বিমাতা
সমীর কুমার দত্ত
ইমপোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসাদার রামেন্দ্রসুন্দর চতুর্বেদীর স্ত্রী সুপর্ণা চতুর্বেদী পরলোক গমন করেন যখন তাঁদের একমাত্র পুত্র শ্রীমান রণজয় চতুর্বেদী বারো বছরের। নিজের সময়াভাবে তিনি অসুস্থ স্ত্রীর দিকে নজর দিতে পারেননি। এখন তাঁর স্ত্রীর অবর্তমানে পুত্রকে দেখবেন কীভাবে। সেহেতু পুত্রকে দেখাশোনা করার জন্য একজন মহিলা খুঁজছিলেন পুনর্বিবাহ করার জন্য। কোন অবস্থাপন্ন বড় ঘরের মহিলা সন্তান সহ কোন দোজবরকে বিয়ে করতে চাইবে না জেনে একজন গরীব ঘরের মেয়ে পূর্ণিমা ব্যানার্জিকে এই শর্তে র্বিবাহ করতে রাজি হয়েছেন যে যতদিন না রণজয় ওরফে রণ সাবালোক হচ্ছে ততোদিন সন্তানাদির কথা মুখে আনতে পারবে না । দরিদ্রঘরের মেয়ে হওয়ার দরুণ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করা পূর্ণিমা বিয়ের পর সচ্ছল পরিবারের মধ্যে এসে সম্পত্তির লোভ সামলাতে না পেরে রণকে মানুষ করার পরিবর্তে একটা অমানুষ তৈরি করার এবং সর্বোপরি জীবন থেকে সরিয়ে দেবার মনোভাব নিয়ে চলতে শুরু করলো। উদ্দেশ্য তার ভবিষ্যৎ গর্ভজাত সন্তানের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করা।
রণজয় ধীরে ধীরে সৎ মায়ের মমতা ও তত্ত্বাবধানে মানুষ হওয়ার পরিবর্তে কুপথে চালিত হতে লাগলো। তবে পড়াশোনাটা ঠিক ভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য রামেন্দ্রসুন্দর ভাবেন পূর্ণিমা তাঁর সন্তানকে ঠিক ভাবেই মানুষ করছে। ছেলেটা তার মায়ের মমতা ও অবিভাবকের সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়ে দিনের পর দিন অমানুষ হয়ে উঠতে লাগলো। আর পূর্ণিমা তার বাবার কাছে সবকিছু গোপন করে যেতে লাগলো। রণজয় যথাক্রমে দশ, বারো ক্লাস পাশ করে কলেজে ঢুকলো। বি.কম. এ ঢুকলো উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে বাবার ব্যবসার হাল ধরা। কিন্তু কলেজে গিয়েই ও মেয়েদের পাল্লায় পড়ে গেলো। কলেজে বড়লোকের ঘর থেকে আসা কুলাঙ্গার মেয়েদের সঙ্গে লীলা করে বেড়াতে শুরু করলো। ক্লাস না করে হোটেল, সিনেমা ইত্যাদি করে বেড়াতে লাগলো। জীবনকে তৈরি করার সময়েই মেয়েদের দেহসঙ্গ, হৈ-হুল্লড় ও মদ গেলা ইত্যাদি করে করে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে অমানুষ হয়ে উঠতে লাগলো। যে পথে চলেছে ছেলে পূর্ণিমা এটাই চাইছিল। তাই স্বামীর নজরে আনেনি। বড়ো লোকের ছেলে উচ্ছন্নে যাক্। মদে চুর হয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরে। টলতে টলতে উপরে উঠে ঘরে ঢুকে বিছানায় পড়ে পড়ে।রামেন্দ্রসুন্দর এর কিছুই জানতেন না।
রণজয় কলেজে ঢোকার সময় পূর্ণিমা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। কারণ যে সময় রণজয়কে দেখাশোনা করার সে সময়টা পার হয়ে গেছে। তাই পূর্ণিমা তার নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। রণ যে দিনের পর দিন এভাবে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে, ব্যাগে মেয়েদের ছবি নিয়ে ঘোরে, সারা রাত মেয়েদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে আর বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। পড়াশোনা তো করেই না। কেরিয়ারটা ডুম হয়ে গেলো বলে। পূর্ণিমা রামেন্দ্রসুন্দরের কাছে বেমালুম চেপে যায়। মনে মনে ভাবে ওকে আর একটু বাড়তে দেওয়া উচিত। ও বরবাদ হয়ে গেলেই তো ওর ভবিষ্যৎ সন্তান বা সন্ততি যাই হোক না কেন তাকেই ধরতে হবে স্বামীর ব্যবসার হাল। পূর্ণিমা বহুবার ভেবেছে ওর ভবিষ্যৎ সন্তান -সন্ততির পথ পরিষ্কার করতে রণকে জীবন থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু পারেনি। কারণ, সমস্ত দোষ ওর ঘাড়ে এসে পড়বে। কিন্তু এখন ও বড়ো হয়ে গেছে। জাহান্নামে যাওয়ার পথ ও নিজেই তৈরি করে নিচ্ছে। এই সুযোগেই মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিলে অথবা মাতাল তৈরি করে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরিয়ে দিলে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে থাকবে।ব্যাস পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে শেষোক্ত পদ্ধতিটি নিরাপদ। তাতে মৃত্যু না হলেও অঙ্গহানি অসম্ভব নয়। কিন্তু মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিলে তাতে ঝুঁকি আছে। পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।
একদিন রামেন্দ্রসুন্দরের শরীর খারাপ হলে অফিসে যাননি। ঘরেই ছিলেন। পূর্ণিমা ভাবলো—আজই বাপের কাছে ধরা পড়ে যাবে ছেলের কীর্তি । এতো তাড়াতাড়ি না পড়লে ভালো হতো। রাত হতে চললো রণ তখনো বাড়ি ফেরেনি। রামেন্দ্র পূর্ণিমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "রণ এখনও বাড়ি ফেরেনি ? নটা বাজতে চললো।"
ঠিক তখন হর্ণের আওয়াজ শোনাগেলো।
পূর্ণিমা বললো, "ঐ বোধহয় এলো।"
— ও রোজই কি এই সময় বাড়ি ফেরে?
—প্রায় দিনই তো এ সময় ফেরে।
—ডে কলেজে আটটা,নটা হবে কেন?
—সেটা ওকে জিজ্ঞাসা করবেন।
—উত্তরটা বেপরোয়া হয়ে গেলো না কি? তুমি তো মা। নিজের মা না হলেও সৎ মা তো বটে। তোমর তো অধিকার ও কর্তব্য দুটোই থাকার কথা।
—দায়িত্ব যখন ছিলো তখন পালন করেছি। এখন বড়ো হয়ে গেছে। আর আমি কলেজের পড়ার ও কখন কী ক্লাশ থাকে কি বুঝি? বোকার মতো এ সব জিজ্ঞাসা করে গাল বাড়িয়ে চড় খাই আর কি। সারা জীবন পরের ছেলের দায়িত্ব বহন করে যাবো, তা কি করে হয়। আমার নিজের ছেলেও তো আসতে চলেছে পৃথিবীতে। তার প্রতি কোন কর্তব্য নেই। এখন তো রণ বাচ্চাটি নেই যে ওকে দেখতে হবে।
রণ টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। রামেন্দ্র শরীর খারাপকে উপেক্ষা করে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজাসুজি বাবার মুখের সামনে। রণ ভূত দেখার মতো চেয়ে রইলো।
রামেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলো, "এতো রাত হলো যে?"
নেশাগ্রস্ত গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে রণ উত্তর দিলো, "রাত কোথায় বাবা? সবে তো নটা।
—তুমি মদ খেয়েছো ! কলেজে কি মদ খেতে যাও? তোমর কি রোজই নটা পর্যন্ত ক্লাস হয়?
আর তুমি মদ খেয়ে বাড়ি ফেরো!
— রোজ ক্লাস থাকে না। এক এক দিন থাকে। মনে অনেক কষ্ট। তাই একটু আধটু খেয়ে ভুলে থাকতে চাই।
—এ সব তোমার মা জানে?
—মা! কোথায় মা? মা তো কবে স্বর্গে চলে গেছে আমাকে একা করে দিয়ে। তুমি একজনকে ধরে এনে বলবে আমার মা, তা হতে পারে না। শোনো বাবা শুধু টাকা জুগিয়ে গেলে আর মায়ের পরিবর্তে আর একজন মা এনে দিলেই সব হয় না বাবা। তোমার নিজের কি কোন দায়িত্ব নেই?
শুধু পয়সা ছাড়া তুমি বাবার দায়িত্ব পালন করো নি। আমার খারাপটা শুধু দেখার দায়িত্ব তোমার আর আমার ভালোটা দেখার দায়িত্ব তোমার নেই?
—চুপ করো । আমাকে সারাদিন পয়সা রোজগারের ধান্দায় থাকতে হয়। আমার আর সময় কোথায়?
—বা বা, পৃথিবীর আর বাবারাও পয়সা রোজগার করে আবার সংসারকেও দেখে । ছোট বেলায় স্কুলে গার্জেন মিটিং থাকে। বেশির ভাগ বাবাই যায়। তুমি কোনদিন গেছো? আর বাবারা কি পয়সা রোজগার করে না? গার্জেন মিটিং বছরে একবার কি দুবার হয়।
রামেন্দ্র চূপ করে থাকে আর ভাবে ছেলের এই অবস্থা তো একদিনে হয়নি। পূর্ণিমা সব জানে কিন্তু আমার কাছে আড়াল করে গেছে। কী চায় ও? ও কি চায় ছেলেটা বরবাদ হয়ে যাক্। আর ওর আগত সন্তান- সন্ততি এই সম্পত্তি ভোগ করুক। না না আমি হা ঘরের মেয়ে এনে ভুল করেছি। তেল জলে কি মেশে! মেশে না।
তারপর রামেন্দ্র নিজের ঘরে ঢুকে স্বর্গগতা স্ত্রী সুপর্ণার ছবির কাছে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে,
"সুপর্ণা, তুমি যে ছেলের দায়িত্ব আমায় দিয়ে গেছো, আমার ভুলে বরবাদ হয়ে যেতে বসেছে। যাকে ভালো ভেবে নিয়ে এলাম ওকে দেখার জন্য, সে ওকে ঠিকমতো দেখলো না আমার সময়াভাবের সুযোগ নিয়ে। আমার বিয়ে করার কি দরকার ছিলো। আমি তো রণকে দেখার জন্যই করেছি। রণ এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমাকে ভয় তো করেই না, উপরন্তু , যা নয় তাই শুনিয়ে দিলো। তুমি তো জানো ব্যবসার জন্য আমার সময়াভাব। তুমি থাকলে আমায় চিন্তা করতে হতো না। আমি আমার অবহেলায় তোমাকে হারিয়েছি আর তোমার সন্তানকেও হারাতে চলেছি। তোমায় হারিয়েছি অর্থের অভাবে নয়, সময়াভাবে। ভিতরে ভিতরে তোমার দুটো কিডনিই যে নষ্ট হতে চলেছে, তুমি কষ্ট পেয়েছো,কিন্তু আমায় জানাও নি আমার সময়াভাবের জন্য। আজ সেই সময়াভাবেই তোমার ছেলেকেও হারাতে বসেছি। সিচোয়েশন আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। আমার যদি কিছু হয় এ ব্যবস্থা সামলাবে কে?"
কলেজে যেসব বড়ো লোকের বদ মেয়েদের সঙ্গে রণজয়ের খুব ভাব ছিলো, সেগুলো বাদে ওরই ক্লাসে একটি মেয়ে ছিলো দেখতে সুন্দরী, শান্তশিষ্ট ও মেধাবী। নাম তার শ্রীময়ী। রণজয় যাদের সঙ্গে নষ্টামি করে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে ভাবে —এরা কেউ স্ত্রী হবার মতো যোগ্যের নয়। এদের সঙ্গে লীলা করা যায় কিন্তু এদের কে বাড়ির বধূ করা যায় না। পক্ষান্তরে শ্রীময়ী রূপে-গুণে অনন্যা। শ্রীময়ীকে বিবাহ করে ঘরে নিয়ে গেলে বাবা হয়তো মেনে নেবেন। তাই একদিন শ্রীময়ীকে কলেজে একা পেয়ে মনের কথাটা স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করে। বলে,
"শ্রীময়ী একটু দাঁড়াবেন ? আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।"
শ্রীময়ী একটু বিস্মিত হয়ে ভাবলো —হঠাৎ আজ ডেকে কথা বলছে। কী বলতে চায়! আজ বুঝি ওরা আসেনি তাই ।আজ আমাকে পেয়েছে যেচে ভাব করতে চাইছে। রণজয় হ্যান্ডসাম, সুপুরুষ। এমনিতেই কোন মেয়ের মন কেড়ে নেবার যোগ্যতা ওর আছে। তার ওপর বড়লোকের ছেলে। কিছুটা প্রায়োরিটি তো পেতেই পারে। তাই ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে নি।
" চলুন না ক্যান্টিনে গিয়ে বসা যাক্।" রণজয় বললো। এড়িয়ে যেতে না পেরে শ্রীময়ী রণকে অনুসরণ করলো।
"চা খাবেন? চা খেতে খেতে কথা হবে।" রণ বললো।
ইচ্ছে না থাকলেও এড়াতে পারলো না। স্মার্ট মেয়ে শ্রীময়ী কেমন যেন নার্ভাস ফিল করলো। মুখ ফসকে বলে ফেললো, " কী বলবেন বলুন।"
রণজয় শুরু করে, "আমার ওদের সঙ্গ ভালো লাগে না। ওরা হলো বড়োলোকের উড়নচণ্ডী মেয়ে। কী করবো। বাড়িতে ভালো লাগে না,তাই ওদের সঙ্গে একটু উড়ে বেড়াই। আমি একজন ভালো মেয়ে খুঁজছি তাকে জীবনসঙ্গিনী করতে চাই, যে আমার এবং আমাদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে। আসলে আমাদের ইমপোর্ট এক্সপোর্টের একটা ব্যবসা আছে। বাবা থাকতে থাকতেই আমাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে। আমার তো মা নেই। দশ -বারো বছর বয়সেই মাকে হারিয়েছি। বাবা একদমই সংসারে সময় দিতে পারেন না। গরীব ঘরের এক মহিলাকে বিবাহ করে এনেছেন আমাকে দেখার জন্য। তার মতলবটা হলো, তার ছেলেমেয়ে হলে যেন সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়। সেইজন্য তিনি আমার খারাপ চান। যাতে আমি মদ খেয়ে ওইসব মহিলাদের সঙ্গে নষ্টামি করে শেষ হয়ে যাই। আমাকেও হয়তো বিষ দিয়ে মেরেও ফেলতে পারে। সেইজন্য আমাকে,আমার বাবাকে বাঁচাবার জন্য একজন ভালো মহিলা চাই । আমি আপনাকে ওদের মধ্যে ফেলি না। ওরা আমাকে দিয়ে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নোংরা কাজ করিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করবে। আমি ওদেরকে আর সঙ্গ দেবো না। মা চলে যাবার পর আমাকে ভালোবাসার আর কেউ নেই। আমি ভালোভাবে বাঁচতে চাই। আমাদের তো অর্থের অভাব নেই। আছে ভালো মানুষের অভাব। আমার মা খুব ভালো ছিলেন। বেঁচে থাকলে চিন্তা করতুম না। মাকে হারিয়ে আমি আমার মাথার ওপর ছাদটা হারিয়েছি। আমি আপনাকে ভালবাসি। বিশ্বাস করুন। বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই। আমার যা বলার আমি বললাম। এবার সিদ্ধান্ত আপনার। না হলে কী করবো! আমার অদৃষ্ট বলে মেনে নেবো!
শ্রীময়ী বড়োলোকের মেয়ে না হলেও উচ্চ মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। কমার্স নিয়ে পড়ছে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেডেন্ট হবে বলে। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। বাবা বিশ্বজিৎ চৌধুরী এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। বাবা মায়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক শ্রীময়ীর। সেদিন রাতে রণজয়ের কথাগুলো ভেবে দেখলো—না, রণজয়ের কথাগুলো ফেলে দেবার নয়। আবার সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব! যদি ওর মতলব খারাপই হতো তাহলে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিতো না। সত্যিই ও যা বললো ওর পরিবারের কথা,তাতে ওর পাশে না দাঁড়ালে খারাপ দেখায়। শ্রীময়ী সরাসরি মা -বাবাকে খুলে সব কথা বললো। মা শুনে বললেন, " আহা রে! সত্যিই, ছেলেটা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও সুখী নয়! বিপথে চলে যাচ্ছে। সামনে ওর বড়ো বিপদ । বাবা বললেন, "তোর কি মনে হয়,ও যা বলছে সব সত্যি বলছে?"
—আমার তো মনে হয় বাবা, ও যা বলছে ঠিক বলছে। না হলে মনে করো ওর দুরভিসন্ধি থাকলে, ও বাড়ির এই চিত্রটা আমার কাছে তুলে ধরবে কেন? আমার সঙ্গে যদি ওর খেলার ইচ্ছে থাকে তাহলে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেবে কেন? ও একটা কিছু অবলম্বন খুঁজতে চাইছে। আপাতভাবে সকলের মনে হবে বড়লোকের লম্পট ছেলে। ভেতরের খবর কে আর রাখে।
—তোর যদি মনে হয় তুই ওকে সঠিক পথে ফিরিয়ে এনে ওর যা সমস্যা তা সমাধান করতে পারবি, আমি তাহলে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারি। তবে তোদের কথা শুনে আগবাড়িয়ে কথা বলতে গেলে যদি অপমান করে? এখনো তো পড়াশোনা করছে। এখন যদি ওর বিয়ে না দেয়? যদি না বলে দেয়?
শ্রীময়ীর মা রমা চৌধুরী বললেন, " তুমি মেয়ের বাবা। বললেই বা। গায়ে না মাখলেই হলো। মেয়ের বাবাই তো এগিয়ে যায়। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালো, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। ও তো পৈতৃক ব্যবসায় বসবে। ওকে তো চাকরি খুঁজতে হবে না। তবে আর অসুবিধেটা কোথায়?
— তোর মা আসলে সুন্দর জামাই হবে, বড়োলোক জামাই হবে ভেবে আর হাত ছাড়া করতে চাইছে না। সে ঠিক আছে। যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—যদি ভাবে, ওদের পয়সা আছে বলে ওদের পরিবারে মেয়েকে গচাতে চাই।
শ্রীময়ী বলে," তুমি তোমার পরিচয় দেবে।আর বলবে আপনার ছেলে নিজেই আমার মেয়েকে ডেকে বলেছে বদ সঙ্গ ত্যাগ করে আমার মেয়েকে বাড়ির বৌ করতে চেয়েছে। বিশ্বাস না হয়,আপনার ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন। আপনার ইচ্ছে না থাকলে এ বিয়ে হবে না। তবে আমার বিশ্বাস যেভাবে চলেছে আপনার ছেলে, আমার মেয়েই পারবে ওকে বদ সঙ্গ থেকে বের করে আনতে।"
গর্ভাবস্থায় পূর্ণিমা একদিন স্বপ্নে সুপর্ণাকে দেখলো। লাল পাড় সিল্কের শাড়িতে ঘোমটা মাথায় সুপর্ণা এসে দাঁড়িয়েছে। পূর্ণিমাকে তীব্র ভৎসনা করে যেন বলছে," পূর্ণিমা রণজয়কে দেখাশোনার জন্য উনি তোকে বিবাহ করে ঘরে নিয়ে এলেন। উনি মাতৃহারা রণজয়কে একজন মা দিতে চেয়েছিলেন, কোন কাজের লোক হিসাবে নয়। উনি তো পুনর্বিবাহ না করে একজন কাজের লোককে আনতে পারতেন। তাহলে তোকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন কেন? আর তুই কিনা রণকে মারার তোড়জোড় করছিস্। ছিঃ ছিঃ! তোর এতো লোভ! আমি তো জানি গরীবের মন ভালো হয়। তুই মা নামের কলঙ্ক। এবং গরীবেরও কলঙ্ক! তুই যা করতে চাইছিস্,তা কোনদিনো সম্ভব হবে না। তুই মা হওয়ার অযোগ্য। তোকে ধিক্। তুই একটা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ।"—এই বলে সুপর্ণার ছায়ামূর্ত মিলিয়ে গেলো। পূর্ণিমার ঘুমটা ভেঙে গেলো। ও খুব ভয় পেয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো ও দিদির অর্থাৎ সুপর্ণার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। বলা যায় না অভিশাপ লেগে যেতে পারে। তার নিজের আগত সন্তান -সন্ততির ক্ষতি হতে পারে। তারপর থেকে সে রণজয়ের ক্ষতির করার চিন্তা থেকে বিরত থাকে।
শ্রীময়ীর বাবা বিশ্বজিৎ রণজয়ের বাবা রামেন্দ্রসুন্দরের সঙ্গে দেখা করে কথাটা পাড়লেন। কথাটা শুনে রামেন্দ্রসুন্দর বললেন,"আপনি বলছেন রণজয়ের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে দিতে চান। আমার তাতে আপত্তি নেই কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী আমার ছেলে বিপথে চালিত। সুতরাং তার সঙ্গে একটা ভালো মেয়ের জীবন জুড়ে দেওয়া কোন শুভোবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ করে না। ও যদি নিজেকে শোধরায় তাহলে ঠিক আছে। আমার কোনো আপত্তি নেই।"
শ্রীময়ীর বাবার খুব ভালো লাগলো রামেন্দ্রসুন্দরের কথা শুনে। একজন প্রকৃত ভদ্রলোক বলে মনে হলো। তাই বললেন,
"এসবই আমি শুনেছি। আপনার ছেলে কথা দিয়েছে যে সে নিজেকে শুধরে নেবে যদি শ্রীময়ী ওকে বিয়ে করতে রাজি থাকে। আমার মেয়ে বলেছে, যে পথে ও গেছে সে পথ থেকে ওকে ফেরাতে সমর্থ হবে। তাই বলছিলাম যদি আপনি মত দেন তাহলে আমরা এগোতে পারি।"
পাত্রীর পিতার মুখথেকে সব শুনে রামেন্দ্রসুন্দর বললেন,
"বেশ, যদি আপনাদের মেয়ে পারে তো আমার কোন আপত্তি নেই।"
—আপনি যদি একবার গিয়ে আমার মেয়েটা দেখে আসেন তো ভালো হয়।
—আমার ছেলে যখন পছন্দ করেছে তখন আমি আর দেখে কী করবো। তবু বলছেন যখন যাওয়া যেতে পারে,কিন্তু তার আগে আমাকে আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আপনার মেয়েকে বলবেন যাতে ও ভালোভাবে পাশ করতে পারে। তারপর পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে হবে।
মত বিনিময় করে শ্রীময়ীর বাবা বাড়ি ফিরে এলেন। মেয়েকে ও স্ত্রীকে সবকথা বললেন। শ্রীময়ী ফোনে রণজয়কে সব কথা জানালো। আর বললো, " আজ থেকে আর মদ ধরবেন না। মন দিয়ে পরীক্ষার প্রিপারেশন করবেন। রেজাল্ট আউট হলে তবে বিয়ের কথা ভাববো। আর একটা কথা,কলেজে দেখা হলে না চেনার ভান করতে হবে। আমি চাই না কথাটা পাঁচ কান হোক। আর ওদেরকে অ্যাভয়েড করে চলতে হবে। কথাগুলো যদি লঙ্ঘিত হয় তাহলে আমাকে ভাবতে হবে আমি বিয়ে করবো কিনা।"
—প্রথমে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ রাজি হওয়ার জন্য। আপনি যা যা বললেন তার অবশ্যই মান্যতা দেওয়া হবে। তবে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার থেকেও কঠোর। পালন করতেই হবে।উপায় নেই। আমি আগেই বলেছিলাম আপনাকে যে আপনি ওদের থেকে কতো আলাদা! স্বর্গ থেকে আমার মা
আপনাকে আশীর্বাদ করবেন। গুড নাইট।
পরের দিন থেকে রামেন্দ্রসুন্দর কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন ছেলের মধ্যে। কলেজে গিয়ে ওই অসভ্য মেয়েদের সঙ্গে আর যোগ না দিয়ে ভালো ছেলের মতো ক্লাশ করে সময়ে বাড়ি ফিরে আসতে লাগলো। ঘরে ফিরে পড়ায় মনোনিবেশ করতে শুরু করলো। পরিবর্তন দেখে রামেন্দ্রসুন্দর আশার আলো দেখতে পেলেন। ভাবলেন সত্যিই মেয়েটার মধ্যে গুণ আছে। ওই পারবে রণজয়কে বদলাতে। স্বর্গগতা স্ত্রীর ছবির সামনে গিয়ে বলতে লাগলেন,"সুপর্ণা, ঘরের লক্ষ্মী করে আনবো তাকে যে তোমার ছেলেকে বদলাতে পারবে। আমি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। তুমি শুধু ওদের দুজনকে আশীর্বাদ করো।"
যথা সময়ে উভয়ের পরীক্ষা পর্ব চুকে গেলো। ওরা চার্টার্ডে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। ইতিমধ্যে উভয় পক্ষ থেকে বিবাহের কথাবার্তা শুরু হয়েছে মাত্র। এমনসময় পূর্ণিমার ডেলিভারির অনেক আগেই লেবার পেন শুরু হয়ে গেলো। এমনটি হবার কথা নয়। ডাক্তার পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে পূর্ণিমার গর্ভজাত সন্তান ইতিমধ্যেই মারা গেছে। আর দেরি না করে অপারেশন করে মৃত সন্তান প্রসব করালো। শুধু মৃত নয়, গর্ভস্থ সন্তান বিকলাঙ্গ। বাঁচার অনুপযুক্ত। শুধু তাই নয় ওভারিতে কিছু ত্রুটি থাকায় ওভারি অপারেশন করতে হলো। যার অর্থ পূর্ণিমা ভবিষ্যতে আর মা হতে পারবে না।পূর্ণিমা কান্নায় ভেঙে পড়লো। অপরের ক্ষতি করতে চাওয়া পৃর্ণিমা মৃত বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দিলো। শুধু তাই নয় ভবিষ্যতে ও আর মা হতে পারবে না। যে সন্তানের জন্য সে অন্য এক সন্তানের ক্ষতির কথা ভাবে ভগবান তার মনস্কামনা পূর্ণ তো করেন না,বরং শাস্তি দেন। মাতার পূর্ব জন্মের কৃত অথবা এই জন্মের কৃত পাপের জন্য গর্ভ অশুদ্ধ হতে পারে। অথবা একই কারণে পিতার শুক্র অশুদ্ধ হতে পারে যার অবশ্যম্ভাবী ফল সন্তানের বিকলাঙ্গতা। তবে এক্ষেত্রে পিতার দিক থেকে কোন প্রকার অশুদ্ধতা নেই। না হলে রণজয়ের মতো সুস্থ সবল ছেলে জন্মাবে কেন। আবার সন্তানের নিজের পূর্বজন্মার্জিত পাপের শাস্তি হিসাবেও বিকলাঙ্গতা আসতে পারে।
বিকলাঙ্গ ও মৃত সন্তান প্রসূত হওয়ায় পূর্ণিমা উপলব্ধি করতে পারলো অনেকটা ঠকে শেখার মতো। রামেন্দ্রসুন্দর তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেন,
"জঙ্গলে হিংস্র বাঘিনীকে অনেক সময় দেখা যায় অন্য কোন প্রাণীর শাবককে রক্ষা করতে। মাতৃত্ব এমন এক জিনিষ যা জংলী জানোয়ারকেও অনেক সময় মহৎ করে তোলে। সে বুক দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করে, যদিও তা ব্যর্থ চেষ্টা। কারণ, অন্যেরা সেই শাবককে ছেড়ে দেবে না। তুমি মানুষ হয়ে এটুকু করার পরিবর্তে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে লাগলে। কি হলো? নিজেরটাকে কি ধরে রাখতে পারলে? পূর্ণিমা ঠকে শিখে কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বীকার করলো,"স্বপ্নে আমায় দিদি দেখা দিয়ে আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমি দিদির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেবো যে রণজয় যেমন তাঁর সন্তান তেমনি আমারও। আমার আর সন্তানের দরকার নেই।এখন থেকে রণ আমারও সন্তান। আমি আমৃত্যু ওর পিছনে ঢাল হয়ে থাকবো দিদির অনুপস্থিতিতে। আমি ওর কোন ক্ষতি হতে দেবো না।"
রামেন্দ্রসুন্দর যার পর নাই খুশি হয়ে সুপর্ণার ছবির কাছে গিয়ে বললো, "সুপর্ণা, তুমি হলে ঘরের লক্ষ্মী। তুমি ওই অবুজ মহিলাকে দেখা দিয়ে ওর চোখ খুলে দিয়েছো। আবার তোমার ছেলে রণকে রক্ষা করার জন্য শ্রীময়ীকে রণের জীবনে এনে হাজির করে দিয়েছো। গৃহের শান্তির জন্য যা যা করার তুমি তাই করছো। তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই।"
পূর্ণিমা সুপর্ণার ছবির কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো আর স্বামীর কাছে যেমনটি স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো, তাই সুপর্ণার কাছে দিয়ে তার আশীর্বাদ চেয়ে নিলো এ সংসারকে শান্তিতে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। পূর্ণিমার শোক ভুলতে প্রায় বছর খানেক লেগে গেলো। তারপর শ্রীময়ী ও রণজয়ের বিবাহের কথাবার্তা পাকা করে একটা দিন দেখে মহাধূমধাম করে বিবাহ পর্ব চুকে গেলো। পূর্ণিমা যথারীতি মায়ের করণীয় কার্য হাসিমুখে পালন করলো। কেবল মাঝে মধ্যে পুত্রশোক তাকে দুর্বল করে দেয়। কিন্তু রামেন্দ্রসুন্দর পূর্ণিমাকে যথার্থ স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আর শ্রীময়ী ও রণজয় তাকে যথার্থ মায়ের জায়গা দিয়ে তার প্রিয় হয়ে তাকে তার পুত্রশোক ভুলিয়ে দিতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে লাগলো।
=======================

Comments
Post a Comment