অবহেলা
সৈকত প্রসাদ রায়
পৌষ সংক্রান্তির হাড়হিম করা সকাল। কুয়াশার চাদর যেন আজ কিছুতেই সরতে চাইছে না। শহরের কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে, মস্ত বড় লোহার গেটওয়ালা বাড়িটা "শেষের ঠিকানা" বৃদ্ধাশ্রম আজ বড্ড নিস্তব্ধ। শীতের দাপটে আশ্রমের বাগানের গাঁদা ফুলগুলোও যেন নুইয়ে পড়েছে, ঠিক এখানকার মানুষগুলোর মতো।
দোতলার বারান্দার এক কোণে, পুরোনো কাঠের ইজিচেয়ারটায় বসে আছেন পঁচাত্তর বছর বয়সী অনিমেষ সান্যাল। গায়ে জড়িয়ে আছেন এক মলিন ছাইরঙা উলের চাদর। চাদরটার বুনন আলগা হয়ে গেছে, কয়েক জায়গায় রিফু করা। আশ্রমের কেয়ারটেকার গত সপ্তাহেই তাঁকে একটা নতুন দামী কম্বল দিয়ে গেছে, কিন্তু অনিমেষ বাবু সেটা ছুঁয়েও দেখেননি।
এই চাদরটা সাধারণ কোনো কাপড় নয়। আজ থেকে পনেরো বছর আগে জন্মদিনে তাঁর স্ত্রী সুধা নিজের হাতে বুনে দিয়েছিলেন। সুধা চলে গেছে দশ বছর হলো, কিন্তু এই চাদরের ভাঁজে ভাঁজে অনিমেষ বাবু আজও সুধার গায়ের গন্ধ পান। শীতে যখন শরীরটা কেঁপে ওঠে, তখন চাদরটা জড়িয়ে ধরলে মনে হয় সুধা যেন তাঁকে জাপটে ধরে বলছে, "ওগো, সাবধানে থেকো।"
অনিমেষ বাবুর দৃষ্টি গেটের দিকে স্থির। ঝাপসা চোখে তিনি পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর একমাত্র ছেলে অয়ন, মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার, থাকে ব্যাঙ্গালোরে। তিন বছর আগে অয়ন বলেছিল, "বাবা, চাকরিবাকরি নিয়ে আমি আর বৌমা খুব ব্যস্ত থাকি। ফ্ল্যাটে তুমি একা পড়ে থাকো, তার চেয়ে বরং ভালো একটা হোমে থাকো। ওখানে তোমার মতো অনেক বন্ধু পাবে, ডাক্তার থাকবে ২৪ ঘণ্টা। আমরা তো আছিই, মাসে মাসে টাকা পাঠাব, ছুটিতে এসে নিয়ে যাব।"
সেই 'ছুটি' গত তিন বছরে একবারও আসেনি। প্রতি শীতে অয়ন দামী জ্যাকেট, সুগার-ফ্রি বিস্কুট আর ফলের ঝুড়ি কুরিয়ার করে পাঠায়। কিন্তু অনিমেষ বাবু ফলের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবেন ছেলেটা যদি একবার আসতো! শুধু একবার এসে যদি বলত, "বাবা, চলো বাড়ি যাব"—তাহলে হয়তো বুকের ভেতরের এই পাথরচাপা কষ্টটা কমত।
হঠাৎ গেটের বাইরে একটা বাসের হর্ন শোনা গেল। স্থানীয় 'শিমুলতলা হাইস্কুল'-এর ছাত্রছাত্রীরা এসেছে বাৎসরিক সমাজসেবা কর্মসূচিতে। মুহূর্তের মধ্যে আশ্রমের মরা প্রাঙ্গণটা যেন কচিকাচাদের হাসিতে নেচে উঠল। কেউ গান গাইছে, কেউ দাদু-দিদিমাদের ফল কেটে দিচ্ছে।
ভিড়ের মধ্যে একটা বছর বারোর ছেলে, নাম তার ঋক, দলছুট হয়ে দোতলার বারান্দায় উঠে এল। সে দেখল, সবার মাঝে থেকেও একজন বৃদ্ধ মানুষ কেমন যেন একা হয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে, অথচ ঠোঁটে অদ্ভুত এক নীরবতা।
ঋক ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে ডাকল, "দাদু?"
অনিমেষ বাবু চমকে উঠলেন। চশমাটা ঠিক করে তাকালেন। ছেলেটার চেহারায় কী মায়া! অবিকল ছোটবেলার অয়নের মতো।
"কিছু বলবে দাদুভাই?"—অনিমেষ বাবুর গলাটা কাঁপল।
ঋক জিজ্ঞেস করল, "নিচে সবাই গান গাইছে, আনন্দ করছে, তুমি যাবে না? আর তোমার এই চাদরটা তো অনেক পুরনো, এতে কি শীত মানছে? আমার কাছে একটা এক্সট্রা নতুন সোয়েটার আছে, দেব?"
অনিমেষ বাবু ম্লান হাসলেন। হাত বাড়িয়ে ঋকের নরম হাতটা ধরলেন। বললেন, "না দাদুভাই, সোয়েটার লাগবে না। এই পুরনো চাদরটাই আমার কাছে রাজপোশাক। জানো, এটা আমার গিন্নি বানিয়েছিল। আজ সে নেই, ছেলেটাও অনেক দূরে। এই শীতে বাইরের ঠান্ডার চেয়ে বুকের ভেতরের ঠান্ডাটা যে অনেক বেশি কষ্ট দেয় দাদুভাই। ওটা কোনো নতুন সোয়েটারে যায় না।"
ঋক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে দেখল, বৃদ্ধ মানুষটির গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা জল চাদরের ওপর পড়ল। অনিমেষ বাবু বলে চললেন, "আমার ছেলে অয়নকে আমি সাইকেলের সামনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতাম। শীতে আমার গায়ের কোটটা খুলে ওকে জড়িয়ে দিতাম, যাতে ওর ঠান্ডা না লাগে। আজ সেই ছেলেটা বড় সাহেব হয়েছে, তার আর আমার পুরনো গায়ের গন্ধ সহ্য হয় না। ফ্ল্যাটের ডেকোরেশন নষ্ট হবে বলে আমাকে এখানে রেখে গেছে।"
কথাগুলো ঋকের বুকে তীরের মতো বিঁধল। তার মনে পড়ে গেল নিজের বাড়ির কথা। তার বাবাও তো তার দাদুর সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। দাদু যখন কাশি দেয়, বাবা বিরক্ত হয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। ঋক নিজেও তো ভিডিও গেমের নেশায় দাদুর পাশে বসে না কতদিন!
ঋক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে অনিমেষ বাবুর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। নিজের ব্যাগ থেকে টিফিনের হটপটটা বের করে বলল, "দাদু, আমার মা আজ পায়েস রেঁধে দিয়েছে। আমি খাইনি, তুমি খাবে? আমার হাতে খাবে?"
অনিমেষ বাবু যেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না। কতদিন কেউ তাঁকে 'বাবা' বলে ডাকে নি, আদর করে খাইয়ে দেয়নি। তিনি কাঁপাকাঁপা হাতে ঋকের মাথায় হাত রাখলেন। ঋক যখন চামচ করে পায়েসটা তাঁর মুখে তুলে দিল, তখন অনিমেষ বাবুর মনে হলো—ঈশ্বর কি তবে তাঁর ছেলেকে পাঠালেন এই ছোট্ট শিশুটির রূপে?
সূর্য তখন পাটে নামছে। যাওয়ার সময় ঋক অনিমেষ বাবুর হাত ধরে কথা দিল, "দাদু, আমি আবার আসব। আর তোমাকে একা থাকতে হবে না।"
বাস ছেড়ে দিল। অনিমেষ বাবু বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ বাসটা দেখা যায়। কিন্তু আজ আর তাঁর চোখে জল নেই, আছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। একমুঠো রোদ যেন তাঁর জমে যাওয়া হৃদয়ে প্রবেশ করেছে।
সেদিন বাড়ি ফিরে ঋক সোজা তার দাদুর ঘরে গেল। দাদু তখন একা ঘরে শুয়ে রেডিও শুনছিলেন। ঋক গিয়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "দাদু, আমাকে একটা গল্প শোনাবে? আজ আমি সারারাত তোমার কাছে থাকব।" দাদু আনন্দে উঠে বসে ঋককে জড়িয়ে ধরলেন, দাদুর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল ঋকের মাথায় পড়ল। ঋকের বাবা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলেন। ছেলের এই পরিবর্তন তাঁকে স্তব্ধ করে দিল। তিনি বুঝলেন, দামী উপহার নয়, বাবা-মায়েরা শুধু সন্তানের একটু সান্নিধ্যের কাঙাল হন।
শীতের রুক্ষতা যেমন বসন্তের আগমনে মুছে যায়, তেমনি বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা মুছে যেতে পারে শুধু পরিবারের একটু ভালোবাসা আর যত্নে।
--- --- --- --- ---

Comments
Post a Comment