শিক্ষক ছাত্র সম্পর্কের সেকাল ও একাল
দীপক পাল
বর্তমান সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা অস্থিরতা ও অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত
পশ্চিমবঙ্গে অভূতপূর্ব দুর্নীতির ফল স্বরূপ শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা
লক্ষ্য করা যায়। এতে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা ভাটার টান চলছে। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। সেই মেরুদন্ডটাই এক শ্রেণি অসাধু প্রভাবশালির খপ্পরে পরে বেঁকে যেতে বসেছে।
প্রশাসন ও সরকার এই ব্যাপারে শাস্তির ব্যাবস্থা না করে আশ্চর্য্যজনক ভাবে নিশ্চুপ থাকছে।
কেন তা বোধগম্য নয়। শিক্ষা জগতের কেষ্ট বিষ্টুদের মধ্যে অনেকেই আজ জেলে। তবু কোন রকম উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। উপরন্তু কোর্ট বাধ্য হয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্যানেল বাতিল করায় হাজার হাজার শিক্ষক বেকার হয়ে পড়ায় তাদের গোটা পরিবার ঘোর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে। স্কুলগুলো শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। অনেক স্কুল শিক্ষকের অভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ প্রাইভেট স্কুলগুলো চলছে রমরমিয়ে। তাদের শিক্ষার মান ভাল ফলে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় ভাল ফল করছে। কিন্তু অতি সাধারণ ঘরের ছেলে মেয়েরা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বা অনেক পিছিয়ে পরছে। এর জন্য এক বৃহৎ শ্রেনীর মেধা অকালেই ঝরে যাচ্ছে। সমাজের এ ক্ষতি অপুরনীয়।
কলেজগুলোতে ছাত্র নির্বাচন বন্ধ। এর ফলে টানা ক্ষমতায় থাকার দরুন কিছু কিছু ক্ষমতাশীল ছাত্রের মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষকদের মারতে তাদের হাত কাঁপেনা। তারা নতুন ছাত্র ছাত্রীদের নির্যাতনে একেবারে সিদ্ধহস্ত। এক শ্রেনী শিক্ষক ক্লাসে পড়ান না ঠিকমতো, কিন্তু তিনিই আবার নিজস্ব কোচিং সেন্টার খুলে খুব ভাল পড়ান।
এক কথায় শিক্ষাকে পণ্য করা হচ্ছে। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেও কাটামানি দিতে হচ্ছে। অনেক ছাত্র ছাত্রী ভাল রেজাল্ট করার জন্য কোচিং ক্লাসে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। এইতো এখন অবস্থা। এমত অবস্থায় ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে একটা জিগ্গাসার চিন্হ স্পষ্ট। এই ক্ষেত্রে আমার ছাত্র জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বললে এই ফাঁকটা বোঝা যায়। এই অভিজ্ঞতা শুধু আমার একার নয় সব ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যেই এই অভিজ্ঞতাটা ছিল তখন।
তখন স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা হতো বছরের শেষে আর নতুন ক্লাস শুরু হতো নতুন বছরের শুরুতে। যদিও আজ এই শেষ বয়সে ঠিক মনে নেই পূজোর ছুটির পরে নাকি নতুন ক্লাসে ওটার পরে ক্লাস শুরুর প্রথমেই আমরা বাড়ী থেকে চাঁদা তুলে সব শিক্ষকদের ক্লাসে খাওয়াবার ব্যাবস্থা করতাম। ঠিক পূজোর ছুটির পরেই আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা হতো। তাই সম্ভবত সেই সময়টা নয়। তা যাই হোক আমরা ক্লাসের সব ছাত্র বাড়ী থেকে যে যেমন পারে পয়সা চেয়ে আনতাম। তখন এক পয়সার ভাল দাম ছিল। এছাড়া আমরা কয়েকজন প্রবল উৎসাহে কেউ কাপ ডিস কেউ কাঁচের গ্লাস কেউ আনত কেটলি, কেউ আনতো বাড়ী থেকে টেবিল ক্লথ বা সাদা কাপড়। তারপর বেঞ্চগুলো একত্রিত করে তার ওপর টেবিল ক্লথ পেতে হেডমাস্টার মশাই সমেত সমস্ত মাস্টার মশাইদের আমন্ত্রন করে ক্লাসে ডেকে এনে প্রণাম করে চেয়ারে বসাতাম। তারপর তাদের নোনতা মিষ্টি পরিবেশন করা হতো। কথা আদান প্রদানের মাধ্যমে একটা সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হতো। পরিশেষে চা পর্বে সভা শেষ।
ওদিকে ক্লাসের বাইরে অন্য ক্লাসের ছাত্ররা দাঁড়িয়ে আছে মাস্টার মশাইদের তাদের ক্লাসে
নিয়ে যাবার জন্য। এতে আমরা ছাত্ররা খুব আত্মপ্রসাদ লাভ করতাম।
মাস্টার মশাইদের মাইনে ছিল খুব কম। সবাই ধুতি পাঞ্জাবি পরে আসতেন। এবং সেটাও ছিল খুব মলিন ড্রেস। হেড মাসটার মশাই ও দু তিনজন মাস্টার মশাই ছাড়া। কিন্তু ছাত্রদের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালবাসা ছিল অমলিন। এমন কি কোন কোন মাস্টার নিজের জন্য কিছু না করে তার ছেলে মেয়ের সাথে কোন এক খুব গরীব ছাত্রকে একটা পূজোর জামা কিনে দিতেন।
তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। সেটা ছিল ঊনিশশো পঞ্চান্ন সাল ইংরাজী ক্লাস নিচ্ছেন অবনী বাড়ুরি স্যার। উনি ছিলেন ফর্সা মোটামুটি লম্বা ভাল চেহারা। কাচা ধুতি পাঞ্জাবী পড়তেন। তার গালের না কামানো দাড়ীতে বেশ ভাল লাগতো। আমি পাশের বন্ধু হিরেণকে স্যারের সাদা দাড়ীতে হাত বুলাবার ইচ্ছের কথা বলি। ফিসফিস কথা কানে যেতেই স্যার বিরক্ত বোধ করলেন। তিনি হিরেণকে জিগ্গেস করলেন পড়ার সময় বকবক করার কারণ। হিরেণ ভয়ে সব কথা স্যারকে বলে দেয়। স্যার আমাকে বেঞ্চের তলাদিয়ে বেরিয়ে আসতে বললেন। আমি ভয়ে প্রমাদ গুনলাম। কি শাস্তি আছে কপালে কে জানে। আমি স্যারের কাছে যেতেই তিনি আমাকে তার পেছনে যেতে বললেন। আমি স্যারের পেছনে যেতেই তিনি বললেন, ' নে আমার দাড়ীতে যত খুশী হাত বুলা এবার। আমি কিছু বলবো না।' আবার সবাইকে বললো, ' দেখ কি সরল ছেলে, কি অদ্ভুত আবদার।
বলে কিনা আমার দাড়ীতে হাত বুলাবার ইচ্ছা। নে বুলা।' আমিও সেদিন মনের আনন্দে স্যারের দাড়ীতে মনের সুখে হাত বুলিয়েছিলাম। এর প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর পর, সেটা সম্ভবত ঊনিশ ঊননব্বই সাল হবে, আমি তখন থাকি দমদম পূর্ব সিঁথিতে। একদিন সকালে আমি আমার ছোট্টো মেয়েকে নিয়ে দোকান থেকে বাড়ী ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি আমাদের হেড পন্ডিত উল্টো দিক দিয়ে আসছে। সামনে আসতেই আমি অবাক হলাম।
বাজারের মধ্যে কত চেনা অচেনা লোকের মধ্যেও ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে আমার বিন্দু মাত্র দ্বিধা হলোনা মনে। বললাম, ' স্যার আপনি এখানে?' তিনি আমাকে আরোও অবাক করে দিয়ে বললেন, ' দীপক, আমিও তো তোমাকে জিগ্গেস করছি তুমি এখানে? এখানে বাড়ী করেছ নাকি?' আমি বলি হ্যাঁ স্যার, চলুন আমাদের বাড়ী।'
তিনি সময়ের অভাবের কথা বলে এড়িয়ে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, দীপক জান, তোমাদের জেনারেসনটা এখনও শিক্ষকদের সন্মান করে। আর এখন যা দেখি, যাকগে সে সব কথা। আচ্ছা আমি এখন চলি কেমন। দেরী হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম আমি সংস্কৃতিতে স্যারের মোটেই প্রিয় ছাত্র ছিলাম না। তবুও এত বছর পরেও আমার নামটা তার ঠিক মনে আছে।
ক্লাস সিক্স পর্য্যন্ত ছিল আমাদের মর্নিং সেকসেন। দুজন স্যার জীতেনবাবু ও সুকুমারবাবু আমাদের দায়িত্ব নিয়ে কোন বছর চিড়িয়াখানা কোন বছর জাদুঘর বা কোন বছর বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখনও দেশ স্বাধীনতার ছোঁয়া সর্বত্র বয়ে চলেছে। তাই তেইশ জানুয়ারী ও পনেরই আগস্ট স্যারেরা আমাদের মার্চপাস্ট করিয়ে মাঠে নিয়ে যেত। সেখানে বিশেষ বিশেষ লোকেরা উপস্থিত থাকতেন।
এলাকার সব স্কুল ও ক্লাবের ব্যান্ড বাজিয়ে মার্চপাস্ট হতো। প্রথমে অবশ্য তোপ দাগা হতো। দেশাত্মবোধক গান বাজতো। এখন নিশ্চয়ই এই আয়োজন আর হয়না। হয়তো যার যার স্কুলে সেটা হয়।
প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেও সেই সব মাস্টার মশাইদের কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। আজ যখন শিক্ষাঙ্গনে রীতিমত রাজনীতি প্রবেশ করেছে সে ক্ষেত্রে যা হবার তাই হচ্ছে। অতএব শিক্ষাকে যতটা সম্ভব রাজনীতি থেকে দুরে রাখা যায় তার প্রচেষ্টা যদি দলমত নির্বিশেষে একত্র হয়ে করে যেতে পারে এবং তার সাথে প্রশাসনও যদি শিক্ষার উন্নতিতে হাত বাড়িয়ে দেয় তবে পশ্চিমবঙ্গ আবার শিক্ষায় ভারতে প্রথম স্থান অধিকার করবে নিশ্চিত। আর তা নাহলে এর কুফল থেকে কেউ রেহাই পাবে না। গোটা প্রজন্ম শিক্ষার আলোর অভাবে আমাদের পরের প্রজন্ম অন্ধত্বপ্রাপ্ত হবে আর তার সাথে গোটা সমাজ পিছিয়ে পরবে বহুবছরের জন্য।
__________________________
Dipak Kumar Paul (9007139853),
DTC, Block-8, Flat-1B, Kol - 700104.

Comments
Post a Comment