অন্নদা ও এক পশলা বৃষ্টি
সেবা আচার্য
সারাটাদিন রোদের প্রখরতা থাকলেও দুপুর তিনটে থেকে আকাশের কোলে পুঞ্জীভূত হচ্ছে কালো মেঘ। দেখতে দেখতে চারিদিক ঘন কালো আঁধারে ছেয়ে গেলো।পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা ঠাকুমা অন্নদা মুখে পান নিয়ে চিবোতে চিবোতে হাঁক দিয়ে বললো, "ও মেজ বউমা, ঘুমোলে নাকি? একবার উঠোনে এসো দেখি, কাপড় জামা গুলো সব ঘরে তোলো। আমি বড়ি দেওয়ার টিন গুলো সব টেনে তুলি।" এই বলে ঠাকুমা কোমরে হাত দিয়ে চললো বড়ি তুলতে। এবার গোয়ালঘরের দিকে চেয়ে আবার হাঁক দিয়ে ডাকলো, " ও ভূপেন, গোয়ালে গোরু গুলো ভালো করে বেঁধে রাখ বাবা, আর ধবলীর বাচ্চাটাকে ওর মায়ের খুঁটির সাথেই বেঁধে দে, জাবনা তে বেশী করে খাবার দিয়ে রাখ, আর জলের জায়গা গুলোতে জল ভরে দে।গোয়ালটা তেরপল দিয়ে ঘিরে দে। ভিতরে যেন জলের ছাঁট না আসে।"
"ঠিক আছে মা, করে দিচ্ছি।"বলেই ভূপেন হন হন করে চললো গোয়ালের দিকে।
"দীপা, ওদীপা, ঘরের সব জানালা গুলো বন্ধ করে দে তো দিদিভাই, যা মেঘ করেছে। একবার বিষ্টি নামলে কখন থামবে কে জানে?"
"ঠাম্মা, মা সব জানালা করে বন্ধ করে দিয়েছে গো।এবারে তুমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢোকো, ছোট কাকি হ্যারিকেন গুলো পরিষ্কার করে তোমার কোমরে পায়ে মালিশ করে দেবে বলে ডাকছে শীগগীর এসো।"
"যাই রে।কাঠ গুলো সব ভিজে গেলে আর জ্বলতে চাইবে না।তোর ছোটো কাকু কে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দে ত। কাঠগুলো সব তুলে রাখুক।"
"ছোটকা, ও ছোটকা, ঠাম্মি তোমাকে ডাকে।" মায়ের কথা শুনে ছোটো ছেলে উপেন হন্ত দন্ত হয়ে এসে হাজির হয়ে বললো, " বলো মা, ডাকছিলে আমাকে?"
"হ্যাঁ রে, শুকনো কাঠ গুলো, গোয়ালের পাশের ঘরে তুলে রাখ। জলে ভিজে গেলে আর জ্বলবে না।সুন্দর করে গুছিয়ে রাখিস কিন্তু।"
"হুম" বলেই অন্নদার ছোট ছেলে মায়ের আদেশ পালন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
অন্নদা তরফদারের তিন ছেলে, নৃপেন, ভূপেন, ও উপেন।স্বামী সহদেব তরফদার বহু বছর হলো স্বর্গত।তারপর থেকে অন্নদা দেবী নিজের ভাইদের সহযোগীতায় চাষবাস করা, স্বামীর ব্যবসা দেখাশোনা করা এমন কি, তিনটে ছেলেকে লেখা পড়া শিখিয়ে বড় করে তোলা, সব দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তিনি যেমন সাহসী, তেমনই বুদ্ধিমতী।এমনকি বলিষ্ঠ নারীও তাকে বলা চলে। তার ব্যক্তিত্বের কারণে, যাকে একবার যেই কাজের কথা বলেন, কেউই তার মুখের ওপরে না বলতে পারে না।বেশ ভালোই চলছিলো অন্নদা দেবীর ঘর গেরস্থলী। তবু তার একটা জায়গায় মন খুব খারাপ হয়ে যায় মাঝে মাঝেই।কথায় বলে না, প্রদীপের আলোতে ঘর আলোকিত হলেও প্রদীপের ঠিক নীচেই থাকে অন্ধকার।ঠিক সেই রকমই, বৃদ্ধা অন্নদাদেবীর বড় ছেলে নৃপেন ছোটো থেকেই একটু উন্নত নাসিকার। গ্রামে জন্ম, বেড়ে ওঠা সব হলেও, তার হাব ভাব অন্য রকম। আর্থিক স্বচ্ছল পরিবারের বড় সন্তান হওয়াতে তার প্রতি যত্ন ও ভালোবাসা ছিলো অপরিসীম।মাধ্যমিক পাশ করার পরেই তার বায়না হলো সে শহরে গিয়ে পড়াশোনা করতে চায়।যদিও মা এবং মামারা চেয়েছিলেন এবারে সে তার বাবার ব্যবসা সামলাক,কিন্তু নৃপেন স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিলো, "মুদি দোকানের ব্যবসা করার জন্য আমার জন্ম হয়নি বুঝেছো?আমি শহরে পড়াশোনা করে চাকরি করবো।গ্রামের জীবন আমাকে কিচ্ছু দিতে পারবে না।ওগুলো সামলানোর জন্য তো ভূপেন আর উপেন রইলোই।" বাধ্য হয়ে মা অন্নদাদেবী তার ইচ্ছে পূরণ করলেন। এদিকে মেজ ছেলে ভূপেন অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করে বাবার ব্যবসার হাল ধরলো।আর ছোট ভাই উপেন মাধ্যমিক পাশ করেই গ্রাম থেকে একটু দূরে একটা কোল্ড ড্রিংসের দোকানে ম্যানেজারের চাকরি পেলো।বৃদ্ধার আশা ছিলো বড় ছেলে প্রচুর পড়াশোনা করে বড় চাকরি পেলে তার সংসারের হাল ফিরবে। কিন্তু নাহ! সে আশা আর পূর্ণ হওয়ার নয়।কারণ, একদিন নৃপেন চিঠি লিখে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে আর কোনোদিন গ্রামে ফিরবে না, এমনকি তারা যেন কেউ ওর সাথে যোগাযোগ না করে।সে শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ে কে বিয়ে করে শ্বশুরের দেওয়া ফ্ল্যাটে গুছিয়ে সংসার করছে।গ্রাম থেকে কেউ যদি ওর ফ্ল্যাটে আসে, তাহলে ওর সম্মান হানি হবে।তাছাড়া, ওর বউ ও মেনে নিতে পারবে না। ভাইয়ের চিঠি পড়া শেষ হলে অন্নদা দেবী বললেন, "ঠিকই তো, শহরের সাথে কি গ্রামের জীবন ধারা যায়?" এভাবেই চলছিলো জীবন।এসব কথা ভাবতে ভাবতে তিনি যেন কোথায় হারিয়ে গেছিলেন, আচমকা ঝেঁপে বৃষ্টি এলো, ঘন্টা দুই তিন টানা বৃষ্টি চললো, উঠোনে জল জমে গেলো,চারিদিক অন্ধকার।
==============
সেবা আচার্য
মালদহ

Comments
Post a Comment