আওয়াজ
সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়
আওয়াজের দুনিয়ায় আপনাদের স্বাগত। আওয়াজ বলতে আমরা দুমদাম, ফটাস, দড়াম দড়াম, গুড়ুম গুড়ুম, ঝনঝন, খটখট, ফটফাট, ধুমধাম, ধুপধাপ, ঝমঝম এসব শব্দগুলো বুঝতাম। বৃষ্টির আওয়াজ যেমন ঝমঝম, ট্রেনের আওয়াজ আবার ঝমাঝম। বাসন কোসন পড়ে গেলে ঝনঝন। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ খটখট। বন্দুক,বোম ইত্যাদির আওয়াজ দড়াম। শিল পড়ার আওয়াজ হুটহাট। ঘরবাড়ি ভেঙে পড়লে হুড়মুড় ইত্যাদি। তবে বুকের আওয়াজকে বলে ধড়াস ধড়াস।জোরে জোরে নিঃশ্বাস তখন ফোঁসফোঁস। আর নাক ডাকার একটা বিদঘুটে আলাদা আওয়াজ আছে, ফুঁকনলে হাওয়া বেরোলে যেমন হয়। মানুষটি কিরকম মোটাসোটা তার উপরেও কিছুটা নির্ভর করে। কানেকানে কথা হলে 'ফিসফিস'।আবার কোন চক্রান্তের কথা আস্তে আস্তে হলে 'গুজগুজ'। পাতা ইত্যাদি ঘষে যাওয়ার আওয়াজ খসখস। রেগে গেলে মুখ দিয়ে যেরকম শব্দ হয় তা হলো 'গজগজ'। জোরে থাপ্পড় মারার আওয়াজ হলো 'চটাস'। অবশ্য একটু রকমফের আছে,গালে একরকম, পিঠে একরকম, মাথায় একরকম, পশ্চাতে আরেকরকম। তবে দাঁতে দাঁতে ঘষা লাগলে একরকম আওয়াজ আছে 'কিড়মিড়'। পশুপক্ষীদের তো বিডিন্ন আওয়াজ আছেই। ইঁদুর টিঁদুর লাফালে দুপদাপ কিন্তু বাঁদর লাফালে ধুপধাপ। 'ভোঁ ভোঁ' যদি শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে সেটা কানের।আর 'সোঁ সোঁ' শব্দ হয় বাতাসের।
কতরকম সব আওয়াজ।আকাশে মেঘের আওয়াজ,এরোপ্লেন, হেলিকপ্টারের আওয়াজ,পাখির ডানা ঝাপটার আওয়াজ, মেঘ ডাকার আওয়াজ, বাজ পড়ার আওয়াজ, নিচে নদী, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের আওয়াজ, যান চলাচলের আওয়াজ । এগুলো তো ছিলোই, এখন আরো কত বেড়েছে। নিত্যনতুন যানবাহন যত বাড়ছে তত আওয়াজও বেড়েই চলেছে।তবে হ্যাঁ, কিছু আওয়াজ কমেছে নিশ্চয়। সাহেবদের আমলের বিশালকায় নরম্যান্ডি ঘোড়ার খুরের 'খটাখট' শব্দ এখন আর শোনা যায় না, কিম্বা কাকভোরে ছ্যাকরা গাড়িতে ট্রাইসেপ বাইসেপে তেল মাখতে মাখতে গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়ার আওয়াজ শোনা যায় না। তবে মন্দির মসজিদ গির্জা থেকে ঘন্টা বা মাইকের আওয়াজ এখনো যথারীতি আছে। আগে বড় বড় ঐতিহাসিক শহরগুলিতে ক্লক টাওয়ার বা ঘন্টাঘর হতো। ঢং ঢং করে বড় বড় ঘন্টাগুলির আওয়াজ সময় বলে দিতো। স্কুলের লম্বা লম্বা রেল লাইনের টুকরো দিয়ে যে ঘন্টা তৈরি হতো বা বড় বড় গোলাকার পেতলের ঘন্টা গুলিও আর দেখা যায় না, শিক্ষক শিক্ষিকারা নিজের হাতঘড়ি বা মোবাইল দেখেই ক্লাস নিতে যান। আর বাড়িতে বাড়িতে দেয়ালে ঝোলানো থাকতো যে আওয়াজ করা পেন্ডুলাম ঘড়িগুলো তারাও আর নেই। মোবাইল সব কেড়ে নিয়েছে।
গ্ৰামের রাস্তায় গোরুর গাড়ির ক্যাঁচর ম্যাচর আওয়াজও আর শোনা যায় না তেমন।চাষবাসে অবশ্য ট্রাক্টর,পাওয়ার টিলার এসবের আওয়াজ শোনা যায়।ফলে চাষির মুখে হাল গোরুর উদ্দেশ্য 'ঠা ঠা' 'হ্যাট হ্যাট' এসব আওয়াজ আর শোনা যায় না।একসময় অনেক বাড়ি থেকে ভোরবেলায় হারমোনিয়াম এ সরগম সাধনার আওয়াজ শোনা যেতো 'সারে সারে গা,রেগা রেগা মা'-কত রকম ভেঙে ভেঙে গলাকে হেস্তনেস্ত করে ছাড়া। তার সাথে তবলার চাঁটি,ভাইজি গাইছে দেখে ওস্তাদ কাকা হয়তো থাকতে পারলো না,বসে গেল বাঁয়া ডাহিনা নিয়ে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাজিয়ে গ্ৰামে শহরে একদল মানুষ আগে দান দক্ষিণা চেয়ে বেড়াতো- "ও ভাই মানব দেহ মাটির ভান্ড,ভাঙলে হবে খন্ড খন্ড,ভাঙা ভান্ড জোড়া লাগে না"।কখনো কখনো খোল করতাল নিয়ে কীর্তনীয়ারাও আসতো-'হরি বোল' কথাটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উচ্চারণ করে কত রকম সুর বের করতো।পাড়ায় পাড়ায় গলিতে গলিতে ফেরিওয়ালাদের আওয়াজ ছিল।পালাগান,কবি গান, যাত্রায় ছিল নানারকম বাজনার আওয়াজ। এখন যা বাজনার আওয়াজ তা আগের সব আওয়াজকে ফেল করে দিয়েছে।এখন হচ্ছে ঢাউস ঢাউস বক্স, তারপর হলো গিয়ে ডি জে। কানের তিন চার বছরের পুরোনো ময়লা বের করে দেবে।
যুবক বয়সে একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম 'মেরী আওয়াজ শুনো'। পুরো সিনেমাটা পেরিয়ে গেল কিন্তু আওয়াজ আর কেউ শুনলো না। এখন হয়েছে একদল আওয়াজ শোনাতে চায় আরেকদল কিছুতেই শুনবে না, কোন আওয়াজই দেবে না। বিনা আওয়াজে আবার এখন হয়ও না কিছু। ঐ যে যেমন বলে না 'না কাঁদলে ছেলে দুধ পায় না' তেমনি।দিনরাত কত ঘ্যানর ঘ্যানর আওয়াজ। নিজের নিজের হক সবাই আদায় করতে চায়। আবার বেশি আওয়াজ হয়ে গেলে শুনতে হয় 'এই বেশি আওয়াজ দিবি না কিন্তু,চুপচাপ থাকবি'।সেটাও আরেক রকম আওয়াজ। এখন গলার আওয়াজের উপর কথার মানে বের করে নিতে হয়। নরম আওয়াজ মানে দুর্বলতা হতে পারে, জোর আওয়াজ মানে লোকবল, অর্থবল এসব আছে। এখনকার যত যন্ত্রপাতি সব একেক রকম আওয়াজ বের করে। মানুষের শরীর খারাপ হলে যেমন আওয়াজ অন্যরকম হয়, যন্ত্রপাতি খারাপ হলেও ওদের আওয়াজ খারাপ হয়ে যায়। আওয়াজ ঠিক করতে মিস্ত্রী লাগে। এখন মানুষকে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি বা মেশিনের আওয়াজ শুনেই কাজ করতে হয়। যেমন মোবাইলের আওয়াজ একদিন না শুনলে মানুষ পাগল হয়ে যেতে পারে। মানুষ কি কাজ করবে এখন যন্ত্রই বলে দেয় নানারকম আওয়াজ করে। মানুষ তাই এখন আওয়াজের দাস।নানারকম আওয়াজ শুনতে শুনতে আমাদের কানগুলো অভ্যস্থ হয়ে গেছে। হঠাৎ কোন চুপচাপ শান্ত পরিবেশে গেলে মনে হয় যেন 'কী নেই,কী নেই '।
==================
Sushil Kumar Banerjee
Lower Chhinnamasta
Radhanagar Road
Near Muri Factory Airtel Tower
Asansol 713325
Dist-P Bardhaman
Comments
Post a Comment