অকালপ্রয়াত ছাত্র কবি শঙ্করলাল সেনগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ : 'নিশীথ সূর্য' নিয়ে আলোচনা করেছেন শিক্ষক মণীন্দ্রনাথ বাগ
অন্বেষণ
(প্রসঙ্গ : নবীনকবি শঙ্করলাল সেনগুপ্তের কবিতাকে ঘিরে একটি আলোচনা। শংকরলাল আমার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত ছাত্র। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছাড়াও এক নিবিড় বন্ধনে আমরা মধুরিত সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলাম। তার অসময়োচিত মৃত্যুতে সেদিন ব্যথিত হয়েছিলাম।)
মণীন্দ্রনাথ বাগ
শঙ্করলাল বড়োসাধ করে আমাকে একটি কবিতার বই উপহার দিয়েছিল। বলেছিলো, এই সংকলনটি একটু পড়বেন। এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বেন। দুটি একটি লাইনে মন:সংযোগ করলেই আমাকে খুঁজে পাবেন। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাকে মেলে ধরলাম। আমরা বিশেষ করে আমি, আপনার আশীর্বাদ ধন্য।আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জীবনের অনেকটা পথ হাঁটলাম।প্রকৃতির বিচিত্রতাকে দেখলাম।জীবন আমাকে অনেকটাই দিয়েছে। এবং এখনও দিচ্ছে।পথে অনেকের সাথে আলাপ হলো,সখ্যতা হলো, বন্ধুত্ব হল কিনা বলতে পারবো না। স্বার্থ পীড়িত এক শ্রেণির মানুষের সাথে যেমন আলাপ হলো আবার ঠিক তেমনটিই এমন এক শ্রেণির মানুষ জনের সাথে আলাপ হলো যাঁরা আকাশের পূর্ণিমা চাঁদকে দেখেআজও গড় করে, চমৎকৃত হয়,খুশিতে হাসে। তবে ভালো মানুষের সংখ্যা প্রায় নগন্য বললে সত্যের অপলাপ হয় না। শিক্ষিত মানুষজনেরা কমনীয় হতে কিংবা নমনীয় হতে আজও দেখলাম, ভুল করে।
"নিশীথ সূর্য" তার কবিতা সংকলনের নাম দিয়েছে। "এক বিশাল হৃদয়েরই স্বাক্ষর, দলিল"। "সংকলনের সম্পাদনা সে নিজেই করেছে সেখান কোনো কমপ্রোমাইজ করেনি। ভূমিকা তথা নান্দীপাঠে প্রকাশক আস্থাভরে লিখেছেন : কবি প্রেমের পূজারী। একই সাথে আলোর পূজারী। তাঁর জীবনে যাঁরা ফুলের গন্ধ আর আলোকের দর্শন এনেছেন,তাঁদেরকে কবি হদয়ের আবেগ দিয়ে ধরতে চেয়েছেন। প্রকৃতি ও মানুষ, জল এবং স্থল,নিরন্তন স্রোত ও স্রোত-তরঙ্গের আশ্চর্যময়তার এক আবহের অবয়বকে চিত্রার্পিত করেছে তাঁরই সৃষ্টিরপরতে পরতে। রাত্রির অন্ধকার যতো ঘন হয়েছে ততো মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়েছেনএবং বুদ্ধসূর্যের শরণাপন্ন হয়েছেন। সেই অর্থে তাঁর কাব্য গ্রন্থটি "নিশীথ সূর্য " এক তুল্যমূল্য হৃদয়ের স্বাক্ষর এবং বলাযেতে পারে এক বিশিষ্ট দলিল। প্রকাশকের এই অভিব্যক্তি তার সৃষ্টির নান্দনিক দিকের ইঙ্গিত দেয় নি:সন্দেহে। পরবর্তী সংকলনের সম্ভাবনা আর কারোরই নাগালের মধ্যে নেই। কারণ,কবি প্রয়াত হয়েছেন অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার গভীরে পড়ে।রহস্যময় তার অকাল প্রয়াণে আর পাঁচজনের মতো আমিয়ো দ্বিধা-বিভক্ত ।বলা বাহুল্য,ঘটনার যে বিবরণ আমি পেয়েছিলাম সেদিন, তাতে মন ভেঙে গিয়েছিলো। কোনটা সত্যি,কোনটা সাজানো মৃত্যু জাল! তার মতো কঠিন কঠোর ব্যক্তিত্ব চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল .....!! প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারিনি। আজও তার সদর্থক পটভূমির নিশানা পাওয়া হয়নি। নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ হল,অভিমানের প্রতিমা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েই গেল-- সেই নবীন কবির নাম হলো শংকরলা সেনগুপ্ত।মন মানসিকতায় একজন সুজন ও ভদ্র। ছাত্র হিসাবে বিশিষ্ট মেধাবী। সারস্বত সাধনা তার অন্যতম ভালো লাগার জায়গা।কারোর অধিকার নেই সেই জগতে প্রবেশ করার। সেখানে সে নিজেই নিজের অভিভাবক।কঠিন কঠোর নিয়মনীতির পরিমণ্ডলে দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত হওয়ার পরও কেমন ভাবে সেই ব্যক্তিসত্তায় কবিতা-প্রীতি স্থান পেয়েছিলো তা সততই আমাকে ভাবিয়ে তোলে।কঠিন-কঠোর নিয়মনীতির মাঝে তার কাব্যপ্রীতি, বিশেষকরে বাংলাসাহিত্যের অঙ্গন তাকে মুগ্ধকরেছে, এটাই বড়ো কথা। আমার যতোটুকু বিশ্বাস,দৈনন্দিনের কর্মবিরতির পর সারস্বত সাধনায় নিজেকে জারিত রাখার সংস্কৃতিতে নিজেকে বিধৃত রাখার বাসনাই তাকে আলাদাভাবে সম্মানিত করেছে। মনে পড়ছে,দেশের স্থল বাহিনীর কমান্ডার পদ থেকে ওর অবসর যখন প্রায় আসন্ন, ওর জন্য লিখেছিলাম: "কান পেতে শোনো" কবিতাটি.......
দিনান্তের আলোক রেখা
তোমার মুখের ওপর এখন পড়ছে।
বুঝি সময় এখন হাসিখুশি বেশে
তোমায় ডাকছে.... নতুন সংকেতে
রমণীয় করে ডাকছে।কানপেতে শোনো
সময় এবার বুঝি বিচিত্র বাসনায় ডাকছে!!
সময়ের আস্তিনটা পারলে টেনে ধরো ,
ওর গতির আগে তোমার গতি প্রত্যাশিত।
অবসরের সংজ্ঞা তোমার তো জানাই আছে---
সে অর্থে থেমে যাওয়া নয়,বরং ভিন্ন পথে জীবনকে
সঁপে দেবার পরিশিষ্ট কাল।অবকাশের চালাঘরের নীচে
প্রকৃতি দিয়েছে অনেক--শাশ্বত:,
অতীত দিয়েছে অনেক--অযাচিত,
বর্তমান দিচ্ছে অনেক -- বিচিত্র।
ভবিষ্যৎ যা দেবে বলে...কথা দিয়ে গেছে
তুমি জানো, নিশ্চিত জানো......
আলপনা এঁকে দেবে গৃহদ্বারে
তুমি পা রাখবে নতুন ভোরে.....।
নতুন ভোরের অনেকটা আকাশ
সোনালী আলোর সৌরভে স্পন্দিত হবে
ললিত বেদান্ত গানে।
অবশিষ্ট জীবন পাবে সাগর লহরী
নিশ্চুপ হিমালয়ে মধুরিত বাঁশরী--
সমর্পিত প্রার্থনার আলোক প্রতিমা
অনাস্বাদিত জীবন আনন্দ,আর
অস্তরাগের বর্ণময় প্রকাশ------।
মানুষ ভাবে এক,কার্যত: ঘটেই যায় আর এক। এই বিভ্রাটের সাথে অল্পবিস্তর প্রায় সকলেরই পরিচয় আছে। শংকরলালও বোধকরি এই প্রবাদের ব্যতিক্রম ছিলো না। তিল তিল করে গড়া ব্যক্তিত্ব কোন চাঁই পাথরের গায়ে সজোরে ধাক্কা খেয়েই শংকরলাল খুব তাড়াতাড়িই হারিয়ে গেল। আরো কিছু বছরের জীবন তার ও পাওনা ছিল। ভাগ্যের পরিহাস,মেনে নিতেই হয়।মেনেনিতে পারা যায় বলে সংসার আবারো চলতে শুরু করে।।
বিদেহী বাতাসও শোকাহত।জানিয়ে গেলো তার মর্মান্তিক অ্যাকসিডেন্টের খবর।অভিশপ্ত সেই সকাল তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব মহলে বেদনার্ত বিষাদ ছড়িয়ে গেলো।মর্মান্তিক সেই বিদায় আমাকে বিশেষভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। কিছু কিছু অনুমান,সেই অবস্থায় কানে আসতে থাকলো।একসময়ে আমার মনে হল শংকরলালের এই বিদায় এক রহস্যে ঘেরা।পরবর্তীতে ওর পরিবার সেই রহস্যের কুল-কিনারা করতে পেরে ছিল কিনা, সে প্রসঙ্গ আমার জানা নেই। তবু,মনে হয়, তার পরিবারের আচরণ-বিধি, স্বজন পোষণ নিয়ে তির্যক কোনো অভিব্যক্তি তাকে বিচলিত করে থাকতে পারে। অভিমান যখন অনেকটা গভীরে গিয়ে তল হারিয়ে ফেলেছিল,তখনই সে দ্বিগ্বিদিক হারিয়েই বসে।এটি আমার অনুমান।কতোশত মানুষ এমন অভিমান কে কেন্দ্রকরে নিত্য যে হারিয়ে যাচ্ছে, তার ইয়ত্ত্বা নেই। ফ্রেশ অক্সিজেনের তাগিদে সেও হয়তো সংসার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু কথায় কথায় সে যে বলতো,এমন ভাবে পালিয়ে বেড়ানোতো কাপুরষতার লক্ষ্মণ। যাইহোক, ঘটনার লিপিরেখা অনিবার্য ভাবেই ঘটে গেছে হয়তো ।
তার ঐ প্রথম কাব্যগ্রন্থটি সহানুভূতি সহ পাতায় পাতায় চোখ বোলাতে গিয়ে অন্বেষণের বাহানায়............
1)তার কাব্যরীতি 2)ভালোলাগা মন্দলাগার অনুভব
3)কল্পনা প্রতিমার রূপবৃতি4)শব্দচয়ন এবং সঠিকভাবে
তার প্রয়োগের নমুনাকে সঞ্চয় করার বাসনায় 5)কোনো
আক্ষেপকে সে কেমন ভাবে ব্যক্ত করতো,কিম্বা তা'থেকে
বেরিয়ে আসার জন্য সাহিত্যের কাছে কোন পথের নির্দেশ
চেয়ে হাত পাততো, শরণাপন্ন হতো,সেই সমস্ত জিজ্ঞাস্য নিয়েই "অন্বেষণ"--এর কথা বলতে বসা।
নিতান্তই সৌখিন প্রত্যাশা নিয়ে তার কবিতার কাছে যাওয়া....সমালোচিত হতেই পারি।নিন্দা কেউ করলে জানবো, আমি সচেতন ভাবে সঠিক আছি।জানবো, আমার এ প্রচেষ্টা তার "বৌদ্ধিক সত্ত্বার" স্বীকৃতি কে প্রাধান্য দেওয়ার প্রচেষ্টা, এক সত্য অনুসন্ধানের নামান্তর।
"যাবার বেলায়" কবিতায় শঙ্করলাল লিখে গেছে.......
উদ্দামতা গেছে পিছিয়ে ,
পর্ণহীন আমি দাঁড়িয়ে একা
বার্ধক্য আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলছে আমাকে
তবু--------নিরাশ করবো না.....যদি,
যদি চলে যাই,ফুল হয়ে যেন ঝরে না যাই
স্পন্দনহীন এই কায়ায়
এক অভিনব স্পন্দন
পেয়েও নিজের শেষ লেলিহানে
দিয়ে যাবো,আমার নিঙড়ানো উষ্ণতা।
আনমনা কবি। বার্ধক্যের পদধ্বনি যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। জীবনবৃক্ষ পর্ণহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশ:। শীর্ণ দীর্ণ সকল আশামুকুল।শেষ হবার আগে "ফুল হয়ে যেন ঝরে না যাই"। এসবই তার জীবন চেতনা। প্রকৃতিকে সরস ফল উপহার দেওয়ার বাসনাধরে আছে।তবুয়ো,কবি নিজেকে খুব সাবধানী সজাগকরেই রাখতে চেয়েছে, কেন কী, সে ফুল হতে ফলের আশায় আছে,পরম্পরার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী।তাইতো সে নিষ্ঠাসহ বলছে "ফুল হয়ে যেন ঝরে না যাই"। লেলিহান শিখা- জাত সকল উষ্ণতা রেখে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো হবে,কবিমন কোনো এক অজানা কারণে আহত।
গভীর ভাবেই আহত। কী নির্মম অপ্রত্যাশিত পরণতি!!
অনন্ত দৃষ্টি দূরন্ত জলরাশি
অগুন্তি ঢেউ এর উজ্জ্বল হাসি।
ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনায়
ধুলো পড়া আয়নায়
নিজেকে নিজেই দেখে!!
স্মৃতির দিগন্তে ভাসি।
"ছেঁড়া ভাবনায়" কবি যেন অসংখ্য ঢেউ এর আনাগোনার পথধরে ভাসমান। বিরাম নেই, স্মৃতিথেকে স্মৃতির অন্তরে ঝরে পড়ছে কর্তব্যভারের অনন্য মুহূর্ত কথা। সেই সংগে, সমুদ্রের আদি অকৃত্রিম নীলের কোলাহলে সংহত অতীত যা নাকি জয়-পরাজয়ের অহরহ অভিক্ষেপ কবিকে আরো আহত করেছে। বিষাদ ছায়ায় কবি নিরুত্তাপ।
লালমাটির অরণ্য উপত্যকায়, শঙ্করলালের চাকরির শেষ অধ্যায়টা কেটেছে। উগ্র প্রাদেশিকতায় সংস্কারাচ্ছন্ন আদীবাসীরা নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য তখন আন্দোলন মুখর। সে সময় চলছে বাম জমানা এবং তা ক্ষয়ের মুখে। তীক্ষ্ণ আন্দোলনের আভাস লালমাটি জুড়ে। অনিবার্য সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শংকরলাল। ওরা মানবিকতার ধারধরেনি। কোনো আহ্বানে সাড়াদিতে চায়নি। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শংকরলাল শান্তসমাহিত। এই পরিস্থিতিতে, শংকরলাল লিখে গেছে---
"তোমার আগমনে কবিতা হয় সমৃদ্ধ
তাই বোধ হয় এ দীনের
পথ চেয়ে বসে থাকা।
মনে হয় এবার এলে
আর ছাড়বো.না তোমায়....
একবারও ভেবে দেখিনি
তোমায় যে নিজের করে রাখবো
তার সাধ্য কিংবা অধিকার
কোনোটাই কী আছে আমার!!
উদাসী দখিন হাওয়া যখন
শির শিরিয়ে আমাকে স্পর্শ করে যায়,
তোমার উষ্ণ বুকের ঘ্রাণ
আমাকে চমকিত করে মুহূর্তকাল....
তবে কি সত্যিই এলে তুমি মান-অভিমান ফেলে!
সম্বিতে দেখি,সে তো তুমি নও।
অশরীরীতে তোমার ঘ্রাণ ।
লুকোচুরি খেলে নিত্য আমার সাথে ।
*************
Name:: Manindranath Bag
163/4,Kotrung Dharmatala Lane,
Po.Hindmotor, Dt.Hooghly WB
Pin...712233.

Comments
Post a Comment