পুজো..
ঋতুপর্ণা ঘোষ
রোজ ভোর চারটে নাগাদ ঘুম ভেঙে যায় অ্যালার্ম ছাড়াই অফিসের জন্য। চেষ্টা করেও পারিনা আর নিজেকে ঘুম পাড়াতে। উঠে বসি। আজও ওই একই সময়ে ঘুম ভাঙলো ঢাকের শব্দে,বাইরেটা অন্ধকার। বাইরের বারান্দায় হাঁটি। গাড়ির আওয়াজ এই ভোরবেলাতেও। ঠাকুর দেখার হিড়িক।পাঁচ দিনে দশ দিক দেখে ফেলতে হবে। পুজো পরিক্রমা। থিম কালচার। নতুন জুতো।
নতুন জুতোর ফোস্কা জেগে থাকবে ব্যাথা হয়ে।পাশে প্রিয় সঙ্গী। একই কথা।তবুও প্রিয়।
পুজো আসছে আসছেই ভাল।সবেরই আরম্ভ ভাল।ফাঁকা মণ্ডপের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয় মণ্ডপের ত্রিপল লাগানো,গোল চেয়ার বৈঠক!
আলোর মালা ঝুলছে। আকাশের রং গোলাপি, নীল মিশে অদ্ভুত। শিফন শাড়ির মতন। লোডশেডিং জামা। বাই কালারের দুপাট্টা।আকাশের কিছুটা রং ধার করে নিজের গায়ে লাগিয়ে নিলাম ভোর ভোর। তিনটে পাখি উড়ে গেল গায়ে গা লাগিয়ে। বাবা,মা,বন্ধু,প্রেমিক,প্রেমিকা?বাড়িতে পায়রা প্রচুর।ভোরবেলায় এদের খুব আনন্দ ,শব্দে ভয়,আওয়াজ হলেই উড়ে যায়। একটা আরেকটাকে বিরক্ত করছে। ঠুক করে ঠোঁট বসালো গায়ে। উড়ে গেল সে অন্য দেওয়ালে।আলোর মালাগুলো বড্ড প্রিয়। একদম ছোট ছোট আলো। ফুলের মতন ফুটে আছে যেন। আমার সুক্ষ্ম জিনিস খুব ভালো লাগে।সেনসিটিভ বলেই বোধয় । ছোট্ট কারুকাজ। শাড়ীর,মনের। আলতো,মায়া মায়া। কথা দিয়ে কথা ছুঁয়ে যায়। আকাশ গোলাপি রং কাটিয়ে আলো ছড়ায়।
সকালে ঠিক তিরিশ মিনিট হাঁটব। ততক্ষণে শিউলি ঝরে পড়বে টুপ।মায়ের বানানো সাদা ফ্রকের গন্ধ, যত্ন করে রেখে দিয়েছে।আমার মেয়ে হলে ওকে দেবে..
টেপ ফ্রকে করে কুড়িয়ে নেব সব। ঘুম থেকে উঠেই বাবাকে জড়িয়ে ধরব দুই হাতে।বাবার আদুরে হলে যা হয় প্রশ্রয় পাই খুব।
আমার কোনো ভাই বোন নেই। থাকলে নির্ঘাত হিংসায় মরতাম।অন্তত ওই বয়সে মনে হত। সব বয়সে সব মনে হয়না।
আমাদের গানের দল, নাচের দল,গল্পের দল।আমরাও গোল হয়ে বসতাম।পুজোর প্রোগ্র্যাম।রিহার্সাল দিতাম। টুকটাক মন কষাকষি হত। বৃত্ত ছোট হতে হতে অসম্পূর্ণ হয়ে গেল। সুতো জড়ালাম আঙুলে। "মোহ মোহ কে ধাগে"
এখন আড়াল ভাল লাগে। সারা পুজো বিশ্রাম।রোজের ওই একই ন 'টা পাঁচ' টা'র রুটিন ভালো লাগেনা।কোনো আনন্দ নেই ।পুজোতে বাড়ি,নিজের ঘর ,মা বাবি প্রিয় আশ্রয় ।
ঘর মানে অনেক কিছু। ঘর মানে আপাদমস্তক ঘিরে থাকা সেই সময়,কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠার অধ্যায় । দক্ষিণের বারান্দার মতোই সেই আবেশ। সুখ। এই নিজের ঘর,নিজের বইপত্র, সেকালের ডেস্কটপ টেবল। পেলমেট আর তার থেকে ঝোলানো গোলাপী ফুলেল পর্দা।
ঘর মানেই কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠা মেয়ের ক্রমশ দুনিয়া দ্যাখা।ছুঁয়ে থাকা গল্পরা। দোতলার এদিক ওদিক পায়চারি।কানের কাছে সারারাত রেডিও। মফস্বল ঘুমিয়ে পড়েছে তখন। পাগলের মতো গান শোনার রাত। নিজের হাতে গুছিয়ে,সাজিয়ে,প্রাণে ধরে রাখা নিজের ঘর।বাড়ির মধ্যে একটা গোটা জীবন ঢুকে থাকে। এঘর , ওঘর, গলার স্বর। মায়া আর মায়া। সেসব এক জীবনেই পুড়ে যাবে? অসম্ভব!
পুজোতে নিজের সব ভালোলাগাগুলোকে জড়িয়ে রাখবো।বই পড়বো,একা চুপচাপ।এরপর হেমন্তকাল আসবে ।হেমন্তকাল আসলে অস্থায়ী।খুব অল্প দিনের।অস্তিত্ব আর অনুভূতির জন্য আরামদায়ক কিছুদিন।যতটা আরাম হয় প্রথম চিঠি অথবা প্রেমে।অল্পক্ষণ।তারপর উধাও হয়ে যায়।কর্কশ শীত এসে পড়ে।ঠান্ডা,নিথর হয়ে যায় চারপাশ এমনকি আত্মার ভিতর অব্দি।গোলাপি,ঠান্ডা মাংস।তার চেয়ে ঢের ভাল হেমন্তের হালকা হিম।ভায়োলিনের ব্যথা যেন।বিষাদ বাড়িয়ে দেবে।হালকা দীর্ঘ বিষাদ।মনে রাখা কবিতার কিছু অংশ।পুরোটা নয়। সম্পূর্ণ কবিতা মনে থাকেনা।বরং কিছু শব্দ,কিছুটা রেশ,ঘোরের মতো..
ঢাক ঢোল পিটিয়ে আড়ম্বর হয়। প্রকৃত অর্থে পুজো হয় না। পুজো কুসংস্কার নয়। সংস্কার। সকলের হিতার্থে। এই যে ব্রত, মা ঠাকুমা দিদিমার সকলের মাথায় ফুল ছুঁইয়ে দেওয়া,প্রদীপের তাপ দিয়ে আরোগ্য কামনা,সবই তো সংসারের মঙ্গল চেয়ে। ভালোবাসা মানেও তাই।
যা যা আঘাত মুছে যাবে,কিছু মনে রাখতে নেই। সঞ্চয় হোক ভাল কিছুর। পুজোর গন্ধ যেমন হয়। মায়ের মুখের দিকে তাকালে ত্রিনয়ন,একশো আট প্রদীপ, মাথার ওপরে দেওয়া ফুল। যদি ভালবাসতে হয়,সেভাবেই বাসা ভালো। নয়ত ওই আড়ম্বর দেখিয়ে লাভ নেই। ভালোবাসা খানিক স্বার্থপরও,সে সবই দেবে,কিন্তু নিজের অভিমান বজায় রেখে। যেদিন সে দেখবে,সে বড্ড দূরে, বড্ড পেছনে,সে নিজেই চলে যাবে মুখ নিচু করে। তবু কালিমা মাখবে না। কিছুতেই না।
এই পাঁচদিন ভোর ভোর ঢাক বাজে। আমার চোখে ঘুম ঘুম। তাও জাগি। তাও জাগি। তাও জাগি।
আজ বড্ড পুজো পুজো গন্ধ। খুব পাচ্ছি। নাক টানছি। এইসময় সব খারাপ লাগাগুলো মাঝে মাঝে চলে যায়। ফুলো ফুলো মেঘ উঠবে আকাশ জুড়ে। খিলখিল হাসব। বইয়ের গন্ধ। পড়ি না পড়ি, কেনা চাই। একটুও অপেক্ষা নেই। সব বাড়ি বয়ে আনতে হবে। টেবিলে থাকবে। খুললেই শেষ ভেবে কিপটের মত দেখব। যত্নে হাত বুলিয়ে দেব। ঝুপ করে চারপাশে আলো হয়ে যাবে। দোকানে সার সার বই। জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছি শিকারী বেড়ালের মত। বাবার কানে বলব চুপিচুপি। বাবা সব শোনে। চাইলেই দেবে। মাকে ম্যানেজ করতে হয়। অঙ্ক করাবে ঘাড় ধরে। পুজোয় জামা গুনব। একটা ডান্সিং ফ্রক হবেই হবে। গোলাপি রঙের। সাদা মোজা। আমি কি বড় হয়ে যাচ্ছি? সাইকেলে করে যাওয়া ছেলেটা ভ্যাবলার মত তাকাল। কীরকম ভ্যাবলা যেন!
পুজোর কদিন ঢাক বাজবে। খিচুড়ি ভোগের গন্ধটা..কী সুন্দর জমাট হয়ে থাকে। ঝোল ঝোল নয়। মালসায় দেবে। মাটির গন্ধের কী অপূর্ব স্বাদ! মনে হয় গন্ধ মেখে খাই। এখন সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে সবার। ট্রেন দুর্ঘটনা নেই, একটা মেয়ের মরে যাওয়া নেই, কোনো খারাপ কিছু নেই। সব ভালো বলে পুজো হবে। আমিও তো তাই চাই। ধুনুচি নাচতে, পঞ্চ প্রদীপ সাজাতে। ঘামে ভিজে গেছে অমুক ছেলেটার পাঞ্জাবি। হাতের কাছে গুটিয়ে রাখা। তাও নাচছে। আমি একদৃষ্টিতে দেখছি। সবাই দেখছে। মা দুর্গাও দেখছে।
পুজো এলেই ছাতিমের গন্ধ পাব। সব ওলটপালট হবে। পুরোটা ঢুকে যাবে বুদবুদের ভেতর। দাদাই ,দিদুন কোথায় গেল? ধড়মড় করে উঠে বসব। আমার পাঁচ টাকা চাই। বাবি দেবে। আমার ব্যাগে টাকা আছে কিন্তু ওই পাঁচ টাকা আলাদা। অন্যরকম। আমার আবদার। ভালোবেসে দেয়। আমাদের ভালোবাসা। ছিটের ফ্রক কী ডিটেল মেনে বানিয়ে দিত মা ছোটবেলায় ।
প্রতিদিনের জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচার লোভ সংবরণ করার ক্ষমতা আমাদের বাবা মেয়ে কারো নেই। একটা বেলার অবকাশে দুজনেই চলে গেলাম রামকৃষ্ণ মিশন,বাবার স্কুল । আনন্দের স্বাদ নিজেরাই চেটেপুটে গ্রহণ করব বলে সঙ্গে কাউকেই নিলাম না। অনেক দিন পর গেলাম। মঠের ভিতর আর বাইরের জগৎ আলাদা মনে হয় আমার।আশ্রমের
ভিতরে ঢুকলেই অনাবিল আনন্দে মন ভরে ওঠে। গাইতে শুরু করলাম একের পর এক গান । "কী হলো না কী পেলে না, সে সকলই মরীচিকা মিলাইবে পিছে" অনুধাবন করতে আর পারি কই? আবহাওয়া ছিল অন্যরকম। আকাশের ক্যানভাসে আলাদা আলাদা রঙের শেড। আজ দাদুর মৃত্যুবার্ষিকী ,আজ মহাষ্টমী..
'দূরের মানুষ' এর সেই অমৃত গন্ধ ঢালা 'গোপন মিলন' অনুভব করছিলাম যেন। ছোটবেলার বেলুড় মঠের সন্ধ্যারতির কথা, আরতির মধ্যে আমার স্মৃতির পাতা উল্টে দেখলাম। পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম তানপুরার সঙ্গে যখন বেজে উঠেছে ধ্রুপদ -
'খন্ডন ভব বন্ধন, জগবন্দন বন্দি তোমায়' - মনে পড়ছিল সেই প্রার্থনার কথা। 'আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন'।
উৎসবে হাসিই ভাল। উৎসবের টিপ লাল রঙের। আমি কালো পরি। অত মানি না। অত পারি না। বাইরের দেখানো ভাল নয়, ভিতর থেকে ভাল থাকলেই ভালো । মনের ঘরদোর ঝুল ঝেড়ে,ঝাঁট দিয়ে, মুছে, আলপনা আঁকি ভালোবাসার। যা যাবার তা যায়, যা আসার তা আসে। ঢাকের বাদ্যি,সেই ছোট্ট ছেলেটা সেও জানে, পুজোর পর নতুন জামা হবে। এখন না হয় পুরোনোটাই..ক্যান্সার পেশেন্ট মানুষটি ভাবেন, দেখে নি এবার ভাল করে মাকে। পরের বার যদি..
পুজো সকলের। আনন্দ সকলের। বাঁচার অধিকার সকলের।
মহা ধুমধাম, উল্লাস দিয়ে পুজো হয় না। আড়ম্বর হয়।
ভালোবাসা...
==============
ঋতুপর্ণা ঘোষ
চেলিডাঙ্গা
আসানসোল :৭১৩৩০৪
জেলা :পশ্চিম বর্ধমান
Comments
Post a Comment