অনুসরণ
বিশ্বরূপ অধিকারী
সাঁতার কাটা এমন একটা বিষয় যা সবার শিখে রাখা উচিত। সেটা ১৯৭৫ সালের জুন মাস। আমার তখন ক্লাস সিক্স। স্কুলে গরমের ছুটি চলছে। অনেকদিন থেকেই সাঁতার শেখার ইচ্ছে। লেল্টু, টুটুন, নিরু সবাই সাঁতার শিখে গেল। আমার শেখা হয়নি। ওরা যখন দিঘিতে স্নান করার মজার গল্প করত, তখন আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হ'ত। শেষে আর থাকতে না পেরে, একদিন দুপুরে কোমরে গামছা বেঁধে, গিয়ে হাজির হলাম বাড়ির কাছে বাবু দিঘির পাড়ে। দেখি বন্ধুরা সব জল ছিটিয়ে , হাত পা ছুঁড়ে , জলের মধ্যে দাপাদাপি করছে। একটা রবারের বল ছোঁড়া ছুঁড়ি করে, ঝাঁপাঝাঁপি করে, নিরু, লেল্টু ভীষণ চিৎকার করে খেলছিল। জলের ঝাপটায় দিঘির জলে সাদা ফেনা তুলে ওরা এমন মেতে উঠেছে যে কাউকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।
হঠাৎ জলের মধ্যে দূর থেকে প্রদীপদার গলা শুনতে পেলাম। সাঁতার কাটতে কাটতে চিৎকার করে বলে উঠল," কি রে বিশ্ব, সাঁতার শিখবি নাকি?" আমি একটু লজ্জা পেলেও, চেঁচিয়ে বললাম," হ্যাঁ, শিখব।" প্রদীপদা ক্লাস নাইনের ছাত্র। পড়াশোনায় নাম-ডাক আছে। যোগব্যায়াম প্রতিযোগিতায় উষ্ট্রাসন, ধনুরাসন, ময়ূরাসন আরও সব আসন করে এবার জেলায় ফার্ষ্ট হয়েছে । আমি প্রচন্ড রোদে চোখ মুখ কুঁচকে পাড়েই দাঁড়িয়ে আছি। প্রদীপদা আবারো চেঁচিয়ে উঠল,"কি রে, তুই কি ডাঙ্গায় সাঁতার শিখবি নাকি? জলদি জলদি জলে নেমে আয়। জলে না নামলে তো আর সাঁতার শিখতে পারবি না।" আমি ধীরে ধীরে এক পা , এক পা করে অতি সাবধানে হাঁটু জলে নামলাম। এ্যাঃ, জলের নিচে কাদায় পা ডুবে যাচ্ছে। আর না এগিয়ে আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। জলের আঁশটে গন্ধ নাকে এসে লাগল। এই গরমে নিচের ঠান্ডা জলে বেশ আরাম লাগছিল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সুদামদা বুক সমান জলে দাঁড়িয়ে দু-কানে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ঘন ঘন ডুব দিচ্ছে। উপেনকাকা কোমর জলে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে ছপাৎ ছপাৎ করে দুদিকে জলের নোংরা সরিয়ে পরিস্কার করে, স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ সূর্যের দিকে দু হাত কপালে ঠেকিয়ে, চোখ বুঁজে প্রণাম করছে। আবার কেউ বা গামছা দিয়ে সারা গা, হাত-পা ঘষেই চলেছে। এর মধ্যে হঠাৎ হু-উ-শ করে কে যেন সামনে ভেসে উঠল। আমি প্রায় জলের মধ্যে উল্টে পড়ি আর কি। মাথা ঝাঁকিয়ে চুলের জল ঝরাতেই দেখি প্রদীপদা! হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল,"চল্।" আমাকে টেনে নিয়ে দিঘির আরও গভীরে চলল। আমি তো ভয়ে অস্থির। গভীর জলে গিয়ে, "দেখবি, আজকেই সাঁতার শিখে যাবি।" বলে প্রদীপদা আচমকা আমার হাত ছেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ডুবে যাচ্ছিলাম। চোখ মুখ বন্ধ করে প্রাণপণে 'বাঁচাও, বাঁচাও' বলে চিৎকার করে উঠতেই আশেপাশের লোকজন " কি হ'ল, কি হ'ল" বল হৈ হল্লা শুরু করল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর কেউ মাথা না ঘামিয়ে স্নান করতে লেগে গেল। হাবুডুবু খেতে খেতে মুখ দিয়ে খানিকটা দিঘির জল আমার পেটে চলে গেল।প্রদীপদা পাশে দাঁড়িয়ে বিশাল হাঁ করে "হাঃ,হাঃ, হাঃ" করে হাসছিল আর আমি যাতে ডুবে না যাই, সেজন্য মাঝে মাঝে হালকা করে আমাকে জলের উপরে তুলে দিচ্ছিল। আমি তখন জলের মধ্যে হাত -পা ছোঁড়া ছুঁড়ি করে "ও মা, ও বাবা" বলে আর্তচিৎকার করে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে বসেছি। তবে এক অবাক কান্ড! এক সময় মনে হ'ল এভাবে হাত, পা ছুঁড়ে আমি হয়তো একটু ক্ষণের জন্য হলেও জলে ভেসে থাকতে পারছি। দারুন আনন্দ-উল্লাসে সাহস বেড়ে গেল। আরও বেশী করে হাত পা ছুঁড়ে মাথাটাকে জলের উপরে রেখে ভেসে থাকার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।।বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর প্রদীপদা আমাকে পাড়ের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলল," কাল থেকে রোজ আসবি।" পরদিন থেকে এভাবেই যখন এক রোমাঞ্চকর ভয়ের অনুভূতির মধ্যে আমার সাঁতার শেখা এগিয়ে চলছে, ঠিক তখন একদিন স্নানের পর প্রদীপদা বলল,"সামনে রবিবার দুপুরে অবশ্যই আসবি।" আমি অবাক সুরে বললাম," কেন প্রদীপদা?" সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপদা সাঁ করে ঘাড় ঘুরিয়ে, চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে কড়া সুরে বলল," আসতে বললাম, আসবি। ব্যাস।" একথা বলেই প্রদীপদা চিৎ হয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎ সাঁতার কেটে দূরে চলে গেল। এদিকে আমার তখন মুখ চোখ শুকিয়ে গেল। কিছু ভুল করেছি নাকি?
পরের কয়েকটা দিন রোজ সবার আগে এসে প্রায় এক-দু ঘন্টা ধরে সাঁতার কাটলাম। ডুব সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। একটু আধটু চিৎ সাঁতার কাটতে চেষ্টা করলাম।এর মধ্যে একদিন মাঝ দিঘি পর্যন্ত একটানা সাঁতার কেটে এপারে ফিরে এলাম। ভয়টা অনেকটাই কেটে গেল। এ কয়দিনে রবিবারের কথা মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়েছে। কি যে হবে কে জানে! নিরুরাও কেউ জানে না, কি ব্যাপার।
রবিবার দুপুরে দুরু দুরু বুকে গিয়ে হাজির হলাম বাবু দিঘির পাড়ে।ও মা ,ওখানে গিয়ে দেখি অন্যদিনের মতোই হৈ হৈ করে স্নান-ধ্যান চলছে। আলাদা করে বলার মত কিছুই দেখতে পেলাম না। ভিড়ের মধ্যে প্রদীপদাকে দেখতেও পেলাম না। 'কে জানে কি ব্যাপার' ভেবে যখন দূরে দৃষ্টি মেলে দিলাম, তখন দেখি প্রদীপদা ওপার থেকে সাঁতার কেটে এপারে আসছে। প্রদীপদার সাঁতার কাটার ধরণ সবার চেয়ে আলাদা। নৌকার দাঁড় টানার মতো হাত দুটো লম্বা করে জলের মধ্যে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে জল কেটে এগিয়ে যায়। দূর থেকে ওই বিশেষ কায়দার সাঁতার কাটা দেখে বোঝা যায় যে, ও লোকটা প্রদীপদা। প্রদীপদা কাছে এসেই আমাকে বলল," কি রে এখনই এলি?"
-- "হ্যাঁ, প্রদীপদা।"
-- "বেশ। শোন্ আজ তোর সাঁতার শেখার পরীক্ষা। আজ তোকে সাঁতরে দিঘির এপার-ওপার করতে হবে।"
আমি আঁতকে উঠে বললাম,"আমি একা!!"
প্রদীপদা আমার ভয় দূর করে বলল," আরে,না, না আমি তোর পাশে পাশে থাকব। কিন্তু আসা-যাওয়া মিলিয়ে কুড়ি মিনিট সময় পাবি, তার বেশী না। আর সাঁতার কাটার সময় কোনোমতেই পিছনে তাকানো চলবে না।"
-- "ঠিক আছে।"
--"চল্ তাহলে, শুরু করা যাক্।"
লেল্টু, টুটুন, নিরু সবাই মিলে আমার পিঠ চাপড়ে বলল," যা, যা শুরু করে দে। কিচ্ছু হবে না। পারবি, পারবি।"
পরীক্ষার আতংকে হাত পা কাঁপলেও আর কথা না বাড়িয়ে ঝপাং করে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে। মাঝদিঘিতে গিয়ে মনে হ'ল,"আমি তো পারছি।" পাশ থেকে প্রদীপদাও সমানে "চালিয়ে যা, চালিয়ে যা। সামনের দিকে তাকিয়ে সাঁতার কাটতে থাক।" বলে সাহস দিতে থাকল।
অবাক কান্ড! আমি ওপাড়ের ঘাটে পৌঁছে গেছি! নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভয়-কে জয় করে শেখার আনন্দে হাসব না কাঁদব? ক্ষণিকের জন্য ঘাটে দাঁড়িয়ে দিঘির ও পাড়টা দেখছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, সত্যিই আমি সাঁতার কেটে এতটা দূরে এপাড়ে চলে এসেছি!
প্রদীপদার ডাকে সম্বিত ফিরল। "কি রে ফিরতে পারবি তো?"
--"হ্যাঁ, হ্যাঁ পারব।" বলে আবার জলে ঝাঁপ দিলাম।
শুনতে পেলাম ওপার থেকে লেল্টু, নিরুদের চিৎকার," চালিয়ে যা বিশ্ব, চালিয়ে যা। সাবাশ--সাবাশ।"
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, প্রদীপদা পাশে নেই। আমি একা। সর্বনাশ ! কিন্তু তখন আর থামার চেষ্টা করলাম না। মনে একটা সন্দেহ হ'ল, "পারব তো বাকিটুকু?" ভয় ভয় লাগতে শুরু করল। নিরুদেরকে দেখলাম । ওরা সবাই হাত নাড়ছে আর চিৎকার করছে, "আর বেশী নেই। স্পিড বাড়াবি না। একভাবে সাঁতার কেটে চলে আয়।" হঠাৎ মনে হ'ল পা দুটো যেন অল্পবিস্তর ঝিমিয়ে পড়েছে। ঠিক তখনই,আচমকা আমার পাশে, জলের মধ্যে কি যেন একটা ঠেলে উঠতে চাইছে, দেখে ভয় পেয়ে "ও- মা , বাঁ -চা-ও" বলে আর্তচিৎকার করে উঠলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমাকে চমকে দিয়ে জলের ভেতর থেকে লেল্টু উঠে এল। ডুব সাঁতার কেটে আমার কাছে চলে এসেছে। একগাল হেসে,ও আমাকে সাহস দিয়ে বলল," একা একা চলে যা।" আমিও আর তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে একভাবে সাঁতার কেটে এ পাড়ে এসে পৌঁছতেই নিরুরা হাসতে হাসতে আমায় জড়িয়ে ধরল। সবাই মিলে দু হাত দিয়ে আমার গায়ে জল ছিটিয়ে দিতে শুরু করল আর বলতে লাগলো ,"শিখে গেলি সাঁতার।" টুটুন কি যেন বলতে গেল-- আমি বললাম,"প্রদীপদা কোথায় রে?" লেল্টু পাশ থেকে অবাক হয়ে বলল," জানিস্ না? প্রদীপদা তো তোকে রওনা করে দিয়ে ওপাড়েই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ভীষণ চমকে উঠে বললাম,"আমার পিছনেও ছিল না?" নিরু মাঝদিঘির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,"ওই যে, প্রদীপদা আসছে।"
আমরা সবাই প্রদীপদার অপেক্ষায় জলে দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকেই প্রদীপদা চিৎকার করে বলতে লাগল," পাশ করে গেছিস বিশ্ব। ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে গিয়েছিস।"
কাছে এসে প্রদীপদা আমাকে দু-হাত মেলে নিজের চওড়া বুকে টেনে নিয়ে, জড়িয়ে ধরে বলল,"যাক্ , পরিশ্রম সার্থক হ'ল, কি বলিস? জীবনে আর কখনো সাঁতার কাটা ভুলে যাবি না। এ এক অদ্ভুত শিক্ষা। একবার শিখে নিতে পারলেই হ'ল।আর কোনোদিন জলে নামতে ভয় পাবি না, নৌকায় চেপে নদী পার হতেও ভয় পাবি না। আর দিঘিতে, নদীতে স্নানের যে কি মজা তা তো এখন বুঝতেই পারছিস।" তখন আমার মনে এক অন্য অনুভুতি। আমার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দাশ্রু। প্রদীপদাও কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেল। আমার দু চোখ মুছে দিয়ে বলল," চল্, গা মুছে সবাই বাড়ি ফিরে চল্।" সেদিন একরাশ আনন্দ ভরা মনে কিভাবে যে বাড়িতে ফিরেছিলাম তা আর বলার নয়। এ যেন অসম্ভব ভালো কিছু পাওয়া।
পরের রবিবার। দুপুরে আমরা সবাই মিলে বাবু দিঘির জলে হৈচৈ করে ঝাঁপাঝাঁপি করছি। এমন সময় দেখি , আমাদের পাশের বাড়ির নন্তু, রোদের মধ্যে চোখ দুটো ছোট করে, ওর বাবার হাত ধরে দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নন্তু ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি ওকে আমার সাঁতার শেখার গল্প বলেছিলাম। চিৎকার করে বললাম,"কি রে নন্তু সাঁতার শিখবি নাকি?" নন্তু সেই আমার মতোই সলজ্জ হাসি হেসে একটু ইতস্তত করে ওর কচি গলায় বলে উঠল," হ্যাঁ, শিখব। তুমি শেখাবে?" কথাগুলো যেন দিঘির এপাড় থেকে ওপাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। খুশিতে আমার বুক ভরে গেল।আমি প্রদীপদার শেখানো পথ অনুসরণ করে, নন্তুর হাত ধরে, ওকে জলে টেনে নিয়ে এলাম। নন্তুর সে কি ভয় মেশানো নির্মল হাসি।
===================
Biswarup Adhikary
Rainbow Residency Flat- C/3
M.G.Road. Ukilpara
P.o. Raiganj. Dist. Uttar Dinajpur
Pin 733134

Comments
Post a Comment