রাক্ষস
নবনীতা বোস
অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে পা রাখতেই অনির্বাণের কপাল কুঁচকে এলো এক অসহ্য যন্ত্রণায়। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামার উপক্রম—চারপাশ তখন থমথমে, ধূসর। কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিরক্তি জমা হচ্ছিল তার পাশে জড়ো হওয়া ভিড় আর ধস্তাধস্তিতে। মানুষগুলো যেন সবাই আজ কিছু একটা ছিনিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে এক ধরণের আদিম হিংস্রতা।
আসলে, আজ বিকেল থেকেই একটি চাপা, তীক্ষ্ণ অস্বস্তি কাজ করছিলো তার মনের গভীরে। তার মনে হচ্ছিলো, যেন কোনো অদৃশ্য কাঁটা সারাক্ষণ বুকের ভেতরে বিঁধে আছে, তীব্র মানসিক যন্ত্রণা হয়ে। রোজকার এই চেনা ভিড়ভাট্টায় ভরা শহর হঠাৎ করেই তার চোখে কেমন অসহ্য, বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। প্রতিটি মানুষের হাঁটাচলা, প্রতিটি কথা, এমনকি প্রতিটি নিঃশ্বাস—সবই তার কাছে অতিরিক্ত, আক্রমণাত্মক মনে হচ্ছে। এই অসহ্য মনস্তাত্ত্বিক চাপই হয়তো তার বাস্তব উপলব্ধির গতিপথ বদলে দিচ্ছিল।
বাসস্টপে অপেক্ষার সময়ও সে টের পেলো সেই একই ক্ষুধার্ত অস্থিরতা। বাস আসতেই শুরু হলো আচমকা ধাক্কাধাক্কি, এক অসভ্য হুড়োহুড়ি। অনির্বাণ কোনোমতে ফাঁকা একটি জায়গায় দাঁড়াল। বাসের ভেতরে ভিড় তখনো অসহনীয়, কিন্তু ভেতরে চোখ যেতেই তার সারা শরীর হিম হয়ে গেলো। ভিড়ে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা প্রতিটি মানুষের চোখেই যেন একধরণের চাপা, পৈশাচিক ক্ষুধা। তার মনে হতে লাগল, এই লোকগুলো যেন মানুষের খোলস পরা কোনো প্রাণী, যারা সামান্যতম সুযোগ পেলেই পরস্পরকে আক্রমণ করে নিজেদের ক্ষুধা মেটাবে।
ইতিমধ্যেই কোনো এক অজানা কারণে অনির্বাণের চোখে সবকিছু বিকৃত হতে শুরু করেছে। সে অনুভব করছে, তার দৃষ্টি যেন অন্ধকারের গভীরে দেখতে পাচ্ছে, যেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র পাপ তাদের বিকৃত চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে।
তার সামনেই, জনৈক ব্যক্তি প্রচণ্ড শব্দ করে চিপস চিবোচ্ছিল। সেই শব্দ অনির্বাণের কানে আসছে হাড় মটকে যাওয়ার মতো। অনির্বাণের চোখে সেই দৃশ্য পাল্টে গেলো—লোকটি যেন তার চোয়াল অস্বাভাবিকভাবে প্রসারিত করে কাঁচা মাংসের টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। তার মুখভঙ্গিতে তখন এক আদিম, লোলুপ তৃপ্তি। পরক্ষণেই, একটি মহিলা তার শিশুকে চিৎকার করে ধমকাচ্ছিল। অনির্বাণ দেখল, মহিলার দাঁতগুলি সূঁচালো হয়ে উঠেছে, তার মুখ থেকে হিংস্র, অমানুষিক শব্দ যেন গোঙানির মতো বেরিয়ে আসছে। এই দৃশ্য দেখে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
কিন্তু এই সবকে ছাপিয়ে তার চোখ গেলো বাসের একেবারে একটি লেডিস সিটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোকের দিকে। লোকটি এখন একটি মহিলার গা ঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে, তাদের মধ্যে কোনো দূরত্বই আর অবশিষ্ট নেই। লোকটির দৃষ্টি সেই মহিলার দেহের বিশেষ একটি অংশে স্থির।
হঠাৎ করেই অনির্বাণের দৃশ্যপটে সবকিছু চূড়ান্তভাবে পরিবর্তন হয়ে ভেসে উঠলো। সেই লোকটি যেন নিজের নখযুক্ত, লম্বা আঙ্গুলগুলো দিয়ে ওই মহিলার দেহাংশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, আর মহিলাটি এক অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। সেই পৈশাচিক দৃশ্য দেখে অনির্বাণের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একবার ইচ্ছা হলো প্রতিবাদ করার, এই অসভ্যতা দেখে রুখে দাঁড়ানোর। কিন্তু পরক্ষণেই তার পুরোনো অভ্যাস তাকে টেনে ধরল। আজ অবধি কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে সে শেখেনি। নীরবতা এবং উপেক্ষা—এটাই ছিল তার সমাজের প্রতি সহজাত প্রতিক্রিয়া।
তাই, সেই বিভৎস দৃশ্য এবং মানসিক বিতৃষ্ণা হজম করে সে ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালো। কিন্তু তার মস্তিষ্কের ভেতরে তখন সেই মাংস ছিঁড়ে খাবার শব্দ আর বিকৃত মুখের প্রতিচ্ছবি যেন চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে গেলো। সে বুঝতে পারছিল না—বাস্তবে কী ঘটছে, আর তার মন কোন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরেই একজন বৃদ্ধা বসার একটি জায়গা খুঁজছিলেন। সারাদিনের ক্লান্তি যেন ছায়ার মতো বাসা বেঁধেছে তার কুঁচকানো মুখের সর্বত্র। হাতে ভরসার লাঠি, কিন্তু জীর্ণ দেহকে সোজা করে দাঁড়াতেও তিনি যেন অক্ষম। অথচ এই জনবহুল বাসে কেউই তাকে তার একচিলতে জায়গাটুকু ছেড়ে দিতে রাজি নয়।
ঠিক সেই সময়ে একটি স্থান খালি হতেই বৃদ্ধা নিজের লাঠিতে ভর দিয়ে, যতটা সম্ভব ভিড় ঠেলে এগোলেন। কিন্তু না, শেষ রক্ষা আর হলো না। তাকে বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে সেই জায়গাটা দখল করে বসলো কলেজ-পড়ুয়া দুজন মেয়ে। একজন নিজে বসে, তার কোলের ওপরে আরেকজনের জন্য জায়গা করে দিলো—যেন স্নেহের আবরণে মোড়া এক নিষ্ঠুরতা।
অনির্বাণ বিস্ময়ে দেখলো, যে প্রজন্ম একজন বৃদ্ধার ভার নিতে অক্ষম, তারা কিনা ভালোবেসে তারই অতীব সক্ষম বন্ধুকে জায়গা করে দেওয়ার মতো "মহৎ" মন রাখে! ব্যাপারটা দেখে তার ভেতরে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো। কিন্তু না, তার অভ্যস্ত নীরবতা যেন গলা চেপে ধরল। অন্যের বিষয়ে নাক না গলানোর চিরাচরিত অভ্যাস তাকে আবারও নীরব দর্শক করে রাখল।
ঠিক তখনি, অনির্বাণের চোখে দৃশ্যপট ভয়াবহভাবে পাল্টে গেলো। চোখের পলকে সেই দুই মেয়ে পরিণত হলো দুই পিশাচিনিতে। তাদের সুন্দর মুখ এখন বিকৃত, চোখের তারা টকটকে লাল, আর ঠোঁটের কোণ থেকে বেরিয়ে এসেছে হিংস্র দুটি শ্বদন্ত। তারা নিজেদের নখযুক্ত, লম্বা হস্ত প্রসারিত করে বৃদ্ধাকে প্রায় টেনে আনল তাদের কাছে। পরমুহূর্তে, লোলুপতা নিয়ে সেই দাঁত দুটি বৃদ্ধার গলায় বসিয়ে দিলো। পিশাচিনিরা যেন তৃপ্তিভরে তার রক্ত শুষতে শুরু করলো। অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে চাইলেও, বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলো।
অনির্বাণের স্নায়ুতন্ত্রের প্রতিটি তন্তু যেন আর্তনাদ করছে। সে ভাবল, "আমি কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছি? আমার মনের ভেতরে কি কেউ খেলা করছে?" তার মনে হচ্ছিল, এই যন্ত্রণা কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে যেন অসহ্য, চাপা গুঞ্জন তৈরি হচ্ছে—এক ধরণের নীরব, তীব্র আর্তনাদ, যা একমাত্র সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। তার মন যেন ভেঙে পড়ছে, ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে তাকে এক অন্ধকার মানসিক অবসাদের দিকে।
তার চোখ চারদিকে ঘুরল। হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা রাক্ষসের দল—তারা যেন ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছে তাকে। তাদের ক্ষুধা কেবল রক্ত বা মাংসের নয়, তাদের ক্ষুধা যেন তার শেষ অবশিষ্ট মনুষ্যত্বের ওপর।
সে দরজার কাছে ভিড় ঠেলে কোনোমতে দাঁড়ায়। বাসটি তার গন্তব্যের কাছে থামে। বাস থেকে নেমে সে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। আজকের দিনটা যেন তার কাছে একটা অলৌকিক দুঃস্বপ্ন। সে দ্রুত পা চালাল নিজের বাড়ির দিকে। বিশাল বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। পুরানো হলদেটে আলোয় মোড়া সিঁড়ি বেয়ে ক্লান্ত দেহে কোনোক্রমে উঠে গেলো সে। হঠাৎ তার সামনের ঘর থেকে বাড়ির মালিক সদাশিববাবুকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসেই, তার সাথে চোখাচোখি হতেই সদাশিববাবুও থমকে দাঁড়ালেন।
তার চোখে-মুখে এই মুহূর্তে ফুটে উঠেছে এক প্রচণ্ড, তীব্র ভয়—যার কারণ যদিও অনির্বাণের জানা নেই। তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে মৃদু, কাঁপা কণ্ঠে বললেন, "এই ফিরলেন বুঝি। খুব ক্লান্ত, না? যান, ঘরে যান।"
বেশ আশ্চর্য হয়ে কোনো উত্তর না দিয়েই অনির্বাণ নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল এবং দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিল। তাড়াতাড়ি সে সোজা গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে।
কিন্তু একি? বাসের সেই আতঙ্কটা আবার বহুগুণ হয়ে ফিরে আসে তার মনে। এ কার মুখ দেখছে সে আয়নায়! এতো সে নয়! তার ফর্সা, সৌম্য মুখটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে; তার জায়গায় ফুটে উঠেছে এক বীভৎস, লোমশ রাক্ষসের মুখ। চোখ দুটো লালচে, আর ঠোঁটের কোণে যেন তীক্ষ্ণ শ্বদন্তের সূচনা হয়েছে।
এইবার তার সন্দেহটা ফিরে আসে। তাহলে কি এই জন্যই সদাশিববাবু ওভাবে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে? তাহলে বাসস্টপ থেকে বাড়ি পর্যন্ত না জানি কতজন আমার এই মুখটা দেখে নিয়েছে!
প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেলো অনির্বাণ। সে দ্রুত ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গিয়ে বসলো আলমারির পাশের অন্ধকার কোণায়। মনে পড়ে গেলো তার—ওই বাসের সেই নির্যাতিতা মহিলার কথা, সেই অসহায় বৃদ্ধার কথা। যার জন্য কিছুই করা হয়ে উঠলো না তার।
অনির্বাণ বুঝতে পারল, রাক্ষস বাইরে থেকে আসেনি। মানুষের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা, তার নিজের অহংকার, আর অবিচার দেখেও নীরব থাকার পাপ—এইগুলিই ভেতর থেকে তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। সমাজের পচন সে দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু নিজের ভেতরের পচন সে দেখতে পায়নি। তার মানসিক বিকৃতি তাকে কেবল বাইরের রাক্ষসদের দেখতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু ভেতরের রাক্ষসকে তৈরি করেছিল তার কাপুরুষতা।
বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখন আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে। অনির্বাণ জানত, আগামীকাল সকালে সে যখন এই ঘর থেকে বের হবে, তখন সে আর আগের অনির্বাণ থাকবে না। সে হবে ভিড়ের একজন, স্বার্থপরতার প্রতীক। তার ভেতরের রাক্ষসটি এখন স্থায়ী। এই করুণ সত্যের যন্ত্রণা নিয়েই সে বাকি জীবন যাপন করবে, যেখানে অন্যদের নীরবতা তাকে রাক্ষসে পরিণত করেছে, আর তার নিজের নীরবতা তাকে চিরতরে বন্দী করেছে। সে কেবল বাঁচার জন্য শ্বাস নিতে থাকল, কিন্তু ভেতরের মানুষটা ততক্ষণে মারা গেছে।
..............................
নবনীতা বোস, শিবতলা লেন, শিবপুর, হাওড়া-৭১১১০২

Comments
Post a Comment