সৈকত প্রসাদ রায়
রানাঘাট শহরের প্রান্তে ছোট্ট এক পাড়া বিশ্বাসপাড়া। সেই পাড়ার পুরোনো ভাঙাচোরা বাড়িটায় থাকেন পুষ্পরাণী ভট্টাচার্য— বয়স পঁয়ষট্টির কোঠায়। সবাই তাকে "পুষ্পদি" বলেই চেনে। একসময় প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, এখন অবসর নিয়েছেন।
প্রতিদিন বিকেলে পুষ্পদি বারান্দায় বসে চা খান। ছোট একটা টেবিল, কয়েকটা পুরোনো বই, আর একখানা নীল কাঁচের ফুলদানি — তার নিত্যসঙ্গী। বারান্দার সামনেই একটা গলি, যেখান দিয়ে প্রতিদিনই স্কুল ছুটির পরে বাচ্চারা হইচই করে ছুটে যায়।
পুষ্পদির একমাত্র ছেলে অনিরুদ্ধ — কলকাতায় চাকরি করে। ছেলেটা আধুনিক, নিজের সংসার আছে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। বছরে হয়তো একবার আসে, তাও কিছুক্ষণ বসে আবার চলে যায়। পুষ্পদি মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু বুকের ভেতরে একটা কষ্ট জমে থাকে।
সেই বিকেলটা অন্যরকম ছিল।
আকাশে ধুলো, গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। হঠাৎ পুষ্পদির চোখে পড়ে — রাস্তায় এক কিশোর বসে আছে। বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়। মলিন জামা, পায়ে ছেঁড়া চটি। ছেলেটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পুষ্পদির বাড়ির গেটে ঝুলে থাকা পুরোনো নোটিশবোর্ডটার দিকে, যেখানে একসময় লেখা ছিল —
"পুষ্পরাণী ভট্টাচার্য — শিক্ষিকা (বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি)।"
পুষ্পদি মৃদু স্বরে ডেকে উঠলেন,
— "ওরে কী দেখছিস?"
ছেলেটা চমকে তাকালো।
— "কিছু না ঠাকুমা... আমি ভাবছিলাম, আপনি কি এখনো পড়ান?"
— "না রে, এখন বয়স হয়েছে, চোখও ঠিকমতো দেখে না। কেন?"
ছেলেটা একটু ইতস্তত করে বলল,
— "আমি পড়তে চাই, কিন্তু এখন স্কুলে যাওয়া হয় না।"
— "কেন রে?"
— "বাবা কাজ খুঁজতে গিয়েছিলেন, ফিরে আসেননি। মা লোকের বাড়ি কাজ করে। বইয়ের খরচ জোটে না, তাই স্কুল ছাড়তে হয়েছে।"
পুষ্পদির বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। কিছু না বলে তিনি ভেতর থেকে এক গ্লাস জল আর বিস্কুট এনে দিলেন। ছেলেটা মাথা নিচু করে খেতে লাগল।
খাওয়া শেষে পুষ্পদি বললেন,
— "তোর নাম কী?"
— "রাজু।"
— "পড়তে ইচ্ছে করে?"
— "খুব। কিন্তু এখন দোকানে কাজ করি। বিকেলে সময় পাই।"
পুষ্পদি চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন,
— "বিকেলে তুই আসবি? আমি একটু করে পড়াব।"
রাজু চোখ তুলে তাকালো, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
— "সত্যি ঠাকুমা? আপনি পড়াবেন?"
— "হ্যাঁ রে, আমি তো একসময় শিক্ষিকা ছিলাম।"
ছেলেটার মুখে ফুটে উঠল এমন এক হাসি, যা বহুদিন পর পুষ্পদির মনেও আলো ছড়িয়ে দিল।
পরদিন বিকেলে রাজু এলো।
পুরোনো টেবিলে পুষ্পদি সাজিয়ে রেখেছিলেন খাতা, পেন্সিল, আর একটা ছোট ব্ল্যাকবোর্ড। রাজু বসে পড়ল আগ্রহ নিয়ে।
প্রথম দিন থেকেই দেখা গেল — ছেলেটার মাথা বেশ তুখোড়। অঙ্কে ভালো, লিখতেও পছন্দ করে। পুষ্পদি তার হাতে একটা পুরোনো বই তুলে দিলেন |
বিকেলের সেই ঘরটা আবার যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। পুষ্পদি খাতা দেখে খুশি হতেন, আর রাজু প্রতিদিন নতুন কিছু শিখে বাড়ি ফিরত।
দিন কেটে গেল, মাস পেরোল। রাজু নিয়মিত আসতে লাগল। মাঝে মাঝে পুষ্পদির চোখে জল আসত — এতদিন পরে যেন আবার জীবনের অর্থ খুঁজে পেলেন।
একদিন সন্ধেয় দরজায় টোকার শব্দ।
দেখেন, রাজুর মা দাঁড়িয়ে আছেন — ক্লান্ত,
— "আপনি পুষ্পদি?"
— "হ্যাঁ মা, বলো।"
— "রাজু বলে আপনি ওকে পড়ান। ও কাজ ছেড়ে দিয়েছে। দোকানের মালিক এসে ঝামেলা করছে। বলছে ছেলেটা আর কাজে যাবে না বলে দোকান থেকে কিছু চুরি করেছে।"
পুষ্পদি হতভম্ব। রাজু তো এমন ছেলেই নয়!
তিনি রাজুকে ডেকে পাঠালেন। ছেলেটা এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
— "চুরি করেছিস?"
রাজু ফুঁপিয়ে উঠল,
— "না ঠাকুমা, আমি করিনি। দোকানদার বলছিল, আমি যদি তার বাড়িতে কাজ করি, তাহলে টাকাটা বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে যা বলেছিল... আমি তাতে রাজি হইনি।"
পুষ্পদির চোখে জল চলে এলো।
রাজুর মা ভেবে বসেছিলেন হয়তো ছেলেটা দোষী, কিন্তু পুষ্পদি জানলেন — ছেলেটা নিজের সম্মানের জন্য অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ায়নি।
পুষ্পদি পরদিন দোকানে গিয়ে লোকটার মুখোমুখি হলেন। গলায় দৃঢ়তা এনে বললেন,
— "আপনি একটা বাচ্চার সম্মান নিয়ে খেলতে চাইছেন? এ পাড়ায় আমি আজও মানি, শিক্ষা মানে শুধু বই নয় — মানুষ হওয়াও শেখানো।"
দোকানদার চুপ করে রইল।
সেদিনই রাজুর মা সিদ্ধান্ত নিলেন, যত কষ্টই হোক, ছেলেকে আবার স্কুলে ভর্তি করবেন।
সময় কেটে গেল আরও এক বছর।
রাজু এখন নবম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলে ভালো ফল করছে, পাড়ার সবাই তাকে চেনে।
একদিন বিকেলে পুষ্পদি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জ্বর এসেছে, একা কেউ নেই। খবর পেয়ে রাজু ছুটে এল।
— "ঠাকুমা, আপনি কিছু খাননি কেন?"
— "খিদে নেই রে, শরীরটা ভারী লাগছে।"
রাজু চুপচাপ রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাল, ওষুধ দিল। তারপর বলল,
— "আপনি না থাকলে আমি আজও অন্ধকারে থাকতাম ঠাকুমা। আপনি বলেছিলেন, শিক্ষা মানে আলো — আমি এখন বুঝি।"
পুষ্পদি দুর্বল হাসলেন,
— "তুইই তো আমার আলো রে রাজু।"
সেদিন সন্ধ্যার সূর্য যখন জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকল, বারান্দার মেঝেতে সেই আলোয় ঝলমল করছিল রাজুর খাতা — তাতে বড় হরফে লেখা ছিল:
"আমার আদর্শ — আমার শিক্ষিকা ঠাকুমা।"
দু'বছর পর পুষ্পদি মারা গেলেন নিঃশব্দে।
তাঁর মৃত্যুর দিন বিকেলে রাজু এসে তাঁর প্রিয় টেবিলের ওপর একটি খাম রাখল।
ভিতরে রাখা একটা ছোট কাগজে লেখা ছিল —
"তুমি আমাকে মানুষ হতে শিখিয়েছিলে, ঠাকুমা। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তোমার মতোই আমি অন্যদের শেখাব।"
বছর কয়েক পর রাজু নিজেই শিক্ষক হল।
রানাঘাটের এক ছোট স্কুলে এখন সে বাচ্চাদের পড়ায়। এছাড়া দুঃস্থ অসহায় বাচ্চাদের জন্য নিজেই নিজের বাড়িতে একটি নাইট স্কুল খুলেছে।
স্কুলের দরজার পাশে একটা ফলক টাঙানো —
"পুষ্পরাণী ভট্টাচার্য স্মৃতি কেন্দ্র" তার নিচে লেখা,
"শিক্ষা মানে শুধু বই নয় — মানুষের ভিতর আলো জ্বালানো।"
রাজু প্রতিদিন বিকেলে যখন ক্লাস নেয়, তার চোখে পড়ে জানালা দিয়ে ছায়া মেখে থাকা সূর্যটা — সেই শেষ বিকেলের আলো, যা একবার তার জীবনে আলো ফেলেছিল এক দয়াময়ী শিক্ষিকার হাত ধরে।
--------------------
সৈকত প্রসাদ রায়,
রানাঘাট, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।
রানাঘাট, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।

This comment has been removed by the author.
ReplyDelete