চেনা প্রতিবেশী
(ষষ্ঠ পর্ব)
দীপক পাল
মঙ্গলবার ত্রিহান অফিসে জয়েন করলো। নামেই এসিস্ট্যাট এডমিনিস্ট্র্যটিভ অফিসার আগে যেখানে যে টেবিল চেয়ারে বসতো এখনও সেখানেই তার বসার জায়গা। টেবিলে না বসে প্রথমেই সিনিয়ার এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের চেম্বারে প্রবেশ করলো। তিনি একটা খোলা ফাইলে কিছু একটা মন দিয়ে পড়ছিলেন হাতে খোলা কলম নিয়ে। ত্রিহানকে দেখে হাতের কলম রেখে বলে উঠলেন, 'আরে ত্রিহান এসে গেছ যে। বাড়ী শিফটিং হলো?'
- ' হ্যাঁ হলো বটে তবে সব কিছু গুছিয়ে নিতে এখনও অনেক দেরী। '
- ' হ্যাঁ তাতো হবেই। এক জায়গা থেকে শিফটিং করে আর এক জায়গায় নতুন সেটআপ করা সোজা কথা নাকি। তারপর দেখবে কিছু জিনিসপত্র না বাড়ালেই নয়। তুমি অফিসে থাকলে আমি অনেক নিশ্চিন্ত থাকি। আর এই ফাইলটা নিয়ে যাও, যা করার করে পাঠাও। এদিকে তুমি নতুন ফ্ল্যাটে উঠলে মিষ্টি খাওয়াবে না আমাদের?'
- ' অতি অবশ্য। আমি ক্যান্টিনের মৃনালকে বলে দিয়েছি। আজকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের
দুপুরের টিফিনের খরচ আমার।
- ' বেশ বেশ তাই হোক।'
দুপুরে মৃণাল টেবিলে টেবিলে টিফিন পাঠিয়ে দিল। যটা খুশি রুটি আর এগ তর্কা ও দুটো করে রাজভোগ। ছিমছাম খাবার অথচ পেট ভরে। নিচের রিসেপসনিস্ট, ডেসপ্যচার, তিনজন ড্রাইভার মোট দশজন। ঠিক পেছনে একটা বড় বেঞ্চ পাতা। ড্রাইভার ও পিয়নেরা ঐ বেঞ্চে বসে গুলতানি করে। ত্রিহানের টেবিলে কে কোন অফিসারের গাড়ীর প্রয়োজন কোন কাজের জন্য তার রিক্যুউজিসান ফর্ম জমা পরে। ত্রিহান ড্রাইভারকে ডেকে ওপরের ফর্মটা তার হাতে দেয়। সে সেই ফর্ম নিয়ে চেম্বারে S.A.O র সই করিয়ে যার রিক্যুউজিসন তাকে নিয়ে বেরিয়ে পরে। একটা জাব্দা খাতায় ত্রিহান সেটা লিখে রাখে। আবার গাড়ীটা ফিরে এলে গাড়ীর লগ বুক চেক করে নিয়ে জাব্দা খাতায় পুরো ডিটেলস্ লিখে রাখতে হয়। যেমন গাড়ী কটায় বেরোলো কটায় ঢুকলো কত কিলোমিটার জার্নি হলো এবং যে গাড়ী নিয়েছে তার সই আছে কিনা ইত্যাদি। এমন হয় তিনটে গাড়ীই বাইরে। তবে ঝামেলা হয় যদি কোন গাড়ী রাস্তায় খারাপ হয়ে যায়। তখন ওকে স্পটে হাজির হতে হয় গাড়ী নিয়ে। যদি গাড়ী না থাকে তবে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করে। খারাপ গাড়ীটা গ্যারেজে পাঠিয়ে তার কি হয়েছে কি করা দরকার সবটা জেনে নিয়ে কোটেসন ড্রাইভারকে নিয়ে আসতে বলে সেই অফিসারকে গাড়ীতে তুলে অফিসে ফিরে আসে। ড্রাইভারকে অন্তত তিনটে কোটেশন আনতে হয়। কোটেশন কি আর ও ঘুরে ঘুরে জোগাড় করে। না তানা, তারও ব্যাবস্থা আছে। এই সব গ্যারাজগুলোই তিনটি লেটার প্যাড থেকে তিনটি নামে এবং বিভিন্ন ঠিকানা থেকে তিনটি কোটেশন লিখে ড্রাইভারের হাতে দেয়। কিন্তু নিজেদের রেটটা সবচেয়ে কম রাখে। ড্রাইভার সেগুলো এনেই ত্রিহানের হাতে দেয়। ত্রিহান একটা নোট লিখে S.A.O এর কাছে পাঠিয়ে দেয়। S.A.O তার ওপর নোট লিখে একাউন্টসে পাঠিয়ে দেয় স্যংসানের জন্য। ত্রিহানের কাজ কম নয়। মাঝে মাঝে গ্যারেজে গিয়ে কাজ দেখে আসতে হয়। তাছাড়া এই তিনটে গাড়ীর রোড ট্যাক্স, পলউসন সার্টিফিকেট, তেলের হিসাব রাখা, নতুন টায়ার কেনা ইত্যাদি নানান ফেচাং। তবে পুলিসের ঝামেলা খুব কম। কারণ গাড়ীর সামনেই লাগানো Government of India board.
শনিবার দুতিনটে ব্যাগ নিয়ে বাজারে গেল ত্রিহান। ঘরে প্রায় সবই বাড়ন্ত। মাছের বাজারে ঢুকে মাছ কিনতে গিয়ে ত্রিহান অবাক। ত্রিহান আগে টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টে ছিল তখন ঐ ডিপার্টমেন্টে দুই পিয়ন কাজ করতো তাদের নাম পবন আর কমল। দুজনে এই গড়িয়া থেকে অফিস করতো। পবন ঠিক সময়ে অফিসে আসলেও কমল আসতো দেরী করে। এটেন্ডেস ফাইলটা রিজিওনেল চীফের চেম্বারে। কমল প্রতিদিন দেরী করে অফিসে ঢুকে সাহেবের চেম্বারে দরজাটা একটু ফাঁক করে যদি দেখে সাহেব সিটে নেই তবে সে অবলীলায় চেম্বারে ঢুকে এটেন্ডেসে সই করে। যদি দেখে সাহেব সিটে বসে কাজ করছে তবে সে চেম্বারে ঢোকে না। যখন ফাঁকা হয় তখন টুক করে ঢুকে সেটা করে নেয়।
তবে মাঝে মাঝে আচমকা ধরা পড়ে যায়। তখন তাকে সাহেবের বকুনি শুনতে হয়। সই করতে দিতে চায় না। কমল তখন বলে, ' স্যার এই দশ পনেরো মিনিট লেট হয়ে গেছে।'
- ' দশ পনের মিনিট মানে? তুমি এগারোটা বাজিয়ে ফেলেছো আর বলছো দশ-পনেরো মিনিট।' কমল বলে, ' স্যার আমার একটু লেট হলেও যাই কিন্তু আমি সবার পরে। পাঁচটা বেজে গেলেও আমি আরো কিছুক্ষণ থাকি স্যার।' চীফ হেসে ফেলেন। এটেন্ডেস ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলেন, ' কথায় তুমি ওস্তাদ, যাও সাধন বাবুকে পাঠিয়ে দাও তাড়াতাড়ি।'
কমল চেম্বার থেকে বেরিয়ে বোঁ করে এক পাক ঘুরে নিয়ে হাতের দুই তালু এক করে অদ্ভুত রকম দুবার হেসে আবার বোঁ করে ঘুরে একেবারে সাধনবাবুর টেবিলে গিয়ে বলে - ' সাহেব আপনাকে ডাকছে এখুনি।' সাধনবাবু কমলের এরকম হ্যাবিটটা জানেন।
- ' ঠিক আছে তবে সেটা বলতে গিয়ে এত কায়দা করার কি দরকার।' ' ঐ আরকি।'
রিজিওনাল চীফও জানেন, কাজ নিয়ে তিনি বাইরে গেলে ফিরতে যদি পাঁচটা বেজে যায় তখন কোন পিয়ন না থাকলেও কমল ঠিক থাকে। তিনি মাসের অর্ধেক দিনই ট্যুরে থাকেন। সেই সময়টা কমলের পোয়া বারো।
- কি ত্রিহানদা মাছের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি চিন্তা করছেন?' কমলের প্রশ্ন।
- ' আপনি গড়িয়া এপার্টমেন্টে এসে গেছেন। কবে আসলেন?'
ত্রিহান বলে, - ' হ্যাঁ এইতো গত রবিবার। অফিসে জয়েন করেছি মঙ্গলবার। ভাঁড়ারে কিছু নেই তাই বাজারে আসতে হলো। তোমাদের বাড়ী কোন দিকে?' কমল বলে, - 'আমি বলছি, আপনার ফ্ল্যাটের উল্টো দিকের রাস্তাটা ধরে সোজা ভিতরের দিকে হাঁটা দিলে একটা মুদীর দোকানের পাশ দিয়ে ডান দিকে যে রাস্তাটা ঢুকেছে তার বাম দিকের তিনটে বাড়ীর পরে আমার বাড়ী। আর পবনের বাড়ী আর একটু এগিয়ে ডান দিকে। একদিন ত্রিহানদা আপনাকে নিয়ে যাব আমাদের বাড়ী।'
ত্রিহান কি মাছ কিনেছিল। দোকানি মাছগুলো কেটেকুটে ত্রিহানের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। ত্রিহান টাকা দিয়ে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। ভাবলো এই কাঁটায়ালা মাছতো আহির খেতে পরবে না তাই পাবদা মাছ কিনে চিকেনের দোকানে লাইন দিল।
কমল ও পবন নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছিল তারপর লাইনে দাঁড়ান ত্রিহানের কাছে গিয়ে দুজনে জিগ্গেস করে, ' ত্রিহানদা আপনারা কি বিকালে ফ্ল্যাটে থাকবেন না কোথাও বেরোবার আছে?'
- ' না আমরা কোথাও যাবোনা বাড়ীতে থাকবো। কদিন ধরে যে খাটাখাটনি চলছে তাই আজ বাড়ীতে থাকবো। কেন তোমরা কি আসবে আমাদের ফ্ল্যাটে?'
- ' হ্যাঁ আমরা তাহলে বিকালে আপনাদের ফ্ল্যাটে পাঁচটার পরে যাবো। অসুবিধা নেই তো কোন?'
- ' তোমরা আসবে আমাদের বাড়ী অসুবিধা হবেই বা কেন? বরং আমাদের অত্যন্ত ভালো লাগবে তোমরা আসলে। তোমরা প্রতিবেশী বলে কথা আমাদের।' পবন বলে, - ' শুনেছিলাম শান্তি এপার্টমেন্টে আপনি ফ্ল্যাট নিয়েছেন। কিন্তু ব্লক নম্বর ও ফ্ল্যাট নম্বরতো কিছুই জানি না।'
- ' ব্লক নম্বর বি আর ফ্যাক্ট নম্বর পাঁচের এ। পাঁচ মানে 5th floor.' - ' ঠিক আছে আমরা যাবো বিকাল পাঁচটার পরে।'
- ' হ্যাঁ এসো অতি অবশ্য।' ত্রিহান চিকেন কিনে সব্জির বাজারে ঢুকলো। আহির চিকেন খেতে খুব ভালোবাসে।
বাজার করে বেরিয়ে বাড়ীতে ফিরতে ফিরতে ত্রিহান চিন্তা করলো। এই সেই পবন গুলবাজ যে ঘুরে ফিরে ত্রিহানের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসতো। শুধু এমনি এমনি নয় ত্রিহানরদার কাজ করতে ও খুব ভালবাসতো। কাজের মাঝে সে নানা রকম অবিশ্বাস্য গল্প করে। যেমন একদিন চেয়ার টেনে বসে পকেট থেকে একটা অতি ক্ষুদ্র বিড়ির বান্ডিল আর একটা লাইটার বার করে বিড়ির বান্ডিল থেকে একটা ক্ষুদ্র বিড়ি বার করে ত্রিহানের হাতে দেয় এবং নিজে একটা নিয়ে ঠোঁটে ঢুকিয়ে লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে আগুনটা ত্রিহানের দিকে এগিয়ে দিল।
- ' দাঁড়াও দাঁড়াও আমি স্মোক করা ছেড়ে দিয়েছি।' বলে ত্রিহান ' কিন্তু এত ছোট বিড়িতো আমি দেখিনি কোনদিন। কোথায় পাওয়া যায়?'
- ' হুঁ হুঁ এর পিছনে আমার পরামর্শ আছে।' বিড়িটাতে একটা শেষ টান দিয়ে বলে।
- ' তোমার অবদান! ভারী ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। সেটা কি শুনি।'
- ' গড়িয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা থামের লাগোয়া একটা মেয়েলোক নিজেই বিড়ি বানাতো নিজের বাড়ীতে আর প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করতো। আমি তার থেকেই রোজ দু বান্ডিল করে বিড়ি কিনতাম। একদিন আমাকে বলে, পবনদা এই বিড়ি বিক্রি করে আর সংসার চালাতে পারছিনা। ভাবছি এই ব্যাবসাটা ছেড়ে দেব।
আমি তখন তাকে বললাম এই ব্যাবসাটাই লাভজনক করা যায়। যদি আমার কথা শোনেন। তখন আমাকে জিগ্গেস করলো কি কথা। আমি বললাম তখন বিড়ির সাইজটা খুব ছোট করুন বিড়ি বানানো অনেক বাড়িয়ে দিন প্রয়োজন হলে একটা লোক রাখুন। সে আপনার সাথে বিড়ি বাঁধবে আর বিড়ি সেঁকবে। বান্ডিল করে সেগুলো নীল লাল সবুজ ও সাদা সুতো দিয়ে বেঁধে বিক্রি করুন। দেখুন কি হয়। বছর খানেকের মধ্যেই আমাকে বলে পবনদা আপনার পরামর্শ আমার খুব কাজে দিয়েছে। আমার বাড়ীটা দোতলা করছি। ছেলে মেয়ে দুটো লেখা পড়ায় ভাল হয়েছে। একটু সুখ দেখতে পারছি এখন।'
- 'বলো কিগো পবন, এতো রূপকথার মতো ব্যাপার।' বিশ্বাস করেছি ভেবে বলে, - 'আজ ঐ মহিলার এখন বাড়ীর চারতলার কাজ চলছে। একতলায় দোকান ঘর সরিয়ে নিয়েছে। লোক নেওয়াও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন কলকাতার অনেক দোকানেই তার বিড়ি পাওয়া যায়।
(চলবে)
---------------
Address :-
----------------
Dipak Kr. Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8 Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.

Comments
Post a Comment