দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আলোচনায় নব দিগন্ত
রণেশ রায়
ভূমিকা
দর্শনের ইতিহাসে বস্তু ও চেতনার সম্পর্ক মানবচিন্তার গভীরতম প্রশ্ন। অধিবিদ্যা ভাবকে মুখ্য ধরে, বস্তুকে গৌণ বলে মনে করে। বিপরীতে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন—বস্তুই মুখ্য এবং চেতনা তার প্রতিবিম্ব।
মানুষ যখন প্রথম আলোর মুখ দেখেছিল, তখনই সে বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল—আমি কে, কোথা থেকে এলাম, আর এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে কিছু আছে কি? এই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নিয়েছিল দর্শনের দুই বিপরীত স্রোত—ভাববাদ আর বস্তুবাদ।
ভাববাদ বলেছিল—"ভাবই প্রথম," আর মার্কস বললেন—"না, বস্তুই প্রথম।" এই দুই প্রান্তের মাঝখানে আমি দেখি এক সেতুবন্ধন, যেখানে বস্তু, স্নায়ু ও চেতনা একে অপরকে গড়ে তোলে, আর তাদের এই ত্রিত্বের নৃত্যেই সৃষ্টি হয় জীবন ও কল্পনার জগৎ। ভাবববাদ এক সর্বশক্তিমান শক্তির কল্পনা করে যা এই বস্তুজগতের স্রষ্টা। আর এখান থেকে ধর্ম ও ধর্মীয় ভাবধারার সৃষ্টি।
আমার এই প্রবন্ধে আমি মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক আলোকে বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি দেখাবার চেষ্টা করবো কিভাবে ইন্দ্রিয় এবং স্নায়ুজগৎ বস্তু ও চেতনাকে সংযুক্ত করে এবং কল্পলোকের জন্ম দেয়।
আমার নিবেদন
আমার এই প্রবন্ধে আমি মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে নতুনভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। আমি দেখাতে চাই কিভাবে ইন্দ্রিয় ও স্নায়ুজগৎ মিলে বস্তু ও চেতনাকে সংযুক্ত করে, এবং সেই সংযোগ থেকেই কল্পলোক বা ভাবনার জগতের জন্ম হয়।
আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমেই আমাদের ইন্দ্রিয়-লব্ধ বস্তুজগৎ, মস্তিষ্কের স্নায়ু জগৎ এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
প্রকৃতি ও প্রাণের এই ভৌতজগৎ আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছার বাইরে নিজস্ব নিয়মে বিদ্যমান। আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় এই বস্তুজগতকে অনুভব করতে সাহায্য করে—আমরা দেখি, শুনি, স্বাদ পাই, গন্ধ নিই এবং স্পর্শ করি।
ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত এই অভিজ্ঞতাগুলি স্নায়ু জগতে সংকেতে পরিণত হয়। স্নায়ু জগতও একধরনের বাস্তব জগৎ—যদিও তাকে দেখা যায় না। বলা চলে, এটি এক সূক্ষ্ম পরমাণু জগত, যা জীবনের অন্তর্গত শক্তির উৎস।
ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্নায়ু জগতে প্রবেশ করে চেতনার জন্ম দেয়। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়জাত বস্তুজ্ঞানই চেতনার ভিত্তি। এই চেতনা মানুষকে ভাবতে শেখায়—কিভাবে বস্তুজগতকে পরিবর্তন করা যায়, কিভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব।
প্রকৃতিকে মেহনত ও মেধার মাধ্যমে কাজে লাগিয়েই মানুষ উৎপাদন করে; সেই উৎপাদনই পরিবর্তনের উৎস। মেধাও একপ্রকার শ্রম, যা স্নায়ু জগৎকে সক্রিয় রাখে। এই মেধাই চেতনার রূপ।
দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিকাশ: হেগেল থেকে মার্কস
দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের শিকড় নিহিত আছে ইউরোপীয় দর্শনের দীর্ঘ বিকাশধারায়। এর উৎস সন্ধান করতে হলে আমাদের যেতে হয় তিনজন মহান চিন্তাবিদের কাছে— হেগেল, ফয়েরবাখ ও মার্কস।
হেগেল: ভাবের দ্বন্দ্ব ও চেতনার যাত্রা
হেগেল প্রথম দ্বন্দ্বকে একটি সার্বজনীন নীতি হিসেবে দেখিয়েছিলেন। তাঁর মতে, বাস্তবতার বিকাশ ঘটে থিসিস–অ্যান্টিথিসিস–সিনথেসিস এই ধারায়— প্রতিটি ভাব বা অস্তিত্বের মধ্যে নিজস্ব বিরোধ থাকে, এবং সেই সংঘাত থেকেই জন্ম নেয় নতুন রূপ, উচ্চতর সত্য।
তবে হেগেল এই প্রক্রিয়াকে চেতনার বিকাশ হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর কাছে বাস্তব জগৎ ছিল ভাবের আত্মপ্রকাশ— এক "বিশ্ব–আত্মা" বা World Spirit ধাপে ধাপে নিজের চেতনা উপলব্ধি করছে। সুতরাং, হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্ব মূলত ভাববাদী দ্বন্দ্বতত্ত্ব।
ফয়েরবাখ: ভাব থেকে বস্তুতে প্রত্যাবর্তন
লুডভিগ ফয়েরবাখ হেগেলের ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে গিয়ে ঘোষণা করেন— "চেতনা নয়, বরং প্রকৃত মানুষই বাস্তব।"
তিনি মানুষের দেহ, ইন্দ্রিয় ও প্রকৃতিকে সত্য বাস্তবতা হিসেবে দেখেন। তাঁর মতে, ধর্ম বা ভাবজগৎ মানুষের বস্তুজ অভিজ্ঞতার প্রতিফলনমাত্র। ফলে তিনি দর্শনকে আবার বস্তুবাদ বলে ফিরিয়ে আনেন।
তবে ফয়েরবাখের বস্তুবাদ ছিল স্থির ও অপরিবর্তনশীল— প্রকৃতি ও সমাজের পরিবর্তনশীল সম্পর্ককে তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
মার্কস: জীবন্ত বস্তু ও পরিবর্তনের দর্শন
কার্ল মার্কস এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্বকে উল্টে দেন। তিনি বলেন— "দার্শনিকরা এখন পর্যন্ত পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু প্রয়োজন পৃথিবীকে পরিবর্তন করার।"
মার্কস হেগেলের দ্বন্দ্বের গতিশীলতা ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদী বাস্তবতা—এই দুইকে মিলিয়ে নতুন ভিত্তিতে দাঁড় করান দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ।
তাঁর মতে, বাস্তবতার বিকাশ কোনো ভাবগত নয়, বরং বস্তুজগতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকেই ঘটে। প্রকৃতি, সমাজ ও চিন্তা—সবক্ষেত্রেই এই দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল, এবং সেই সংঘাত থেকেই নতুন রূপ, নতুন সত্যের জন্ম হয়।
বস্তুজগৎ: বাস্তবতার ভিত্তি
বস্তু মানেই বাস্তব—যা আছে, যা রূপ নেয়, যা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। মানুষের দেহ, পৃথিবীর গঠন, পরমাণুর বিন্যাস—সবই এই বস্তুজগতের অঙ্গ।
ভৌত না হলেও অদৃশ্য কোনো স্তরও বস্তুজগতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেমন মস্তিষ্কের স্নায়ুজগৎ, যা দৃশ্য নয়, তবু কার্যকর। বস্তু কেবল দৃশ্যমান নয়—এর অন্তরে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য গতি, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার ছন্দে নড়ে সমগ্র প্রকৃতি।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আজ একধরণের যান্ত্রিক মার্ক্সবাদীরা মাৰ্ক্সের এই গতিশীল বিশ্লেষনে মস্তিস্কের ক্রিয়াশীল স্নায়ুজগতকে কার্যত অস্বীকার করে মার্ক্সবাদকে এক স্থবির তত্ত্ব বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ মার্ক্সবাদ পরিবর্তনশীল বলে প্রচার করে তার মৌলিক ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করেন।
এই অদৃশ্য বস্তুজগৎ—যেমন পরমাণু ও শক্তির জগৎ—অস্তিত্বের সেই সূক্ষ্মতম স্তর, যেখান থেকে স্নায়ুজগত ও চেতনার উন্মেষ ঘটে। দৃশ্যমান হলো প্রকাশ, অদৃশ্য হলো তার প্রাণ। একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি স্থবির হয়ে পড়ে।
দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান বস্তুজগৎ
আমরা সাধারণত বস্তুজগৎকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ হিসেবে দেখি—পর্বত, নদী, বৃক্ষ, প্রাণী —এগুলোই যেন বাস্তবতার পূর্ণ রূপ। কিন্তু বস্তুবাদ যখন গভীর স্তরে প্রবেশ করে, দেখা যায় বাস্তবতার এই দৃশ্যমান রূপের বাইরে রয়েছে এক অদৃশ্য শক্তিক্ষেত্র।
অদৃশ্যমান বস্তুজগৎ চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার প্রভাব সর্বত্র। এখানে রয়েছে পরমাণু, শক্তিকণিকা, এবং স্নায়ুজগতের সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক প্রবাহ। এই জগৎই দৃশ্যমান ও চেতনার জগতের মূল চালিকা শক্তি। যেমন পরমাণু না থাকলে বস্তুজগৎ গঠিতই হতো না, তেমনি স্নায়ুজগত না থাকলে চেতনা ও কল্পনা কখনও বিকশিত হতো না।
ইন্দ্রিয় ও স্নায়ু: বাস্তবতার অনুবাদক
স্নায়ুজগৎ বাস্তবে এক জৈবিক ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক। প্রতিটি স্নায়ু কোষ (neuron) বৈদ্যুতিক ইমপালসের মাধ্যমে সংকেত আদান-প্রদান করে, যা আমাদের অনুভূতি, স্মৃতি, চিন্তা, কল্পনা—সব কিছুর ভিত্তি।
দেখা গেল যে বস্তুজগৎ স্বাধীনভাবে বিদ্যমান। ইন্দ্রিয়লব্ধ ভৌত জগৎ ছাড়াও বস্তুজগতের অন্তর্ভুক্ত হলো মস্তিস্কের স্নায়ু জগতের সূক্ষ্ম কণা, শক্তি ও গতি, যা ভৌত জগতের মত পদার্থ ও জীবনের অন্যতম মৌলিক উপাদান। যাকে দেখা যায় না। পরমাণু ও তার থেকেও সূক্ষ অনুকণার মত। দেখা যায় না বলে তা বাস্তব নয় সেটা আজ আর বলা যায় না।
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো জানালার মতো—যার মধ্য দিয়ে আলো, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ ও স্পর্শ মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। কিন্তু জানালা কেবল পথ; অনুবাদক নয়। অনুবাদ ঘটে স্নায়ুজগতে—এক সূক্ষ্ম, রহস্যময় ও অদৃশ্য জগতে, যেখানে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ও রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া মিলে গড়ে তোলে অনুভব, চিন্তা ও স্মৃতি।
বস্তুজগৎ তার কণিকা পাঠায়, ইন্দ্রিয় তা গ্রহণ করে, আর স্নায়ু সেই কণিকাগুলোকে রূপ দেয় চিন্তার ভাষায়।
স্নায়ুজগৎ: অদৃশ্য কিন্তু বাস্তব
স্নায়ুজগৎ হলো মস্তিষ্কের সেই অদৃশ্য স্তর, যেখানে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত তথ্য বৈদ্যুতিক সংকেত হয়ে চিন্তা ও চেতনায় রূপান্তরিত হয়। এটি পরমাণুজগতের মতোই অদৃশ্য, কিন্তু শক্তিশালী ও কার্যকর; চেতনা, স্মৃতি, স্বপ্ন ও কল্পনার জন্ম এখানেই।
অর্থাৎ, স্নায়ুজগৎ এক ধরনের সূক্ষ্ম পরমাণু–জগৎ, যা চেতনার ভিত্তি তৈরি করে। ইন্দ্রিয় শুধুই তথ্য সংগ্রহ করে; স্নায়ুজগৎ সেই তথ্যকে চেতনায় অনূদিত করে, এবং পুনরায় বস্তুজগৎকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
চেতনা: স্নায়ু–বস্তু প্রতিক্রিয়ার ফল
চেতনা কোনো স্বতন্ত্র বা আকাশে ঝুলে থাকা ভাবজগত নয়। এটি জন্মায় স্নায়ু ও বস্তুজগৎ–এর পারস্পরিক ক্রিয়ায়।
ইন্দ্রিয় বস্তু গ্রহণ করে স্নায়ু জগতে সংকেত পাঠায়, মস্তিষ্কে তা চেতনায় অনূদিত হয়।
চেতনা আবার মানুষকে পথ দেখিয়ে বস্তুজগৎকে পরিচালিত করে —যেমন মানুষের কাজ, সৃষ্টি, শিল্পকর্ম বা শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করা যায়, সে নির্দেশ পাঠায় চেতনা। এটাই দ্বন্দ্বতত্ত্বের আসল বার্তা।
উপসংহার
বস্তুবাদ আজ কেবল দর্শন নয়, এ এক জীবনের ছন্দ—যেখানে প্রতিটি মানুষ তার চিন্তা, অনুভব ও কর্মের মাধ্যমে। বস্তু, স্নায়ু ও চেতনার সংযোগ রচনা করে।
বস্তু আমাদের মাটির টান, স্নায়ু আমাদের অন্তর্জগতের কম্পন, আর চেতনা সেই কম্পনের আলো— যা জীবনের অন্ধকারেও দীপ্তি ছড়ায়।
এই ত্রিত্বের মিলনেই মানুষ হয়ে ওঠে এক বাস্তব ও কল্পনাময় সত্তা—যে যেমন দেখে, তেমনি সৃষ্টি করে।

Comments
Post a Comment