সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি
দীনেশ সরকার
প্রায় দু'শ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক আর এক পন্ডিত মদন মোহন তর্কালংকার তার "আমার পণ" কবিতায় লিখেছিলেন, 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি / সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।' সারাদিন ভালো হয়ে চলা যে কি দুরূহ কঠিন কাজ তা সত্যসুন্দরবাবুর চেয়ে ভালো আর কে জানেন! ছা-পোষা কেরানি সত্যসুন্দরবাবু ইতিপুর্বে বেশ কয়েকবার সকালে উঠে পণ করেছেন, 'আজ আমি ভালো হয়ে চলব। কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করব না, কাউকে কটু কথা বলব না, অহেতুক উত্তেজিত হব না, কারণে-অকারণে মেজাজ হারাব না। সবার সাথে সারাদিন সুমধুর ব্যবহার করব।' কিন্তু দিনের কোন না কোন সময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে তিনি নিজেকে সামলাতে পারেন নি। উত্তেজিত হয়েছেন, রাগারাগি করেছেন। একবার তো সারাদিন ভালোয় ভালোয় কাটিয়ে, একটুও রাগারাগি না করে রাত্রে বিছানায় শুয়ে মনে মনে বলতে যাবেন, 'আমি পেরেছি, একটা দিন আমি ভালো হয়ে চলতে পেরেছি।' কিন্তু মনে মনে বলার আগেই কলঘর থেকে গিন্নির চিৎকার, 'ও, বাবাগো, মরে গেলাম গো।'
সত্যসুন্দরবাবু কলঘরে ছুটলেন। গিন্নি পা পিছলে চিৎপটাং। সত্যসুন্দরবাবুর মেজাজ বিগড়ে গেল, 'একটু দেখেশুনে পা ফেলতে পার না। জানই তো কলঘরটা একটু পিচ্ছিল হয়েছে। আমি তো রোববারের আগে ঘষামাজা করতে পারব না। দুটো দিন একটু দেখে শুনে পা ফেলতে পারলে না।'
গিন্নিও চিৎকার করে উঠলেন, 'আমি কি ইচ্ছে করে পড়েছি নাকি! আমি তো কলতলায় এঁটো বাসনপত্র রাখতে গেছিলাম। আর তখনই পা পিছলে - - -, 'ও বাবা গো, ব্যথার পাটায় আবার ব্যথা লাগল।'
সত্যসুন্দরবাবু গিন্নিকে ধরে ধরে শোয়ার ঘরে এনে বিছানায় বসিয়ে পায়ে বরফ ঘষার জন্য বরফ আনতে ফ্রিজ খুলে দেখেন ফ্রিজ সাফ, ফ্রিজে কোন বরফ নেই। শোয়ার ঘর থেকে গিন্নি চেঁচিয়ে উঠলেন, 'ওগো, তুমি বরফ পাবে না। আজ আমি ফ্রিজের ভিতরটা পরিষ্কার করেছি। তারপর আর ফ্রিজে বরফের জল রাখা হয় নি।'
শুনে সত্যসুন্দরবাবুর মেজাজ সপ্তমে উঠল, 'এত রাতে আমি কার বাড়ি তোমার জন্য বরফ চাইতে যাব!'
গিন্নি বললেন, 'ওগো, বরফ লাগবে না। তুমি আমার পায়ে একটু আয়োডেক্স মালিশ করে দাও।'
গিন্নির পায়ে আয়োডেক্স মালিশ করতে করতে সপ্তমে ওঠা মেজাজে সত্যসুন্দরবাবু ভাবতে লাগলেন, 'আয়োডেক্স এ যদি কাজ না হয়, যদি মচকে গিয়ে থাকে তবে তো কালই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কাল তো আমার অফিস ইন্সপেকশন, কোনভাবেই ছুটি নেওয়া যাবে না। একি ফ্যাসাদে পড়লাম রে বাবা।'
সারাদিন নিজেকে সংযত রেখেও শোয়ার সময় আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না, মেজাজ হারালেন। তাই সেদিনের মতো ভালো হয়ে চলা আর হ'ল না।
কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন সত্যসুন্দরবাবু। আজ আবার সকালে উঠেই মনে মনে পণ করলেন, 'আজ আমি সারাদিন ভালো হয়ে চলব। মানুষ এত অসাধ্য সাধন করছে আর আমি একটা দিন ভালো হয়ে চলতে পারব না! যাই ঘটুক না কেন আজ আমি মেজাজ হারাব না, রাগারাগি করব না, কারও সাথে বাগবিতন্ডা, ঝগড়াঝাঁটি কিছুই করব না। আজ আমি ভালো হয়ে চলবই চলব।'
সকালে চা খেয়ে সত্যসুন্দরবাবু বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজারে বের হতে যাবেন, রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে গিন্নি বললেন, 'আমার পায়ের জেলটা ফুরিয়ে গেছে, হাঁটুর ব্যথাটা আবার বেড়েছে। একটা জেল নিয়ে এসো।'
অন্যদিন হলে সত্যসুন্দরবাবু মেজাজ চড়িয়ে বলতেন, 'আজ মাসের ছাব্বিশ তারিখ সে খেয়াল আছে তোমার। মাসের শেষে ছা-পোষা কেরানিদের পকেটের কি হাল হয়, এত বছর সংসার করছ সেটা কি তুমি জান না? পাঁচ দিন পরে জেলটা আনলে কি খুব অসুবিধা হবে?'
গিন্নিও সুর চড়াতেন, 'থাক্, আনতে হবে না। অত কথার কাজ কি! আমি ব্যথায় কাতরালে তোমার কি!'
সত্যসুন্দরবাবু গরম মেজাজেই বলতেন, 'ঠিক আছে এসে যাবে।'
কিন্তু আজ? আজ একমুখ হেসে বললেন, 'ঠিক আছে গো। নিয়ে আসব।'
গিন্নি চমকে উঠলেন, লোকটা তো এভাবে কথা বলে না। কিছুক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন।
মেয়ে পড়ার ঘর থেকে বলল, 'বাবা, বাজার যাচ্ছ? কবে থেকে বলছি আমার অঙ্কখাতা এনে দাও। আর মাত্র চার-পাঁচটা পাতা বাকি আছে। তুমি আজকেই আমার অঙ্কখাতা নিয়ে আসবে।'
অন্যদিন হলে সত্যসুন্দরবাবু বলতেন, 'মাসের শেষ, আর তোর অঙ্কখাতা ফুরিয়ে গেল। চার-পাঁচটা দিন দেরি কর না। এক তারিখে ঠিক তোর অঙ্কখাতা এনে দেব।'
কিন্তু আজ সত্যসুন্দরবাবু খুব মোলায়েম করে বললেন, 'ঠিক আছে মা, তুই অঙ্ক কর, আমি তোর অঙ্কখাতা আজই নিয়ে আসব।'
কাছেই বাজার। যাওয়ার সময় পায়ে হেঁটেই যান, আসার সময় ব্যাগ যখন বেশ ভারী হয় তখন একটা টোটো নিয়ে ফেরেন নাহলে হেঁটেই ফেরেন। এতে যেমন শরীরচর্চা হয়, তেমনি পাঁচটা মানুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, আলাপ পরিচয় হয়। এই আজ যেমন রাস্তায় পা রাখতেই প্রতিবেশী ভবানীবাবুর মুখোমুখি। ভবানীবাবু মোহনবাগানের অন্ধ ভক্ত আর সত্যসুন্দরবাবু ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সমর্থক। ভবানীবাবু দাঁড়িয়ে পড়ে শুরু করলেন, 'কি সত্যবাবু, মোহনবাগানের কাছে আবার হারলেন তো। আপনার ইস্টবেঙ্গলের কি আছে বলুন তো? না আছে ভালো স্ট্রাইকার,না আছে ভালো ডিফেন্ডার।'
অন্যদিন হলে সত্যসুন্দরবাবু মুখের উপর জবাব দিতেন, 'পাঁচ গোলের ঘা এখনও তো শুকায় নি। এত বছরেও তো বদলা নিতে পারলেন না। তা অত বড়াই কিসের?'
কিন্তু আজ পণ করেছেন, অহেতুক বাগবিতন্ডায় জড়াবেন না। তাই মিষ্টি হেসে বললেন, 'খেলা মাত্রেই তো হার-জিৎ আছে ভবানীবাবু। আপনারা ভালো খেলেই জিতেছেন। আচ্ছা, চলি, বাজারে দেরী হয়ে যাচ্ছে।' ভবানীবাবু সত্যসুন্দরবাবুর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। এ কোন্ সত্যবাবু, পাঁচ গোলের খোঁচা না দিয়েই বাজারে চলে গেল।
মাছ বাজারে ঢুকে জ্যান্ত কাতলা মাছের দর জিজ্ঞেস করলেন। মাছওয়ালা বলল, 'তিন শ টাকা।'
সত্যসুন্দরবাবু বললেন, 'ওজন কর।'
মাছওয়ালা একটু চমকে উঠল। যে লোকটা তিনশ টাকা বললে আড়াইশ টাকা থেকে দরদাম শুরু করে দু'শ আশি টাকায় রফা করে সে আজ এক কথায় তিনশ টাকায় রাজি হয়ে গেল। মাছওয়ালা একটু হকচকিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, 'বাবু আপনার শরীর ঠিক আছে তো। মুখ-চোখ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।'
সত্যসুন্দরবাবু বললেন, 'না-না, আমি ঠিক আছি। একটু তাড়া আছে এই আর কি।'
মাছ ওজন হ'ল। মাছওয়ালা চোখের সামনে দাঁড়ি মারল দেখেও সত্যসুন্দরবাবু কিছুই বললেন না। অন্যদিন হলে দুবার ওজন করতে বলতেন, দুটো কথা শোনাতেন। মাছের দাম মিটিয়ে সবজি বাজারে ঢুকলেন।
সবজিবাজার আগুন। দরদাম করলে কথাকাটাকাটি, বাগবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। আজ আর কোন দরদাম নয়। কোন্ জিনিসটা কতটা লাগবে সবজিওয়ালাকে শুধু সেটাই বলতে লাগলেন। সবজিওয়ালা একটু অবাকই হ'ল। যে খিটখিটে লোকটা দরাদরি না করে কোন সবজি কেনে না সে আজ কোন জিনিসের দাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করছে না। ব্যাপারটা তার কাছে গোলমেলে মনে হ'ল। সত্যসুন্দরবাবু সবজি নিয়ে বুঝলেন ব্যগটা ভালোই ভারী হয়েছে। টোটো নিতে হবে। গিন্নির হাঁটুব্যথার জেল আর মেয়ের অঙ্কখাতা নিয়ে সত্যসুন্দরবাবু টোটোওয়ালার কাছে গিয়ে কত নেবে জিজ্ঞেস করতে টোটোওয়ালা পঞ্চাশ টাকা হাঁকল। অল্প দূরত্ব, অন্যদিন হলে দরদাম করে ওটা ত্রিশ টাকায় দাঁড় করাতেন। কিন্তু আজ কিছু না বলে টোটোয় উঠে পড়লেন। টোটোওয়ালাও একটু অবাক হ'ল। লোকটা দরদাম না করে তো কোনদিন টোটোয় চাপে না। আজ লোকটার হ'লটা কি!
নাকে-মুখে গুঁজে ট্রেন ধরার জন্য বের হতেই পিছন থেকে গিন্নি ডাকলেন, 'ওগো শুনছ, আমি তোমাকে বলতে একদম ভুলে গেছি। লক্ষ্মীর মা আজ পাঁচশ টাকা নেবে, কাল বলে গেছে। তুমি পাঁচশ টাকা রেখে যাও।'
অন্যদিন হলে সত্যসুন্দরবাবু পিছু ডাকার জন্য রেগেমেগে বলতেন, 'এই তো দিন তিনেক আগে পাঁচশ টাকা নিল। আজ আবার পাঁচশ। মাসের শেষে তাহলে আর কতটুকু হাতে পাবে? ওকে বলে দিও, মাস শেষ হলে একবারে পুরো টাকা নিয়ে নিতে।'
গিন্নি বলতেন, 'আহা, ওর টাকার দরকার বলেই তো চাইছে। শেষে যদি টাকা দাও নি বলে কাজ ছেড়ে দেয় তখন কি হবে?'
কিন্তু আজ আর সত্যসুন্দরবাবু কোনরূপ বাগবিতন্ডায় জড়ালেন না। পার্স খুলে গিন্নির হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে দেখলেন পার্সে আর কয়েকশ টাকা পড়ে আছে। আবার এ টি এম থেকে টাকা তুলতে হবে। ঘর থেকে এ টি এম কার্ডটা নিয়ে সত্যসুন্দরবাবু ট্রেন ধরতে ছুটলেন।
প্লাটফর্মে পৌঁছে দেখলেন রোজকার মতো আজও থিকথিক করছে মানুষ। অফিস টাইমের চেনা ছবি। লোকাল ট্রেন দাঁড়াতেই হুড়মড়িয়ে সবাই উঠতে লাগল। যে দুএক জন নামার লোক ছিল তারা নামতে পারছে না দেখে তাদেরকে টেনে টেনে নামিয়ে দেওয়া হ'ল। তারপর ধাক্কাধাক্কি করে কোনরকমে ট্রেনের হ্যান্ডেলটা ধরতে পারা। সত্যসুন্দরবাবু ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠলেন বটে কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারলেন না। দরজার পাশে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে তখনও কেউ কেউ দরজার বাইরে ঝুলছে। যারা দরজায় দাঁড়িয়ে তারা 'মারো টান হেঁইয়ো' করে যারা ঝুলছিল তাদেরকে গরু-গাধার মতো দরজার ভিতরে ঢুকিয়ে নিল। একজনের কনুই এসে লাগল সত্যসুন্দরবাবুর বুকে। সত্যসুন্দরবাবু মুখ বুঁজে সহ্য করলেন। এটুকু ধাক্কাধাক্কি সহ্য করতে না পারলে আর ডেলি প্যাসেঞ্জার কিসের। মনে মনে হাসলেন সত্যসুন্দরবাবু। এই ভিড়ের মধ্যেই এক ঝাল্মুড়িওয়ালা তার কাঁধে মুড়ির টিন নিয়ে পাঁকাল মাছের মতো ঠেলেঠুলে ট্রেনের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই মুড়ির টিনটা ঠক করে লাগল সত্যসুন্দরবাবুর মাথায়। অন্যদিন হলে রেগেমেগে মুড়িওয়ালাকে দু-চারটে কথা শুনিয়ে দিতেন, 'তোরা এই অফিস টাইমটাকে ছাড় দিতে পারিস্ না! মুড়ির টিন নিয়ে ভিতরে ঢুকবি কি করে আর মশলামুড়ি বানিয়ে বেচবি কি করে। শুধু শুধু ধাক্কাধাক্কি করছিস্।'
মুড়িওয়ালা শান্তভাবে জবাব দিত, 'কী করব বাবু। পেটের দায়ে ধাক্কাধাক্কি করছি। আপনি একটু ওইদিকটায় মাথাটা বেঁকিয়ে রাখুন আমি ঠিক ঢুকে যাব।'
সত্যসুন্দরবাবু সুর চড়িয়ে বলতেন, 'তোদের জ্বালায় এবার আমাদের অফিস যাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। যত্তসব!'
কিন্তু আজ? মুড়ির টিনটা মাথায় লাগলেও খুব শান্তভাবে বললেন, 'একটু দেখে শুনে টিনটা নিয়ে যা ভাই।'
'কী করব বাবু' বলে মুড়িওয়ালা পাঁকাল মাছের মতো গলে গলে ট্রেনের ভিতরে ঢুকে গেল। সত্যসুন্দরবাবু মনে মনে হাসলেন, 'আমিও তো পেটের দায়ে ধাক্কাধাক্কি করে অফিস যাচ্ছি আর মুড়িওয়ালাও পেটের দায়ে ধাক্কাধাক্কি করে মুড়ি বেচছে। দুজনেরই উদ্দেশ্য এক।'
শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন থামতেই লাভাস্রোতের মত জনস্রোত আছড়ে পড়ে প্লাটফর্মে। মুহূর্তে সারা প্লাটফর্মে থিকথিক করে কালো মাথা। যাদের ডালহাউসিতে অফিস তারা ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটেই গলির ভিতর দিয়ে ডালহাউসি পৌঁছে যায়। বাসের জন্য অপেক্ষা, তারপর শম্বুকগতির বাসে চেপে ডালহাউসি যাওয়ার চেয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়াই তাদের কাছে শ্রেয়। সত্যসুন্দরবাবু ট্রেন থেকে নেমে ডালহাউসির উদ্দেশ্যে হনহনিয়ে হাঁটা লাগালেন। চলার পথে প্রথম যে এ টি এমটি পেলেন সেখানে ঢুকে দেখলেন মেসিনের গলায় হার পরানো। হারের লকেটে লেখা " Out of Order", দ্বিতীয় এ টি এম কাউন্টারে ঢুকেও টাকা তুলতে পারলেন না। মনে হ'ল, "Link failure." কিন্তু তার রাগ হ'ল না। মনে মনে হাসলেন, হায় রে ডিজিটাল ইন্ডিয়া।
গলদঘর্ম হয়ে সত্যসুন্দরবাবু অফিসে এসে ঢুকলেন। ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। এখন তার প্রথম কাজ এক গ্লাস জল খাওয়া। কিন্তু ক্যান্টিনবয় অমল আজ জলের গ্লাস টেবিলে রাখে নি তো। কী ব্যাপার! অন্যদিন হলে চেঁচিয়ে অফিস মাথায় করতেন, 'কিরে অমল, জল কি তোর কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে খেতে হবে? জলের জন্য তুই পয়সা পাস্ না!'
অমল জল নিয়ে ছুটে আসত। কাচুমাচু মুখ করে বলত, 'আমার ভুল হয়ে গেছে। জল গ্লাসে ভরে রেখেছিলাম, দিতে ভুলে গেছি।'
সত্যসুন্দরবাবু চেঁচিয়ে বলতেন, 'এ রকম ভুল যেন আর না হয়।'
আজও তো অমল সেই একই ভুল করেছে। জল দিতে ভুলে গেছে। সত্যসুন্দরবাবুর ইচ্ছা হচ্ছিল চেঁচিয়ে অমলকে ডেকে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু না, আজ তিনি কোনমতেই উত্তেজিত হবেন না। অতিকষ্টে নিজেকে সংযত করলেন। কাজে বসে গেলেন।
একটু পরে অমল চা দিতে এসে দেখে সত্যসুন্দরবাবুকে জল দেওয়া হয়নি। 'ইস্ আপনাকে জল দেওয়া হয়নি' বলেই একছুটে ক্যান্টিন থেকে জলের গ্লাস এনে সত্যসুন্দরবাবুর টেবিলে রেখে বলল, 'আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। আসলে জল ভরে আপনাকে গ্লাসটা দিতে আসার সময় দেখি চায়ের দুধটা উতলে উঠেছে। দুধ দেখতে গিয়ে আপনাকে জল দিতে ভুলে গেছি।'
অন্যদিন হলে সত্যসুন্দরবাবু অমলকে দুচার কথা শুনিয়ে দিতেন। কিন্তু না, আজ তিনি কোনভাবেই কটুকথা বলবেন না। মৃদু হেসে বললেন, 'ভুল তো মানুষেরই হয় রে। দে দেখি, জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দে, জলটা খাই। তারপর চা দে।'
সত্যসুন্দরবাবুর কথা শুনে অমল চমকে উঠল। সে তো তার ভুলের জন্য সত্যসুন্দরবাবুর কাছে বকা খেতে মনে মনে প্রস্তুত ছিল। সত্যসুন্দরবাবু তো বকলেন না, উলটে মিষ্টি করে কথা বলছেন। ওনার আজ হ'লোটা কী!'
কিছুক্ষণ পরে পিয়ন কালীপদ এসে বলে গেল, 'বড়বাবু আপনাকে ডাকছেন।'
সত্যসুন্দরবাবু ছুটলেন বড়বাবুর ঘরে। বড়বাবু বললেন, 'বসুন সত্যবাবু। হেড অফিস থেকে একটা জরুরি চিঠি এসেছে, আজই তার রিপ্লাই দিতে হবে। কাজটা মানিকবাবুর। কিন্তু মানিকবাবু দুদিন আসবেন না । আমি ফাইলটা আপনার টেবিলে পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনি একটু রিপ্লাইটা করে দিন প্লীজ।'
অন্যদিন হলে সত্যসুন্দরবাবু তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন। বলতেন, 'কেউ না এলে তার কাজটা আপনি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। আমার কাজটা কে করবে বলুন তো? অফিসে তো আরও লোক আছে, তাদের দিয়েও তো কাজটা করাতে পারেন। তা না করে অন্যের কাজটা সবসময় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। এটা ঠিক না।'
বড়বাবু জানেন তাকে রাগলে চলবে না। সত্যবাবুকে দিয়েই কাজটা করাতে হবে। তিনি মৃদু হেসে বলতেন, 'অন্যের সঙ্গে আপনি আপনার তুলনা করছেন সত্যবাবু। আপনি জানেন না ওদের কাজের standard. কি রকম ভুলভাল করে। প্রতিটা ফাইল আমাকে correction করে আবার টেবিলে ফেরৎ পাঠাতে হয়। আপনাকে কাজ দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে থাকি। শুধু সই করে ফাইল ছেড়ে দিই।'
সত্যসুন্দরবাবু উত্তেজিত হয়ে বলতেন, ' তাহলে এবার থেকে আমিও ভুলভাল করব। তখন বুঝবেন।'
বড়বাবু হাসতে হাসতে বলতেন, 'আপনি চেষ্টা করলেও পারবেন না সত্যবাবু। এত বছর আপনাকে দেখছি। আমি মানুষ চিনি সত্যবাবু।'
সত্যসুন্দরবাবু রাগে গাঁইগুঁই করতে করতে নিজের টেবিলে ফিরে আসতেন।
কিন্তু আজ? আজ উনি কোনভাবেই রাগারাগি করবেন না। সত্যসুন্দরবাবু হেসে বললেন, 'ঠিক আছে স্যার, ফাইলটা পাঠিয়ে দিন। আমি রিপ্লাই করে দিচ্ছি।'
সত্যসুন্দরবাবু নিজের টেবিলে ফিরে এলেন। বড়বাবু অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, 'লোকটার আজ হ'লটা কী! একটুও রাগারাগি করল না। হাসিমুখে কাজটা করতে রাজি হয়ে গেল!'
ছুটির পরে অফিস থেকে বেরিয়ে অফিসের কাছাকাছি এক এ টি এম কাউন্টারে গিয়ে দেখলেন কয়েকজনের লাইন আছে। তারমানে এ টি এম ঠিক আছে, এখানে টাকা পাওয়া যাবে। সত্যসুন্দরবাবু লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। একটু পরে দেখলেন, একজন "কী রে, কেমন আছিস্?" বলে আরএকজনের সামনে ঢুকে পড়ে খোশমেজাজে গল্প করে যাচ্ছে। যেন লাইনের মাঝে ঢুকে পড়াটা তার জন্মগত অধিকার। রাগে সত্যসুন্দরবাবুর মাথাটা গরম হয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছিল টেনে লাইন থেকে বার করে এনে সবার পিছনে দাঁড় করিয়ে দিতে। তবেই ওদের উচিৎ শিক্ষা হবে। কিন্তু না, আজ তিনি রাগারাগি করবেন না। অতিকষ্টে নিজেকে সংযত করে লাইনে দাঁড়িয়ে রইলেন। শেষে টাকা তুলে ছুটলেন শিয়ালদা স্টেশনের দিকে।
আবার গাদাগাদি ভিড়, ঠেলাঠেলি, হকারদের উপদ্রব। এসব সইতে না পারলে ডেলি প্যাসেঞ্জার কিসের! অন্যদিন হলে তবু রাগারাগি করতেন, মৃদু প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু আজ সবকিছু মুখবুঁজে সহ্য করলেন।
গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে দেখলেন ঘরের সামনে কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়ে। তাদের একজন বলে উঠল, 'এই যে কাকু এসে গেছে।'
সত্যসুন্দরবাবু বললেন, 'তোমরা?'
দলের পান্ডা জবাব দিল, 'কাকু আমরা 'অগ্রগামী' সংঘ থেকে এসেছি। শ্যামাপুজোর চাঁদার জন্য।' 'অগ্রগামী সংঘ' পাশের পাড়ার ক্লাব। ওরা শ্যামাপুজো করে, প্রতিবছরই চাঁদা নিয়ে যায়। বসবাস করতে গেলে খাওয়াদাওয়া হোক আর না হোক পুজোর চাঁদা দিতেই হবে, এটা সত্যসুন্দরবাবু ভালোমতোই জানেন।
দলের একজন বলে উঠল, 'গতবার আপনি পাঁচশ টাকা দিয়েছিলেন, এবার কিন্তু কাকু হাজার টাকা দিতে হবে। বুঝতেই তো পারছেন বাজার আগুন, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। বিল দিয়ে যাচ্ছি। আমরা দু তারিখে আসব টাকা কালেকশন করতে।'
অন্যদিন হলে রেগেমেগে বলতেন, 'জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া সে আমি জানি। তাই বলে পাঁচশ টাকাটা বেড়ে একলাফে হাজার টাকা? এটা কি যুক্তিগ্রাহ্য। গতবার পাঁচশ ছিল এবার ছ'শ নাও। এর বেশি আমরাই বা দেব কোত্থেকে বলতে পার?'
তখন হয়তো ছেলেরা বলত, 'ঠিক আছে কাকু ছ'শ না আপনি সাতশ দিন, এটা আমাদের দাবি।'
সত্যসুন্দরবাবু তখন গম্ভীরগলায় বলতেন, 'ঠিক আছে। দু তারিখে নিয়ে যেও।'
কিন্তু আজ? আজ কিছু বললে কথায় কথা বাড়বে, রাগারাগি হবে। আজ তিনি কিছুতেই রাগারাগি করবেন না। তাই তিনি অতিকষ্টে নিজের রাগ প্রশমিত করে বললেন, 'ঠিক আছে ভাই। তোমরা দু তারিখে নিয়ে যেও।'
তখন একজন আরএকজনকে বলল, 'এই কাকুর নামে হাজার টাকা লিখে রাখ।'
ঘরে পা রাখতেই গিন্নি একহাত নিলেন, 'তুমি কী গো? ওরা হাজার টাকা চাঁদা চাইল আর তুমি সেটা মুখবুঁজে মেনে নিলে? তুমি তো ছশ টাকা বলতে পারতে, সাতশ টাকা বলতে পারতে। একেবারে ডবল! বুঝি না বাপু আজ তোমার কি হয়েছে।
সত্যিই তো গিন্নি কী করে বুঝবেন সত্যসুন্দরবাবুর আজ কী হয়েছে। তিনি যে ভলো হয়ে চলার পণ করে বসে আছেন।
নিঃঝুম রাত। পাশে গিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছেন, মৃদু নাসিকা গর্জন শোনা যাচ্ছে। সত্যসুন্দরবাবু শুয়ে শুয়ে সকাল থেকে এই মাঝরাত পর্যন্ত তিনি কি কি করেছেন, কাকে কি বলেছেন, সবকিছু ভাবতে লাগলেন। না, আজ তিনি মেজাজ হারাননি, রাগারাগি করেননি, কাউকে কটুকথা বলেন নি। মনে মনে বললেন, 'আমি পেরেছি! মদনমোহনবাবু, আমি পেরেছি! 'সারাদিন ভালো হয়ে চলা'র পণ রক্ষা করতে আমি পেরেছি। আমি পেরেছি!'
এক অনাবিল প্রশান্তিতে সত্যসুন্দরবাবুর হৃদয় ভরে গেল। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এ এক পরম শান্তি। পরম শান্তিতে সত্যসুন্দরবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। আসুন না, আমরাও পণ করি, সপ্তাহের একটা দিন আমরাও সারাদিন ভালো হয়ে চলব।
********************
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর --- ৭২১৩০৬
মোবাইল ও হোয়াটসঅ্যাপ নংঃ ৯৮০০৪২১৫৩৫

Comments
Post a Comment