হেমচন্দ্রের প্রতি মৃণালিনী
মহাব্বাতুন্নেসা বিশ্বাস
যে গোধূলিলগ্নে তুমি গমন করিলে, হেমচন্দ্র,
সে লগ্ন আমার প্রাণপটে যেন অমোচন অগ্নিলিপি।
সময় সেই মুহূর্ত হইতে থমকি দাঁড়াইয়া আছে—
যেন যুগের পর যুগ সে সন্ধ্যার রক্তিম আভা
আমার জীবনকে অভিশাপরূপে ঘিরিয়া আছে।
তোমার গমনমুহূর্তে বায়ু ছিল অদ্ভুত স্থির,
বিহগেরা নির্মম নীরবতায় সঙ্কুচিত হইয়া
চেয়ে ছিল অদৃশ্য কোন পরিণতির দিকে।
দিগন্ত যেন আমার অপরাধের ভবিষ্যৎ জানিয়া
মৃদু কম্পনে কম্পমান হইয়াছিল।
হায় হেমচন্দ্র,
তোমার চরণের ক্ষীণ ধ্বনি
যবে সিঁড়ির শেষ ধাপে মিলাইয়া গেল—
আমি বুঝিলাম, আমার ভিতরে এক অমানুষী অন্ধকার
ধীরে ধীরে উত্থিত হইতেছে।
সেই অন্ধকারই আমাকে বলিল—
"আলো নিভাইয়া দাও, স্বর রুদ্ধ করিয়া দাও,
প্রাণের আর্তি শোনো না!"
আর তাহারই প্ররোচনায়
আমি তোমার শ্বাসকে রুদ্ধ করিলাম
আমার দুই করতলে।
তোমার দৃষ্টি, সেই শেষ জ্যোতিহীন দৃষ্টি,
আজিও যেন আমার ঘুমহীন রাত্রির ভাঁজে ভাঁজে
ঠায় দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করে—
"কেন?"
হেমচন্দ্র,
আমি সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নাই,
পারিব বলিয়াও মনে হয় না।
যে অপরাধের শক্তি আমাকে
মানবরূপ হইতে নিষ্ঠুর পশুরূপে রূপান্তরিত করিল,
তার কারণ আজও অন্ধকারে ঢাকা রহিয়াছে।
আমার দুই হস্তে আজিও বহমান
তোমার শেষ আর্তির প্রেতাত্মা।
হস্তদ্বয়ে স্পর্শ করিলেই অনুভব করি
সেই উত্তপ্ত, সেই অনন্ত দগ্ধ স্মৃতি—
যেন তোমার প্রাণস্পন্দন এখনো ধড়ফড় করি
মুক্তির পথ খোঁজে।
রজনীপ্রহরে,
যখন সমগ্র বিশ্ব নিস্তব্ধ নিদ্রায় নিমগ্ন,
আমি শুনিতে পাই তোমার নরম কণ্ঠস্বর—
যেন দূর আকাশে ভেসে আসা
ক্লান্ত, ব্যথাভরা শ্বাস।
পরম আশ্চর্য,
আমি মাঝে মাঝে অনুভব করি
আমার বক্ষে ঠান্ডা বাতাসের মতো
তোমার অদৃশ্য হাতের স্পর্শ।
হায়, সে স্পর্শ মমতার নহে,
সে অভিশাপের স্মরণ,
সে অনন্ত প্রতিশোধের ছায়া!
অতএব, হেমচন্দ্র,
আমি নিবেদন করি—
আমার এ দেহাত্মাকে তুমি দণ্ড দাও।
তোমার প্রেতরূপে আমার স্বপ্নে আসিয়া
আমাকে শৃঙ্খলিত করো,
আমার হৃদয়ে ধ্বংসের বজ্রাঘাত বর্ষাও,
আমার জীবনধারাকে দগ্ধ করিয়া
তোমার ক্রোধের অগ্নিতে সমর্পণ করো।
যদি দণ্ডই মুক্তির একমাত্র পথ হয়—
তবে সেই দণ্ডই প্রার্থনা করি।
কারণ, দণ্ড ছাড়া
আমার এ অপরাধের রাত্রি
কখনোই প্রভাত দেখিবে না।
হেমচন্দ্র!
তোমার সেই গোধূলিলগ্ন
আকাশের পশ্চিমপ্রান্তে আজিও স্থির,
অচল, ভয়ার্ত, জ্যোতিহীন।
প্রতিটি রাত্রি, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি অশ্রু
আমাকে সেই সন্ধ্যাকে পুনরায় স্মরণ করাইয়া
আবারও মৃত রাখে।
হেমচন্দ্র—
যদি তোমার কোনো ক্ষমা থাকে, দান করো।
যদি না থাকে,
তবে তোমার অভিশাপেই ডুবাইয়া দাও
আমার এই অপরাধমগ্ন অস্তিত্বকে।

Comments
Post a Comment