শিউলী ব্যানার্জী (মুখার্জী)
"শুনুন কাকু .....এবার কিন্তু আমার দুহাজার টাকা লাগবে দুঘন্টা ধরে আপনাদের নবদিগন্ত পূজো প্যান্ডেলে মিমিক্রি করার জন্য । এতো এতো দর্শনার্থীর ভিড়ে স্টেজে উঠে দুঘন্টা ধরে বকবক করতেও পরিশ্রম বলে তো জিনিস আছে নাকি .....আর একহাজার টাকায় কাজ করবো না। দেবেন তো বলুন; না হলে এই জবাব দিলাম " ......তপেন এক নিঃশ্বাসে রাজেন বাবুকে কথা গুলো বলে গেলো ......রাজেন মিত্তির নবদিগন্ত দুর্গাপূজা কমিটির সেক্রেটারি । প্রতিবছর তপেন কে দিয়ে মঞ্চে মিমিক্রি করায় সঙ্গে আরো নানা রকম অভিনয়ও করান । দর্শনার্থীদের ভিড় জমে সকলে আনন্দ পায়। পূজোর একটা বিশেষ আকর্ষণ বা চমক বলা যেতে পারে তপনের মিমিক্রি কে। প্রতিবছর রাজেন মিত্তির তপেনকে এক হাজার টাকা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেন আরকি। তপেন বাপ মা মরা সরল সাধাসিধে ছেলে কাছের বলতে এক মাসি আছে তার ঘরেই মাটির চালায় থাকে কাজ বাজ বিশেষ কিছুই নাই বড্ড গরিব কিন্তু তার ঐ একটি গুন ভালো আছে বিভিন্ন নেতা ; অভিনেতা ; পশু ; পাখি এদের কথা গলার কন্ঠ সব হুব হু নকল করে দিতে পারে । কেউ ধরতেই পারবে না কোনটা আসল আর কোনটা নকল গলা। তা যাই হোক রাজেন মিত্তির তপেনের দাবি মেনে নিয়ে বললো ....ঠিক আছে তপেন দু হাজার টাকাই দেবো তবে ভালো করে অভিনয় টা করিস যাতে আমাদের প্যান্ডেল আর পূজো সবার নজর কাড়ে। তপেন রাজেন মিত্তির কে একটা প্রনাম ঠুকে বললো ঠিক আছে কাকু ....কোন চিন্তা নেই। সপ্তমী থেকে দশমী চারদিন তোমার মঞ্চ জমিয়ে দেবো। মুখে একগাল হাসি নিয়ে রাজেন মিত্তির বললো ঠিক আছে তাই হবে।
তপেন সেবার খুব ভালো অভিনয় আর মিমিক্রি করে মানুষের মন জয় করে নিলো।
ভিড়ের মাঝে তপেন কে একজন লক্ষ্য করেছিলো তিনি হলেন দেবরাজ সেন।
দেবরাজ সেন ভারতীয় সেনা বাহিনীর অফিসার পদে দীর্ঘদিন কাজ করার পর অবসর নিয়ে ছেন তার সঙ্গী তার স্ত্রী সুমিত্রা দেবী। তাদের একমাত্র ছেলে রত্নদীপ সীমান্তে ভারতীয় সেনা বাহিনীতে কাজ করে। দেবরাজ সেনের তপেন কে বেশ ভালো লাগে ....ছেলেটিকে সেদিন মঞ্চে কিছু দিতে ইচ্ছে করছিলো তার ; আসলে তার অভিনয় দেখে দেবরাজ বাবু মুগ্ধ হয়েছিলেন তবে ভিড়ের মাঝে তাকে কিছু দিতে পারেননি।
***
পূজো শেষে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে প্রায় ছ মাস হলো দেবরাজ সেনের স্ত্রীর সুমিত্রা দেবী খুব অসুস্থ শারীরিক ভাবে ভীষণ দুর্বল আসলে হার্টের অবস্থা তার ভালো নেই ডাক্তার জবাব দিয়েছে। সুমিত্রা দেবী প্রতিদিন দুবার করে ছেলে রত্নদীপের সাথে কথা বলেন .....মায়ের মন তো ....ছেলে সীমান্তে থাকলেও ঐ যে ফোনে কথা হয় তাতেই উনার শান্তি ছেলের গলাটি পান ; কুশল মঙ্গল জিজ্ঞাসা করেন। ছেলের সাথে কথা বলে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে সুমিত্রা দেবীর। কিন্তু একদিন হোল কি খুব ভোর রাতে ফোনটা বাজছে ........দেবরাজ বাবু আধো ঘুমের ঘোরে ফোনটা তুলতেই যেই হ্যালো করেছেন ওমনি খবর এলো রত্নদীপ জঙ্গিহামলায় নিহত হয়েছে। হাত'থেকে ফোনটা পড়ে গেল তার বুঝতে পারছে না কি করবে এতো বড়ো একটা খবর তাদের রত্নদীপ নেই কিভাবে সুমিত্রাকে বলবেন উনি .......সুমিত্রা দেবী জানতে চাই কে ফোন করেছিলো খোকা নাকি গো ..........আজ এতো ভোর রাতে খোকা আমার ফোন করেছে। বলোনা চুপ করে আছো কেন? .....বলো গো বলো ..... দেবরাজ বাবুর মুখে কোনো কথা নেই .....চুপ হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের উপর তার হাত ফোনটা তখনো সেখানে। সুমিত্রার গলা শুনে নিজেকে সামলে নেয় কিছু জানতে দেয় না সুমিত্রা দেবীকে। কারন দেবরাজ বাবু জানেন এই খবর পেলে সুমিত্রা সঙ্গে সঙ্গে হার্ট ফেল করবে। নিজেকে সামলে নেয় দেবরাজ বাবু কিছু হয়নি এমনটি ভাব দেখিয়ে বলে .......সুমিত্রা খোকা আমাদের ভালো আছে। তোমার শরীর কেমন আছে তার খবরটা নিচ্ছিলো। এই আরকি। সুমিত্রা দেবী ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়লেন যেন নিশ্চিন্ত হলেন।
পরের দিন ঠিক সকাল নটা ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছে তার ছেলের গলাটা শুনবে বলে। কিন্তু ফোন আর বাজে না। অস্থির হতে থাকে সুমিত্রা । দেবরাজ বাবু এটা ওটা বুঝিয়ে তার মাথা ঠান্ডা করে। এই ভাবে দু দিন তিন দিন কেটে গেলো সুমিত্রা দেবী রত্নদীপের জন্য ক্রমশ অস্থির হতে থাকে এদিকে বুকের যন্ত্রণাটা তার আগে'র তুলনায় দ্বিগুন বেড়ছে। দেবরাজ বাবু কি করবেন কোথা থেকে তিনি আর রত্নদীপকে ফিরিয়ে আনবেন। সে যে আর নেই। মাথা কাজ করছে না তার ....
হঠাৎ সব কিছুর মাঝে দেবরাজ বাবুর তপেনের কথা মাথায় আসে। তিনি তপেনের সব খোঁজ খবর জোগাড় করে তপেনের বাড়িতে পৌঁছে যান। তপেন কে সব বলেন তার ছেলে রত্নদীপের গলার আওয়াজ শোনান । কেমন ভাবে তার মায়ের সাথে কথা বলত, কি কি বলত সব শিখিয়ে পড়িয়ে নেন। এটাও বলেন প্রতিদিন সকাল নটা আর রাত্রি নটা নিয়ম করে রত্নদীপের গলায় সুমিত্রা দেবীর সাথে কথা বলতে হবে। তপেন রাজি হয় .......এই ভাবে দু থেকে তিন মাস তপেন সুমিত্রা দেবীকে মা .....বলে ডাকতে ডাকতে ফোনে কথা বলতে বলতে যেন রত্নদীপ হয়ে উঠে। হুবুহু তার কন্ঠে কথা বলে তপেন। আড়াল থেকে ফোনের সব কথা শোনেন দেবরাজ বাবু মনে মনে ভাবেন সুমিত্রা আর কটা দিনই বাঁচবে তাই সত্যিটা আর বলবে না তাকে। এই ভাবে তিন তিনটি মাস কেটে গেলো .....
***
কিন্তু গত রাতে সুমিত্রা দেবীর বুকের যন্ত্রণাটা অসহ্য রকম বেড়েছে শ্বাস পরশ্বাস নিতে পারছে না দেবরাজ বাবু কি করবে খুঁজে পাচ্ছেন না। এমন সময় তপেনের কথা মনে হলো ....সুমিত্রা দেবী খোকা খোকা করে ডাকছে ....কিন্তু দেবরাজবাবু অসহায় .....বললেন সকাল হোক নটা বাজুক তবে তো খোকা কথা বলবে ......সুমিত্রার দেবীর কপালে হাত বোলাচ্ছেন চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল পড়ছে .....দেবরাজ বাবু .....হ্যাঁ ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সময়ের দাপুটে অফিসার কিন্তু এখন কিছু করার নেই বড্ড অসহায় ...... তখন ঘড়িতে রাত দুটো সুমিত্রা দেবী চোখ বুঝলেন।
*****
তিন দিন পর তপেনের ফোন ঠিক সকাল নটা .......মা ........
দেবরাজ বাবু ফোনটা ধরেছেন .......তপেন একবার এসো বাবা .......
তপেন দেবরাজ বাবুর কাছে তড়িঘড়ি এসে উপস্থিত ......এসে দেখেন ঘর ফাঁকা ...মা ....নেই। তপেনের হাতে দেবরাজ বাবু ঘরের দলিল টা তুলে দিলেন সঙ্গে অনেকটা টাকার বান্ডিল । কাঁদছেন আর বলছেন তপেন .......তুমি ই আমাদের রত্নদীপ ..... আজ তিন মাস ধরে রত্নদীপের গলায় কথা বলে আমার সুমিত্রা কে বাঁচিয়ে রেখেছিলে তুমি .......এই টুকু তোমাকে নিতেই হবে। তপেন কিছু তেই ঘরের দলিল আর টাকা নেবে না। কিন্তু দেবরাজ তাকে জড়িয়ে ধরে ......বলে .....তপেন আজ থেকে তুই আমার ছেলে আমার স্থাবর অস্থাবর টাকা পয়সা সব তোর হাতে দিলাম। তুই এই বুড়ো বাপটার দায়িত্ব নিতে পারবি না ......বল। তপেন কিছুই বলতে পারে না তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যায় তার ........ মনে মনে বলে মিমিক্রি করতে করতে যে এই ভাবে আবার বাবাকে ফিরে পাবে ভাবেনি সে ........ তপেন জল ভরা চোখে বলে উঠে "এবার থেকে তোমার ছেলেই হলাম..... বাবা" । দেবরাজ বাবু ঝাপসা চোখে আলো আধাঁরির মাঝে দূর থেকে সুমিত্রা আর রত্নদীপের হাসি মুখটা যেনো দেখতে পেলেন শেষবারের মতো............।।
==================
শিউলী ব্যানার্জী (মুখার্জী)
গ্রাম +পোস্ট: নিত্যানন্দপুর
থানা: গঙ্গাজলঘাটি
জেলা: বাঁকুড়া
পিন: 722142

Comments
Post a Comment