হেমন্তের ভ্রমণমুখর জুমু'আ
জুয়াইরিয়া সারাহ
গাড়ি যখন ঢাকা বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল, ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা। সবাই মেঝো মামাকে প্রশ্ন করছিল— "যাচ্ছি কোথায়?" কিন্তু তিনি শুধু রহস্যময় মুচকি হাসছিলেন। গাড়িতে তেলাওয়াত বাজছিল, মনটা শান্ত ছিল। হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ খুলে দেখি— আমরা গাজীপুরে, মামার প্লটের পাশে এসে পৌঁছে গেছি!
মামা সবাইকে বললেন, "নেমে পড়ো।" আমরা চোখ মলে মলে নামলাম। ততক্ষণে তিনি পুকুরপাড়ে সকালের নাস্তার জন্য চাদর বিছিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু রাস্তা থেকে প্লট প্রায় তিরিশ ফিট নিচে, আর নামার পথটা গর্তে ভরা। আমি নামতে দ্বিধায় পড়তেই মামা দৌড়ে এসে বললেন,
> "জুতা খুলে শুধু আমার হাতটা ধরো।"
বলেই টেনে নিচে নামিয়ে আনলেন।
শিশিরভেজা ঘাসে পা পড়তেই যেন শীতলতা ছড়িয়ে গেল সারা দেহে— তনুমন জুড়িয়ে গেল। সবাই হেসে উঠল,
"শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিলে!"
আমি হেঁটে গেলাম পুকুরপাড়ে। দেখি, এক মাঝি নৌকা নিয়ে মাছেদের খাবার দিচ্ছে। চারপাশে সাদা বকের উড়াউড়ি, ধানক্ষেতে হেমন্তের হাওয়া, আর রৌদ্রের ঝলকে চিকচিক করছে পানির ঢেউ।
আহা! কী নান্দনিক প্রকৃতি, কী চমৎকার অনুভূতি!!
এরই মধ্যে মামা গরম গরম নাস্তা নিয়ে এলেন। আমরা সকলে নাস্তা সেরে পাশে থাকা ছাগলছানার সঙ্গে খেলতে লাগলাম। মামা একটিকে রুটি খাওয়ানোর চেষ্টা করলেন— আর সেটি সত্যিই খেয়ে ফেলল!
সেই দৃশ্য দেখে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলা।
নাস্তা শেষে আমি দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মনে মনে বললাম, "এতটা কঠিন তো ছিল না ওঠা!"
গাড়ি এবার ছুটল রাজেন্দ্রপুরের দিকে। ভাবলাম, নিশ্চয় ছোট মামার বাসায় যাচ্ছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মামা ও তাঁর দুই ছেলে নিয়ে রওনা হলেন এক রহস্যময় রিসোর্টের পথে।
আধঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম। সাইনবোর্ডে লেখা— "নক্ষত্র বাড়ি রিসোর্ট"।
বাহির থেকে সাধারণ মনে হলেও, ভেতরে ঢুকতেই বিস্ময়— গ্রামীণ সৌন্দর্যের মাঝে এক বিলাসবহুল অবকাশকেন্দ্র! প্রবেশমুখে লেক, তার ধারে রঙিন কাগজে সাজানো বসার জায়গা।
বসতেই পরিবেশন করা হলো স্বাগত পানীয়। মামারা রিসেপশনে গিয়ে তিন ঘণ্টার জন্য পুল এরিয়া বুক করলেন— যেন কেবল আমাদের জন্যই পুরো স্থানটি সংরক্ষিত থাকে।
আমরা পোশাক পরিবর্তন করে মেয়েরা সবাই একসাথে পানিতে নামলাম। ওপরে নীল আকাশ, মেঘের পুঞ্জ আর সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে পুল। একপাশে ফুলগাছের ঘেরা প্রাচীর, অন্যপাশে কাঠের কটেজ ও জুসবার।
আমি রিং হাতে ভেসে গেলাম ঝর্ণার দিকে। গাছতলার চারপাশে ছোট-বড় পাথর, উপরে ঝুলন্ত লতায় ফিরোজা-বেগুনি ফুল। আশেপাশে উড়ছে রঙিন প্রজাপতি, গুনগুন করছে কালো ভ্রমর। দূর থেকে ভেসে আসছে গ্রামীণ সুর।
আনন্দে আমি এক অঞ্জলি পানি ছুড়ে মারলাম গাছের দিকে— হঠাৎ দেখি এক ভ্রমর আমার দিকে উড়ে আসছে! মুখ ওড়নায় ঢেকে ফেললাম তাড়াতাড়ি।
গলা পর্যন্ত পানি উঠে গেছে! আমি পালাতে লাগলাম, আর সবাই আমার দিকে পানি ছুড়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। আমিও পাল্টা ছিটাতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর সবাই ক্লান্ত— আমাদের "পানিযুদ্ধ" শেষ।
এরপর মামা বল নিয়ে এলে আমরা খেলতে লাগলাম। হঠাৎ এক বল এসে আঘাত করল আমার নাক-কপালে! সবাই হেসে কুটিকুটি। ঠিক তখনই মামারা জুমা শেষে ফিরে এলেন— সঙ্গে আনলেন ভাসমান নাস্তার ট্রে।
শীতল জলে ভাসমান গরম গরম নাস্তা— কী আনন্দ, কী প্রশান্তি!
এরপর শুরু হলো "লাফ প্রতিযোগিতা।" প্রত্যেকের লাফে ছোট ছোট ঢেউ উঠছিল। মেঝো মামা উল্টো লাফ দিয়ে উঠেই কাঁপা গলায় বললেন,
> "এত ঠান্ডা জানলে আমি জীবনেও নামতাম না!"
সবাই আবার হাসিতে মেতে উঠল।
তিন ঘণ্টা পর আমরা উঠে গোসল ও নামাজ সেরে রিসোর্টে ঘুরে বেড়ালাম। লেকের একপারে ধূসর-বাদামি স্থাপনার মাঝে লাল-বাসন্তী বাড়ি, চারপাশে গাছপালা। মাঝখানে সাদা কাঠের ছোট ব্রিজ—
দৃশ্যটা যেন ছবির ফ্রেম থেকে ছুটে এসেছে!
ব্যস্ত শহরের ইট-পাথরের ক্লান্তি পেরিয়ে এমন শান্ত পরিবেশে এসে মনে হলো—
> প্রকৃতির শ্যামলতাই আসল বিশ্রাম।
আসরের আজান হলে আমরা সালাত আদায় করলাম। দরুদ পড়তে পড়তে রওনা হলাম ছোট মামার বাসার পথে।
====================
জুয়াইরিয়া সারাহ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
Comments
Post a Comment