মানবজীবনের সৃজনশীলতা
অনন্তকুমার করণ
শাস্ত্রে বলে মানবজন্ম দুর্লভ। কোটি কোটি জন্ম অতিক্রম করে জীব বিবর্তনের পথ ধরে মানব জন্ম পায়। শাস্ত্র না মানতেও পারি। সীমিত ইন্দ্রিয়শক্তি দিয়ে ঈশ্বরের উপলব্ধি সম্ভব নয়। মনে হতে পারে, পূণর্জন্ম, পরলোক, আত্মার অস্তিত্ব, ঈশ্বর ইত্যাদি সবই ধোঁয়াশা। এইসব জটিল বিষয় না ভেবে সৃজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে জীবনকে দেখা যাক।
আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন, মৌল মানবসত্ত্বা, বুদ্ধিবৃত্তি,পরিবেশ, সমাজ, স্বাস্থ্য, কল্যান এবং রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবন, দার্শনিক ও ধর্মীয় জীবন এবং প্রেম ও বিবেক ইত্যাদির উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করলে কি আনন্দ ও আলোয় আমরা উদ্ভাসিত হতে পারবো না? এই স্পন্দন কি ঈশ্বর লাভের সহায়ক নয়?
মানুষ মননশীল প্রাণী, অশন, বসন, যৌন-আচরন-সবক্ষেত্রেই তার আলাদা মর্যাদা, রকমফের ও নিয়ম-কানুন আছে। প্রত্যেকটি জীবন সত্ত্বার সঙ্গে তার পরিবেশ অবিচ্ছেদ্য। আমার মধ্যে সব না, সবার মধ্যে আমি? সেই তো তুমি, তুমিও তো সে!!
দেহ আর মন-দুটোকেই একসাথে ধরে রাখে জীবন। আত্মার কথা বলতে চাই না। মনের গহনে অনেকগুলো প্রকোষ্ঠ আছে জানলেও আজ বলবো কেবল অবচেতন মনের কথা। এই অবচেতনের অন্তঃস্থলের আবেগ-অনুভূতিগুলো থেকেই উৎসারিত হয় মানুষের সকল সৃজনকর্ম।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শুধু আদায়ের সম্পর্ক নয়, তার সঙ্গে একাত্ম না হলে সে বাঁচবে না। শিক্ষা হবে তার সারা জীবনের সাধনা। সমস্ত শিক্ষাই মানুষের কল্যানে নিবেদিত, আত্মকল্যানে নয়। বুদ্ধিজীবীদের স্বাতন্ত্র নিন্দনীয়। কর্মজীবীদের সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে। কর্মের সঙ্গে শিক্ষা সর্বক্ষণ জড়িয়ে থাকবে। নৈতিকতাকে শিক্ষা ও প্রযুক্তির অঙ্গ করতে হবে। অশিক্ষিত কর্মজীবীদের কোন কর্মই সার্থক নয়। এখানে শিক্ষা মানে সাক্ষরতা নয়, শিক্ষা তাকেই বলা হবে, যা শিক্ষার্থীর স্বভাব-চরিত্রে স্থায়ী পরিবর্তন আনবে, যেন সে পূণর্জন্ম লাভ করে নতুন মানুষ হয়েছে মনে হবে।
অর্থনৈতিক সাম্য ও আর্থিক স্বাধীনতা:
সবচেয়ে আগে জন্মহার কমাতে হবে। মাতৃত্বকে দিতে হবে যোগ্য মর্যাদা ও উচ্চহারে আর্থিক সম্মানমূল্য। শিশুদের তো বটেই, পরিবারের সদস্যদের নিঃসঙ্গতার সমাধান করতে হবে। যুবক-যুবতীরা যাতে উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কোন কাজে সবসযয় ব্যাপৃত থাকতে পারেন, তা রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। শ্রমিকরা, যারা উৎপাদন করছে এবং মালিকরা, যারা তাদেরকে দিয়ে উৎপাদন করাচ্ছে-দুই পক্ষকেই জনস্বার্থের কথা ভাবতে হবে ও সমাজের কল্যানে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। অবসরকে সৃজনশীলতা দিয়ে না ভরালে সমাজ তার গতি হারাবে।
মানুষ সবসময় মহাজাগতিক প্রাণশক্তির অংশ। তাই তার আত্মিক স্বাধীনতা যেমন প্রয়োজন, অর্থনৈতিক সাম্যও তেমনি প্রয়োজন। কায়েমি ব্যবস্থা প্রবীনদের মন যুগিয়ে রাখে। প্রতিষ্ঠানকে তরুণরা মনে করে পথের কাঁটা। তাই ভাঙতে হবে দুই পুরুষের এই বিসংবাদ। সেজন্যে নতুন মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে অচলায়তনকে ভাঙতে হবে।
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবন:
রাজনীতিকে কী ভাবে কলুষমুক্ত করা যায়, ভাবতেই হবে সবাইকে। গণতন্ত্রের ত্রুটিগুলো কী ভাবে দূর করা যেতে পারে, বিশেষ গবেষনা প্রয়োজন। নেতৃত্বের যোগ্যতার মাপকাঠি সুস্পষ্ট করতে হবে। গুনবানদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাছে লাগানো দরকার। সৃজনশীল মানুষকে এই সব বিষয়ে গবেষনা করতে হবে।
চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষ হবে সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে। প্লেটো বলেছিলেন,শিশুর প্রথম শিক্ষা হবে শরীরচর্চা ও সঙ্গীত। এগুলি তার দেহকে বলিষ্ঠ ও সুন্দর করবে এবং মনোজগতে আনবে সমন্বয়বোধ। পরবর্তী পর্যায়ে থাকবে বিজ্ঞানচর্চা ও যুক্তিবাদ, সবশেষে দর্শন। সৃজনশীলতার আদর্শে রাজনৈতিক জীবন গড়তে হলে বৌদ্ধিক স্তর উন্নত করতে হবে। উন্নত হৃদয়বত্বা- -সম্বলিত ব্যক্তিগত নীতিকে কোন মতাদর্শ গ্রাস করবে না। কেবনমাত্র তখনই তারা নিজেদের নিয়ম নিজেরা গড়ে নিজেকেই সেই নিয়মের বাঁধনে বাঁধতে পারবে।
নতুন সৃষ্টির বীজ বপন করতে হবে নিজেরই মনোভূমিতে।
দার্শনিক ও ধর্মীয় জীবন:
আগে থেকেই জীবন বিদ্যমান ছিল না পরে হয়েছে? বৌদ্ধমতেই এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়--না থাকার মধ্যেই নিহিত থাকে হয়ে ওঠার সহজাত সম্ভাবনা। বৌদ্ধশূণ্যবাদ অনুসারে মূলতঃ সবকিছুই শূণ্য।
মৃত্যুর পর প্রাণ কী নিখিল বিশ্বের পরপারে পরম আধ্যাত্মিক সত্যে মিশে যায়? ইকেদা বলেছেন, 'বিশ্বরূপের সামান্য অংশই যেহেতু ইন্দ্রিয়গোচর, তাই আমাদের দর্শনের দ্বারস্থ হতে হয়। মহাকাশক্ষেত্রের এমন গুন বা ধর্ম রয়েছে, মা ভৌত বস্তুসমূহকে প্রভাবিত করে। অবস্থাবিশেষে বস্তুও সৃষ্টির কাজ করতে পারে। জড়বস্তুই তাই জীবনের উৎস।
মানব সভ্যতা গড়ার পেছনে আছে উদ্বৃত্ত ও অবসর। উদ্বৃত্ত নিয়ে সুবিধাভোগীরা ভোগবিলাসে মাতে, কিন্তু অবসরভোগী ছোট্ট একটি গোষ্ঠি সৃজনশীল কাজ করে সাধারন কে সঙ্গে নিয়ে সভ্যতা গড়ে, টিকিয়ে রাখে ও এগিয়ে নিয়ে যায়। এটা সম্ভব হয় ধর্মের টানে। ধর্ম কোন আচার-অনুষ্ঠান নয়, জীবনকে দেখার একটা ভঙ্গী মাত্র। সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে কিছু অমানবিকত্ব ও অযৌক্তিকতা থাকতে পারে। তবুও ধর্ম শব্দটির ইতিবাচক তাৎপর্য আছে। ধর্ম অলীক চিন্তায় ন্যুব্জ নয়--বেঁধে দেওয়া আচরনবিধিতে বন্দীও নয়। মানুষের মানবিক হয়ে ওঠার পথের কাঁটা ধর্মই পারে সরিয়ে দিতে। কোন জাতি যখনই তার ধর্মবিশ্বাস হারিয়েছে তখনই তার সভ্যতা বিশৃঙ্খলায় বা বাইরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ধর্মই মানুষকে লোভমুক্ত করে নির্মল পরিবেশে বাঁচতে শেখায়। নিজেকে বদলানোই হবে মানুষের প্রথম ও প্রধান কাজ। পরিশুদ্ধ নৈতিক মূল্যবোধই মনুষ্যত্বের প্রাথমিক শর্ত। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে মানুষ ভালোকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয়,-- এই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।' বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তিত্ব সুযোগ পেলেই অনাচার করে। সাধ্য - সাধনের অদ্বৈত ছাড়া মনুয্যত্ব বিকশিত হতে পারে না। ঋত্বিক ঘটকের 'যুক্তি-তক্ক-গপ্পো' - র বেদনাহত নায়ক বলছে, 'সমষ্টির কল্যানে ভাবা প্রাকটিস্ করতে হবে। মানুষকে ব্রতী করতে হবে এই কাজে।
আত্মোন্নতি ও মানবিক বিপ্লব:
যে অগ্রগতিকে আমরা সভ্যতা বলি, তা শুধুমাত্র প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি। তাতে মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কমে গেছে। মানুষে মানুষে ভাগ্যের যে হেরফের হয়, তার পেছনে থাকে তাদের বংশগতি, পরিবেশ ও কর্ম। কর্ম হলো মরণশীল মানুষের পুরুষ পরম্পরায় বিস্তৃত সম্পর্কের সূত্র। ব্যক্তির সমবায়ে গঠিত বলেই সমাজ, প্রতিষ্ঠান, জাতি,-এগুলো সব জীবন্ত সংস্থা এবং এরাও নিজেদের কৃতকর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয় ও নতুন কর্ম সৃষ্টি করে। 'টয়েনবি'-র কথায়,-'স্থান আর কাল হলো সত্যের বস্তুগত দিকের ক্রিয়া বা কর্ম, সত্যের আত্মিক দিকটিও কম বাস্তব নয়।'
চেতনা, জীবন আর পদার্থ -এরা পরস্পরের থেকে পৃথক নয়, নিবিড় সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু এদের সম্পর্কের সূত্রগুলো আমাদের বোধের অগম্য। শরীর ও মনের সংযোগে জীবন এক অখন্ড সত্য। বাসনা, যুক্তিযুক্ত চিন্তা আর স্মৃতি, এদের পারস্পরিক সহযোগিতায় দেখা দেয় প্রেম আর বিবেক-বুদ্ধি। প্রেমের সঙ্গে ঘৃণার আর বিবেকের সঙ্গে পাপের পিঠোপিঠি সম্পর্ক। অন্যায় করার সময়েও যে কাজটা ঠিক হচ্ছে না, বিবেক সেটা মনে করিয়ে দিতে ভোলে না।
প্রেম মানে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, তার পেছনে থাকে ব্যক্তিগত আবেগ। নৈর্ব্যক্তিক হয়ে যখন তা দাতব্য কোন প্রতিষ্ঠানের চেহারা নেয়, তখন তাতে শুধু অহংসর্বস্ব দান-খয়রাতির ভাব থাকে।
পরের দুঃখ নিজের বলে অনুভব করে, সেই দুঃখ দূর করার যে ইচ্ছা, তাকেই বৌদ্ধমতে করুণা বলে। এই করুণাই দুঃখকে সরিয়ে সুখ এনে দেয়।
মানুষের সবচেয়ে বড় মানদন্ড হলো জীবনের মর্যাদা। আকাশ, বাতাস, নদী, পাহাড়, মাটি, জল, পাথর, সবকিছুরই মর্যাদা আছে। এদের মর্যাদা হরণ করলে মানুষ তার নিজের মর্যাদাও হারাবে। মানুষের জীবন কিছু অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নয়, তা একান্তই বস্তুতান্ত্রিক। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষের জীবন গঠন করে, স্থিতিশীল করে, ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করে, আবার মানুষই সেই ব্যবস্থাকে তার প্রয়োজনে পরিবর্তন করে। আত্মিক ও মানবিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তাই নিরন্তর সৃজনশীল সংগ্রামের দ্বারা পরিবর্তন আনতে হয়। বিজ্ঞানের যেমন অপপ্রয়োগ হয়, ধর্মেরও অপব্যাখ্যা এবং অপপ্রয়োগ হয়, আবার অনুসন্ধানী মনেরও দ্বন্দ্ব থাকে। তাই নিত্য সংসার কখনও অনিত্য, কখনও অলীক। সবই আপেক্ষিক। তবুও সৃজনশীলতার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে চলতে হবে।
কবির কথায় এই প্রবন্ধ শেষ করি:
'খুলে দাও দ্বার, নীলাকাশ করো অবারিত,
কৌতুহলী পুস্পগন্ধ কক্ষে মোর করুক প্রবেশ।'
--- সমাপ্ত---
অনন্তকুমার করণ
বাদল বোস সরণী, বকুলতলা, হাওড়া -৭১১১০৯

Comments
Post a Comment