, তাঁর দোকানের সব ঘড়ি অদ্ভুতভাবে একই সময়ে থেমে গেছে: ১১টা বেজে ১১ মিনিট। বিদ্যুৎ ছিল না, কিন্তু প্রতিটি ঘড়ি স্থির! অস্থির হয়ে তিনি যখন টর্চ জ্বালালেন, তখনই তাঁর চোখ গেল সেই পুরোনো কাঠের বাক্সের দিকে। বাক্সটি থেকে ক্ষীণ, হলুদ আলো বের হচ্ছে।
ভয়, কৌতূহল এবং বাবার প্রতি ভালোবাসার মিশ্র অনুভূতির মধ্য দিয়ে সুরেনবাবু কম্পিত হাতে বাক্সটির ঢাকনা খুললেন। ভেতরে ছিল একটি মাত্র জিনিস: একটি মরচে পড়া, হাতল ভাঙা ব্রোঞ্জের চাবি।
চাবিটি হাতে নিতেই সুরেনবাবুর কানে একটি চাপা গুঞ্জন ভেসে এলো, যা বাইরে বয়ে চলা ঝড়ের আওয়াজকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল। তিনি টের পেলেন, শুধু ঘড়ি নয়, তাঁর চারপাশের জগৎও স্থবির হয়ে গেছে। ঝড়ের যে ফোঁটাটি কাঁচের জানালায় সবেমাত্র আঘাত করতে যাচ্ছিল, সেটিও মাঝপথে স্থির। বাইরে গাছের একটি পাতা, যা ঝরে পড়ছিল, সেটাও শূন্যে স্থির হয়ে আছে। সময় থেমে গেছে ১১:১১ মিনিটে।
প্রথমে সুরেনবাবু ভয় পেলেন। তারপর ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলেন। এই জগতে কেবল তিনি এবং তাঁর চিন্তা-ভাবনা গতিশীল। এই সুযোগে তিনি নির্ভয়ে তার দোকানে ঘুরে বেড়ালেন। প্রতিটি ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়ে দেখলেন, কিন্তু কোনো কিছুতেই পরিবর্তন এলো না।
তিনি চাবিটি নিয়ে ভাবতে বসলেন। বাবার বলা কথাটা কি তবে সত্যি? চাবিটি কি সময়ের নিয়ন্ত্রণকারী? হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, তাঁর কৈশোরে তাঁর বাবা প্রায়ই বলতেন, "সবচেয়ে ভালো সময়গুলো হারিয়ে যাওয়ার আগে ধরে রাখতে হয়, বাবু। সময়ের কাজ চলে যাওয়া।"
সুরেনবাবু দ্রুত দোকানের দরজার দিকে ছুটলেন। বাইরে বের হয়ে দেখলেন, বৃষ্টির প্রতিটি রেখা বাতাসে জমে আছে, মানুষের হাঁটা পথ থেমে গেছে, রাস্তার কুকুরটিও মাঝপথে স্থির। যেন প্রকৃতি এক বিশাল স্থিরচিত্র।
তিনি উপলব্ধি করলেন, এটি সুযোগ। তাঁর স্ত্রী অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে যে বিশেষ ফুলের সুবাস নিতে পারেননি, সেটি এখন তাঁর হাতের নাগালে। পাশের বাড়ির লন থেকে সেই দুর্লভ ফুল চুরি হতে যাচ্ছে—চোরটিও থেমে আছে চুরি করার মাঝপথে।
সুরেনবাবু দ্রুত পাশের বাড়িতে গেলেন, থেমে থাকা চোরের কাছ থেকে ফুলটি নিয়ে এলেন। এরপর ফিরে এসে তিনি স্থির ঝড়ের মাঝেই সেই ফুল নিয়ে গেলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে। স্ত্রীকে স্পর্শ করতেই তিনি দেখলেন, তাঁর স্ত্রীর চোখে একটি চিকচিক ভাব, যেন তাঁর জন্য সময় আবার চলতে শুরু করেছে। স্ত্রী সেই ফুলদানিতে ফুলটি নিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিলেন।
স্ত্রীর মুখে হাসি দেখে সুরেনবাবু বুঝলেন, আসল জাদু চাবিতে নয়, সেটিকে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে।
তিনি ফিরে এসে কাঠের বাক্সে চাবিটি রাখতেই, রাত ১১:১১ থেকে আবার টিক টিক করে ঘড়িগুলো চলতে শুরু করল। ঝড়ের ফোঁটা জানালায় আঘাত করল, গাছের পাতাটি মাটিতে পড়ল। সব আবার স্বাভাবিক।
সুরেনবাবু দেখলেন, তাঁর স্ত্রী হাতে সেই ফুলটি নিয়ে শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, জীবন কেবল সময়ের অঙ্কে বাঁধা নয়, কিছু মুহূর্ত মূল্যবান যা কেবল ভালোবাসা দিয়ে স্থির করা যায়।
==============
জয় মণ্ডল,
কালীমন্দির পূর্বপাড়া, কালিকাপুর, পোস্ট - কালিকাপুর, সোনারপুর, পশ্চিমবঙ্গ - ৭৪৩৩৩০

Comments
Post a Comment